প্রথম আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকে ইতালির বোলনায় ও ফ্রান্সের প্যারিসে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থী মিলিত হয়ে সংঘ সৃষ্টির মাধ্যমে-এই সংঘকে বলা হয় ইউনিভার্সিটাস-এইসব বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা। আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সূচনা ব্যক্তি উদ্যোগেই। পঞ্চম শতকে রোমান সাম্রাজ্য উপজাতীয় আক্রমণে ধ্বংস হওয়ার পর ইউরোপে পাঁচশ বছরব্যাপী অন্ধকার যুগ নেমে এসেছিল। এই অন্ধকার যুগের অবসানের পর ইউরোপে ব্যবসা-বাণিজ্য ও তার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার পুনরুজ্জীবন ঘটে একাদশ-দ্বাদশ শতকে মুখ্যত ইতালির বিকাশমান নগররাষ্ট্রগুলোতে, পরে ইউরোপের অন্যান্য অংশে। ‘অন্ধকার যুগে’ প্রায় পুরো ইউরোপে শিক্ষার আলো সম্পূর্ণভাবে নিভে গিয়েছিল বলা চলে। কেবলমাত্র টিমটিম করে জ্বলছিল চার্চগুলোতে। অষ্টম-নবম শতকে ক্যারোলিনজিয়ান সম্রাট শার্লামেন পশ্চিম ইউরোপের বিশাল অংশ নিয়ে নতুন সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন। এই কারণে পোপ ৮০০ খ্রিষ্টাব্দে তাঁকে ‘হলি রোমান এম্পারার’ ঘোষণা করেন। এই শার্লামেন এবং ইংল্যান্ডের আলফ্রেড দ্য গ্রেট, যিনি ইংল্যান্ডকে এক করেছিলেন, দু’জনেই পড়তে শিখেছিলেন তাঁদের উত্তর যৌবনকালে। ইউরোপজুড়ে অশিক্ষার এই সর্বব্যাপী অন্ধকারের মধ্যেই দ্বাদশ শতকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সূচনা ঘটেছিল। ইউরোপে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সূচনার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে পুঁজিবাদের বিকাশ।
দ্বাদশ শতক থেকে ইউরোপ জুড়ে যতই প্রাচ্যের সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এবং অন্তর্বাণিজ্যের বিকাশ ঘটেছে, উৎপাদন শক্তির বিকাশ ঘটেছে, ততই সেখানে নতুন নতুন পেশা ও কর্মের সৃষ্টি হয়েছে। এইসব পেশা ও কর্মের সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তিরও বিকাশ ঘটেছে, জ্ঞানেরও অগ্রগতি হয়েছে। এই অগ্রগতিরই পরোক্ষ ফল হিসেবে নানা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা শুরু হয়। ১৫৫০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে ইউরোপে সই করতে পারতেন এমন লোকের সংখ্যা ছিল মাত্র ৫ শতাংশ। ১৭৫০ খিষ্টাব্দের দিকে এই সংখ্যা হল্যান্ড, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও জার্মানিতে বিপুল পরিমাণে বেড়ে যায়। এইসব দেশে তা ৩৫ থেকে ৪৫ শতাংশে উন্নীত হয়। ইউরোপে যে দেশে যত বেশি শিক্ষিত সৃষ্টি হয়েছে, দেখা গেছে সে দেশ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ততই বিপুলভাবে এগিয়ে গেছে। এইসব দেশে নব প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিস্তার ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির মুখ্য মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছে।
বর্তমানেও দেখা যাচ্ছে, শিক্ষার ক্ষেত্রে যে দেশ যত বেশি এগুচ্ছে, সে দেশই বিশ্বে নেতৃত্বের ভূমিকায় এগিয়ে আসছে। বর্তমানে চীন ও ভারত প্রত্যেকটি দেশেরই লোকসংখ্যা প্রায় ১৪০ কোটি। বিংশ শতাব্দীর ৫০-এর দশকের প্রথমে ভারত ও চীনের জিডিপির মধ্যে তেমন বড়ো কোন পার্থক্য ছিল না। কিন্তু আজ পার্থক্যের পরিমাণ বিশাল। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত সবচেয়ে অগ্রগামী অর্থনীতি হলেও চীন থেকে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। চীনের বর্তমান জিডিপি হলো প্রায় ১৮ ট্রিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি, ভারতের প্রায় ৩.৫০ ট্রিলিয়ন ডলার। এর প্রধান কারণ শিক্ষাকে চীন যেভাবে গুরুত্ব দিয়েছে, তা ভারত থেকে অনেক বেশি। ভারত বর্তমানে জিডিপির ২.৬ শতাংশ খরচ করে শিক্ষায়, চীন করে ৪ শতাংশ। চীন গত অর্থবছরে শিক্ষায় খরচ করেছে ৫৬৫ বিলিয়ন ডলার, যেখানে ভারতের খরচ মাত্র ৫৭ বিলিয়ন ডলার। তাই এটাই স্বাভাবিক যে, চীন এগিয়ে যাবে। তাই দেখা যাচ্ছে, বর্তমান বিশ্বে গবেষণার ক্ষেত্রে চীনের অবস্থান যেখানে ১ নম্বরে, যুক্তরাষ্ট্র ২ নম্বরে, ভারত ৫ নম্বরে।
সুতরাং বলার অপেক্ষা রাখে না, আজকের বিশ্বে যদি একটি দেশকে এগোতে হয়, সে দেশকে এগোতে হবে জ্ঞানসমৃদ্ধ হয়ে। জাপানের উদাহরণ থেকে আমরা বলতে পারি, জাপান কৃষিতে এবং খনিজ সম্পদে অত্যন্ত দীন হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র মানবসম্পদ বা জ্ঞান সৃষ্টির মাধ্যমে এই সেদিন (২০১৪) পর্যন্ত বিশ্বের ২য় সমৃদ্ধ অর্থনীতি ছিল; বর্তমানে চীন। মাথাপিছু আয়ের ক্ষেত্রে অবশ্য চীন এখনও জাপান থেকে অনেক পিছিয়ে। কারণ চীনের জনসংখ্যা ১৪০ কোটি, জাপানের মাত্র ১৩ কোটি। অর্থনীতিবিদগণের বিশ্লেষণে বেরিয়ে এসেছে, জাপানের সমৃদ্ধির পেছনে কাজ করেছে, ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে মেজি রাজবংশের পুনঃঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে জ্ঞানচর্চা শুরু হওয়ার ফলে।
প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটিও বাংলাদেশকে জ্ঞান-সমৃদ্ধ করার লক্ষ্য নিয়ে প্রাক্তন মেয়র ও মানবতাবাদী রাজনৈতিক নেতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ২০০১ সালের ডিসেম্বর মাসে। তাই প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটির লক্ষ্য কেবল জ্ঞান অর্জন নয়, জ্ঞান সৃষ্টিও; এই লক্ষ্যে ও আদর্শে শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে। প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি ডিগ্রিকে যথার্থ মূল্য দিলেও আরো বেশি মূল্য দেয় তাদের শিক্ষার্থীরা যেন জীবনের ক্ষেত্রে এই ইউনিভার্সিটি থেকে তাদের অর্জিত জ্ঞানকে ব্যবহার করতে পারে। এই কারণে প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি শিক্ষার মান বৃদ্ধিকে গুরুত্ব দেয়, গুরুত্ব দেয় তাত্ত্বিক (theoritical) জ্ঞানকে ব্যবহারিক (empirical) প্রয়োগে ঋদ্ধ করতে।