[কবি আনন্দ মোহন রক্ষিত দৈনিক আজাদীতে প্রকাশের জন্য পাঠিয়েছিলেন এই লেখাটি। এটি প্রকাশের আগেই তিনি বিদায় নিলেন আমাদের থেকে। গত ৭ সেপ্টেম্বর তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আমরা তাঁর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করছি এবং বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি।]
তুমি আজ আমাদের ছেড়ে অন্য লোকের বাসিন্দা। শত ইচ্ছা করলেও তোমার মধুময় সান্নিধ্য আমরা পাবো না। তাই মনের মাঝে সদা–সর্বদা গুনগুন করে আওড়াই–
‘তোমারে হারিয়ে খুঁজি, শ্যামল প্রান্তর জুড়ে,
বন বনান্তরে অবারিত সবুজ সমারোহে,
কোথাও নেই তুমি ত্রিভুবন জুড়ে।’
গত ১৪ অক্টোবর ২০২২ শুক্রবার সন্ধ্যায় ইহলোকের মায়া ত্যাগ করে আমাদের বন্ধু কবি ও বাচিকশিল্পী রবিন ঘোষ মমতাহীন মৃত্যুর কোলে আশ্রয় নিয়েছেন। আমরা অবাক বিষ্ময়ে ঐদিন বন্ধুদের মাধ্যমে তাঁর মৃত্যুসংবাদ পাই। আকষ্মিক এই মৃত্যু সংবাদের জন্যে আমরা কেউই প্রস্তুত ছিলাম না। মৃত্যু শব্দটা এমনই নিষ্ঠুর যে, কোন কিছুর প্রতি দিকপাত করে না; কোন মায়া মমতার ধার ধারে না।
রবিন ঘোষ একজন মেধাবী কবি, গল্পকার, চমৎকার বাচিকশিল্পী ও তুখোড় আড্ডারু। সত্তরের দশক ছিলো আমাদের একটা স্বর্ণালী যুগ। আমরা তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী। শেষ বিকেলে আমরা মিলিত হতাম আন্দরকিল্লার বিখ্যাত চৌরঙ্গী রেস্তোরাঁয়। সেসময় আমরা যার যার প্রাত্যহিক কাজ সেরে চৌরঙ্গীর একটি নির্দিষ্ট অংশে আড্ডায় বসতাম। আমাদের মধ্যে ছিলেন কবি মৃদুল গুহ (প্রয়াত), কবি ফাউজুল কবির, কবি রবিন ঘোষ, কবি অভিক ওসমান, প্রাবন্ধিক কালাম চৌধুরী, কবি সুখময় চক্রবর্তী, এয়াকুব ভাই, রক্তিম দস্তিদার, কবি সাথী দাশ, সঞ্জিব রায় পবু, অধ্যাপক স্বরূপানন্দ রায়, দেবাশীষ চৌধুরী, অরবিন্দ সরকার বাবুল ও আমি। আরও পরে আমাদের সাথে যুক্ত হন কবি আশিষ সেন, বিমল দে, নিত্যলাল খাস্তগীর, বাবুল খাস্তগীর, শিশির ভট্টাচার্য, অনিত চৌধুরী, পুলক রক্ষিত, রণজিত চৌধুরী, বিশ্বজিত চক্রবর্তী, কবি কমলেশ দাশগুপ্ত, কবি সুনীল নাথ, কবি স্বপন দত্ত এবং পরবর্তীতে আরও কেউ কেউ যুক্ত হয়েছিলেন যাঁদের নাম বর্তমানে আমার দুর্বল স্মৃতিশক্তির কারণে স্মরণ করতে পারছি না। তাঁদের কাছে আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
চৌরঙ্গীর আড্ডা আমাদের শুধুমাত্র গল্পগুজবের আড্ডাই ছিলো না। আমাদের প্রায় প্রত্যেকেই ছিলেন নিরন্তর সৃজনশীল। আমাদের মাথায় ছিলো কোলকাতার কলেজ স্ট্রিটের বিখ্যাত ‘কফি হাউজে’র আদলে কিছু একটা করার। আশির দশকের প্রথম দিকে কবি মৃদুল গুহ ও বহুমাত্রিক প্রতিভাধর ব্যক্তি কবি, নাট্যকার ও প্রাবন্ধিক অভিক ওসমানের নেতৃত্বে আমরা সবাই মিলে গড়ে তুলি ‘চৌরঙ্গী সংস্কৃতি মঞ্চ’। চৌরঙ্গী মঞ্চের উদ্যোগে আমরা আয়োজন করি ডিসি হিলের উন্মুক্ত মঞ্চে চট্টগ্রামে সর্বপ্রথম পহেলা বৈশাখ উদযাপন অনুষ্ঠান। ইতোপূর্বে ঘরোয়াভাবে পহেলা বৈশাখ উদযাপিত হলেও চট্টগ্রামের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে এ উদ্যোগ আমাদেরই প্রথম ছিলো। পরবর্তীতে চৌরঙ্গী সংস্কৃতি মঞ্চের সাথে চট্টগ্রামের অনেক নাট্যজন, সঙ্গীতশিল্পী, আবৃত্তিশিল্পী, অভিনয়শিল্পী যুক্ত হয়ে আমরা রবীন্দ্র–নজরুল জন্মজয়ন্তী অনুষ্ঠান ডিসি হিলের উন্মুক্ত স্থানে উদযাপন করি। পরবর্তী সময়ে অনেক অনুষ্ঠান এখানে অনুষ্ঠিত হয়েছে।
সে সময় এসব অনুষ্ঠানে কবি ও বাচিকশিল্পী রবিন ঘোষের কবিতা আবৃত্তি আমরা গভীর মনোযোগ দিয়ে উপভোগ করতাম। তাঁর আবৃত্তির অনুষ্ঠান ছিলো অসাধারণ। যখন রবিন ঘোষ আবৃত্তি করতেন আমরা পিনপতন নীরবতায় তা শুনতাম এবং প্রাণভরে উপভোগ করতাম। তিনি শুধু নিজের লেখা পাঠ করতেন না। তিনি নিজেও লিখতেন এবং অন্যকেও লিখতে ও আবৃত্তি করতে উৎসাহিত করতেন। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, রবিন ঘোষের কোন কবিতার বই প্রকাশ পায়নি; কোন আবৃত্তির ক্যাসেট বের হয়নি। অনেক গল্প রচনা করলেও কোন গল্পের বই প্রকাশিত হয়নি। তাঁর মন ও মগজে ছিলো একাধিক উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি। তাঁর পরিবারের কাছে কোন কবিতা কিংবা গল্প–উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি রেখে গেছেন কিনা আমাদের জানা নেই। যদি থাকে আমাদের সৃজনশীল কোন প্রকাশনা সংস্থা খোঁজখবর নিয়ে তা প্রকাশের উদ্যোগ নিলে আমরা কৃতার্থ হবো।
আমরা যতদূর জানি কবি রবিন ঘোষ ছাত্র জীবনে অত্যন্ত মেধাবী শিক্ষার্থী ছিলেন। স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাজীবনে তিনি মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন। কবি রবিন ঘোষ নিরন্তর একজন সৃজনশীল লেখক ছিলেন। অসম্ভব স্মৃতিশক্তির অধিকারী ছিলেন তিনি। যখন তিনি কবিতা আবৃত্তি করতেন কোন সময় পাণ্ডুলিপি হাতে রাখতেন না। অনর্গল আবৃত্তি করে যেতেন।
রবিন ঘোষ এতো মেধার অধিকারী হয়েও কোন প্রাতিষ্ঠানিক পেশায় নিযুক্ত হননি। ইচ্ছে করলে তিনি বহু বড় বড় প্রতিষ্ঠানের উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হতে পারতেন। কিন্তু কোন পদপদবী এবং অর্থবিত্তের প্রতি কখনও আকৃষ্ট হননি। এসব বিষয়ে তিনি সবসময় উদাসীন ছিলেন। বিত্তের মোহ তাঁর চিত্তকে আকৃষ্ট করতে পারেনি কোনদিন। সার্বিকভাবে তিনি একজন নির্মোহ মানুষ ছিলেন। সারাজীবন তিনি ছাত্র পড়িয়ে সংসারজীবন অতিবাহিত করেছেন। তাঁর স্ত্রী মানসী ঘোষ একটা স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন। স্বামী রবিন ঘোষের এবং নিজের স্বল্প আয়ে দুই মেয়ে নিয়ে অত্যন্ত সুখী শান্তিপূর্ণ সচ্ছল সংসারজীবন অতিবাহিত করেছেন। মেয়েদের উচ্চশিক্ষা দিয়েছেন এবং দিচ্ছেন। একজন মেয়ে এখনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বোাঁনিতে সম্মান শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী। এমন একটি সময়ে রবিন ঘোষ প্রয়াত হয়েছেন, যখন তাঁদের আগামী দিন খুবই অন্ধকার দেখছি। যদিও রবিনের অনুজ ধলঘাট ইউনিয়নের সুযোগ্য চেয়ারম্যান রণবীর ঘোষ সব দায়িত্ব সচেষ্টভাবে পালন করে যাচ্ছেন। আশা করছি অগ্রজ রবিন ঘোষের অবর্তমানে রণবীর তাঁর পরিবারের দায়িত্বও নিজ কাঁধে তুলে নেবেন।
রবিন ঘোষ ৬৮ বছর বয়সে আকষ্মিকভাবে প্রয়াত হয়েছেন। চার ভাই তিন বোনের মধ্যে রবিন ঘোষ ছিলেন সবার বড়। এর আগে তাঁর আরও একজন ছোট ভাই প্রয়াত হয়েছেন। রবিন ঘোষের সাথে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিলো অত্যন্ত চমৎকার। তাঁর আন্তরিক ব্যবহার, সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক আজীবন স্মরণে থাকবার মতো।
পরিশেষে অকালপ্রয়াত প্রিয় কবি, বাচিকশিল্পী, প্রাবন্ধিক ও গল্পকার রবিন ঘোষের আত্মার চিরশান্তি ও সদ্গতি কামনা করছি এবং তাঁর পরিবার ও আত্মীয়বর্গের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জানাচ্ছি।
লেখক : কবি; সাবেক উপাধ্যক্ষ, রাউজান কলেজ