প্রিয় নবিজীর প্রথম নারী জীবনীকার আয়েশা আল-বাউনিয়াহ

শেখ বিবি কাউছার | বৃহস্পতিবার , ৪ এপ্রিল, ২০২৪ at ১০:৩৩ পূর্বাহ্ণ

পুরুষসাধক ও কবিদের পাশাপাশি অনেক নারীসাধক ও কবি রয়েছেন যাঁদের নাম আমাদের অনেকেরই অজানা। কালের পরিক্রমায় সেসব নারীসুফিদের কথা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ রয়েছে। ইসলামের মধ্যবর্তী যুগে যে’কজন বিখ্যাত নারী সুফি ও কবির উন্মেষ ঘটেছিল তাঁদের মধ্যে আয়েশা আলবাউনিয়াহ অন্যতম। আরব নারীসুফিদের মধ্যে যিনি গল্প ও কবিতায় নিজেকে বিস্তৃত করেছেন। আধ্যাত্মিক সাধকরা প্রেমভক্তি ও ভাবের চর্চা করতে গিয়ে তাঁদের অন্তরে যে ভাব ও ভাবনা জাগে তা অনেক কবিতার মধ্য দিয়ে প্রকাশ করে। প্রিয় নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও কবি ও কবিতার বিষয়ে ছিলেন ইতিবাচক। হযরত ইমাম বুখারি তাঁর ‘আল আদাবুল মুফরাদ’ সংকলনে বিবরণ দিয়েছেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘কবিতা কথার মতোই। ভালো কথা যেমন সুন্দর, ভালো কবিতাও ঠিক তেমনি এবং মন্দ কবিতা মন্দ কথার মতোই মন্দ।’ সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস বর্ণনা করেছেন যে, ‘মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভালো কবিতায় বিমোহিত হতেন।’

নারীসুফি আয়েশা আল বাউনিয়াহ ১৪৫৬ সালে সিরিয়ার দামেস্কে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ইউসুফ নিজেও ছিলেন বিখ্যাত পণ্ডিত, কবি ও আইনবিদদের ‘আল বাউনিয়াহ পরিবারের’ সদস্য এবং দামেস্কের একজন কাজী (বিচারক)। পিতার কাছ থেকেই পেয়েছিলেন হাদিস, ফিকাহ এবং কবিতার প্রথম পাঠ। ধর্মীয় জ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতার চর্চায় তাঁর পরিবার সুপরিচিত ছিল। ফিলিস্তিনি ইতিহাসবিদ ওয়ালিদ খালিদির ধারণা, আয়েশার মধ্যে তাঁর পরিবারের সাহিত্য প্রতিভা এবং সুফি প্রবণতা পুরোপুরি ফুটে উঠেছিল।

স্বামী শিহাবুদ্দীন আল কাস্তালানী নিজেও ছিলেন একজন ইসলামি পণ্ডিত, হাদিস ও ধর্মতত্ত্বে বিশেষজ্ঞ।

মাত্র আট বছর বয়সে তিনি পবিত্র কোরআন শরীফ মুখস্ত করে ‘হাফিজা’ হন। ১৫১৩ সালে কায়রোতে গিয়ে তিনি আইনকানুন নিয়ে উচ্চতর পড়াশোনা করেন এবং সেখানে সৎ বিচারক হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি পান। এমনকি ফতোয়া দেওয়ার অনুমতিও পান। ১৫১৬ সালে তিনি আবার নিজ শহর দামেস্কে ফিরে আসে। এরপর ধীরে ধীরে ইসলামি আইন বা ফিকহ শাস্ত্র, হাদিস, তাসাউফ বা আধ্যাত্মবাদ এবং কাব্য ও সাহিত্যে তাঁর খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। দিওয়ান আল বাউনিয়া ও আল ফাতাহ আল মুবিন ফি মাধ আল আমিন তাঁর কাব্যগ্রন্থের মধ্যে অন্যতম।

আয়েশা আলবাউনিয়াহকে একজন নারী হিসেবে ধর্মীয় বৃত্তি ও সাহিত্যের জগতে প্রবেশ করতে গিয়ে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাধার মুখোমুখি হতে হয়েছে।

অক্সফোর্ড এনসাইক্লোপিডিয়া অফ ইসলামিক ওয়ার্ল্ড’এ কার্ল ডব্লিউ আর্নেস্ট লিখেছেন যে সুফিবাদের ইতিহাসে আয়েশা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নারী ব্যক্তিত্ব।

ডিওন স্টুয়ার্ট বলেছেন, ‘আইনবিদ হিসেবে তিনি খুব প্রসিদ্ধ ছিলেন।

তাঁর একেশ্বরবাদ এবং আধ্যাত্মিকতার সাধনায় প্রেম ও ভক্তির যে গুরুত্ব সে সম্পর্কে তিনি যে শিক্ষা দিতেন, সেজন্যও তিনি পরিচিত ছিলেন। তিনি তৎকালীন সুফি ঐতিহ্যের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ছিলেন এবং ইসলামী সুফিবাদের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।

তাঁর লেখালেখিতে জ্ঞান, আধ্যাত্মিক দিকনির্দেশনা, নারীদের আধ্যাত্মিকতা এবং সুফিবাদসহ নানা বিষয় উঠে এসেছে। আয়েশ আলবাউনিয়াহর জীবনী লেখক হোমেরিন, আয়েশাকে ইসলামী আধ্যাত্মিকতা এবং রহস্যময় চিন্তাধারার বিকাশে এক কেন্দ্রীয় ব্যক্তি হিসাবে বর্ণনা করেছেন। তার লেখায় সুফি ধর্মতত্ত্‌ব, ইসলামিক আইন, ইসলামি ইতিহাস এবং আরবি ব্যাকরণের পাশাপাশি সুফি কবিতা, সুফি গদ্যসহ বিস্তৃত বিষয় উঠে এসেছে।

তাঁর লেখা ‘আলআসরার আলমুকনুনা ফি শারহ ইসমাআল্লাহ আলহাসানাহ’ (আল্লাহর নাম ব্যাখ্যা করার রহস্য) বইটি ইসলামী সুফিবাদে একটি ক্লাসিক হিসাবে খ্যাত।

বইটি আল্লাহর নাম এবং সেসব নামের আধ্যাত্মিক অর্থ নিয়ে লেখা । সেইসাথে সুফি অনুশীলন ও বিশ্বাস সম্পর্কে আয়েশা আলবাউনিয়াহ নিজস্ব ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

তিনি বলেছেন বিভিন্ন রহস্যময় পঙক্তির সংখ্যা অগণিত হলেও সেগুলো আল্লাহর নৈকট্যের চারটি মূল নীতির উপর ভিত্তি করে তৈরি। যা অনুতাপ, সততা, স্মরণ এবং প্রেম।

আয়েশা আলবাউনিয়াহর বইটি আধ্যাত্মিক জ্ঞান অনুসন্ধানকারীদের জন্য এক অনুপ্রেরণার উৎস। একাত্মবাদ, প্রেম ও ভক্তির গুরুত্ব সম্পর্কে তাঁর শিক্ষা সুফি চিন্তাধারার কেন্দ্রবিন্দু।

দ্য মিস্টিক্যাল ডাইমেনশনস অফ ইসলাম’, অ্যান মেরি সামাল বলেছেন, আয়েশার বইটি ধর্মীয় অনুভূতির অন্তর্নিহিত শক্তির ওপর জোর দিয়েছে।

তার দেয়া শিক্ষা ইসলামিক ধর্মতত্ত্বের প্রতি আরও বেশি মানসিক ও আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে উপকারী। বিশেষজ্ঞদের মতে, তাঁর কবিতায় প্রায়ই প্রেম ও ভক্তির গভীর অনুভূতির পাশাপাশি আল্লাহর একাত্মবাদে গভীর মনোযোগ দিয়েছেন আয়েশা আলবাউনিয়াহর কবিতায় আল্লাহর নৈকট্য পেতে তার তীব্র ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।’ আয়েশা ইসলামের সেই কয়েকজন নারীদের একজন যারা আধুনিক যুগের আগে নারীদের জন্য লিখেছেন এবং কথা বলেছেন। যা তৎকালীন নারী সমাজ, ইসলামী সুফিবাদ এবং সাধারণভাবে ইসলাম সম্পর্কে নারীদের গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি জানান দেয়।

তাঁর বইগুলোর ভূমিকা থেকে জানা যায়, ইসলামের নবীর প্রতি তার কতোটা অগাধ ভালোবাসা ও ভক্তি ছিল।

মুহাম্মদ জুবায়ের এবং ডক্টর মুহাম্মদ ইদ্রিস লোধির গবেষণা থেকে আমরা জানি, আয়েশা আলবাউনিয়াহ হয়তো প্রথম এবং সম্ভবত একমাত্র নারী যিনি নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে লিখেছেন। নবিজীর জন্য তাঁর ভালোবাসা একটি কবিতার মধ্য দিয়ে আমরা দেখতে পায়। সেটি হল

সন্দেহ, উদ্বেগ এবং দুঃখ দূর করে‘- সেই গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘প্রতিটি কবিতা শুরুর আগে আয়েশা লিখেছেন যে, আল্লাহ তায়া’লার অনুগ্রহ যে তিনি এই কবিতাগুলো লেখার সুযোগ পেয়েছেন।’ তিনি সম্ভবত বিংশ শতাব্দীর পূর্বে অন্য যে কোনো নারীর চেয়ে আরবি ভাষায় বেশি রচনা করেছেন। এই মহতী নারী সুফিকবি ১৫১৭ সালে ৯৯২ হিজরি জিলকদ মাসে ষোলো তারিখ দামেস্কে মৃত্যুবরণ করেন।

লেখক: প্রভাষক, নোয়াপাড়া ডিগ্রি কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআলোর সাথে সে আসে
পরবর্তী নিবন্ধআ’লে রসুল গাউছুল আযম বাবা ভাণ্ডারী