(দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব )
পীরগাছা যাওয়ার ইচ্ছেটা ভাটা পড়েছে বাদলের শরীর খারাপের জন্যে। আমাদের প্রবল ইচ্ছেয় বিশ্রামের পর রওনা হলাম বিকেলে। সেখানে যাওয়ার কারণটা হলো কামরুল হাসান বাদলের জন্ম ও শিশুকাল কেটেছে ওখানে। সে জায়গাগুলো সবাই মিলে ঘুরে দেখা।
দীর্ঘ এই বিকেল পাড়ি দিচ্ছি ভালোলাগার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে। রাস্তার দু’ধারে ভুট্টাক্ষেতের সৌন্দর্য, মাঝেমধ্যে সবুজ ধানের বিশাল ক্ষেত পেরিয়ে পাওয়া গেল একটা বিশাল দীঘি। দীঘির পাশ ঘেঁষে রাস্তা। একটু জ্যামে পড়েছি। হট্টগোল, বাঁশি, মাইকের শব্দ, রঙিন কাপড়ের প্যান্ডেলে বিশাল গেইট। দূর থেকে দেখতে পেলাম নাগরদোলা। বাদলই বলল, ‘বোধহয় চণ্ডীমেলা,আমার ছোটবেলায় এই মেলায় এসেছি।’ আমরাও নামলাম গাড়ি থেকে।
মানুষের ভিড়ে মিশে গেলো সে ছেলেবেলার মতো। টমটম, নাগরদোলা নিয়ে গেছে তাকে শৈশবে। আমি দেখতে পেলাম জটলায় দাঁড়িয়ে কথা বলছে বাদল। তার চোখেমুখে বিজয়ের চিহ্ন। আমি তার স্মৃতির ভিতরে হাঁটছি, ছবি তুলছি।
সন্ধ্যা নেমে এসেছে ততক্ষণে। তাড়া দিলাম আমাদের যেতে হবে। রওনা হলাম মানুষের ভিড় ঠেলে, কৌতূহল–দৃষ্টি এড়িয়ে। গাড়ি চলছে। ওর দৃষ্টি বাইরে, ঝাপসা। অনেকবছর পর একটি গ্রামীণ মেলা দেখার সুযোগ হলো।
যতই কাছাকাছি এগোচ্ছি ততই বাদলকে সবাই প্রশ্ন করছে তুই চিনতে পারবি? সে বটগাছের কথা বললো। ভাবছি এতোদিন পরেও কী বটের দেখা পাবে? অবশেষে আমরা পৌঁছে গেলাম বাদল যে স্কুলে পড়েছিল সে প্রাইমারি স্কুল ও হাইস্কুলে। সেসব ঘুরে গেলাম পীরগাছা রাজবাড়ি। ততক্ষণে অন্ধকার নেমেছে। টর্চ ও গাড়ির হেডলাইট আর সেসঙ্গে মানুষের ভালোবাসার আলোয় আমাদের দেখানো হলো রাজবাড়ি। এই রাজবাড়িতে জড়ো হলো ছেলে, বুড়ো, নারী অনেকে। তারাও দেখালো কোথায় কী কী ছিলো, আছে। সবাই আমাদের নিমন্ত্রণ দিয়ে রাখলো পুজোয় যেন যাই।
বাদল বলতো এই মানুষগুলো খুবই ভালো। এরা আত্মীয়ের মতো কাছে টেনে নেয়। তাই দেখলাম। যতদূর সম্ভব গাড়ির পিছে পিছে তারা এগিয়ে দিলো। বড্ড মায়া। সে মায়া নিয়ে আমরা ফিরে এলাম আবার রংপুরে।
ভ্রমণের তৃতীয় দিনে গেলাম তিনবিঘা করিডোর তথা ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশকে দেখতে। এই জায়গার কথাও পত্রিকায় পড়েছি। বুঝতাম না কিছুই। একসময় দিনে শুধু একবারই খোলা হতো চলাচলের জন্য। তাও ঘন্টাখানেকের জন্যে। এখন সারাদিন খোলা থাকে। গেলাম দহগ্রাম, আঙরপোতা। একেবারেই শেষ সীমান্তে। একটা টিনের বাড়ি শেষ সীমানায়। খুব কম মানুষের সাথে দেখা হলো। জানতে চাইলাম তাদের কাজ কী? কীভাবে তারা জীবিকার জন্য কাজ করে। গরুর ব্যবসা কি লাভজনক? মাথা নেড়ে জবাব দিলো, এখানে মানুষের মতো গরুরও জন্ম নিবন্ধন করতে হয়। তাদের জন্য ভারত কাছে, বাংলাদেশ দূরে। অথচ এই মাটি দু’ভাগ করেছে কোন কাঁটাতার নয়, একটা পাকা ছোট্ট স্তম্ভ। একপাশে লেখা ইন্ডিয়া, অন্যপাশে বাংলাদেশ।
আঙরপোতা, দহগ্রাম ঘুরে দেখে বিশ্রাম নিয়েছিলাম দহগ্রাম পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রে৷ চা, নাস্তা শেষ করে আমরা চলে এলাম পাটগ্রাম থানায়। সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন পাটগ্রাম থানার ওসি। পুকুরের মাছ, ক্ষেতের সবজি আরো নানাপদের খাবারে আমরা তৃপ্তি নিয়ে দুপুরের খাবার খেলাম। খুব ভালো মনের মানুষ ওসি সাহেব। আমাদের চা পান করিয়ে নিয়ে গেলেন বুড়িমারী স্হল বন্দর দেখাতে। দেখলাম কাঁটাতার দিয়ে ব্যারিকেড দেয়া। পারাপার হচ্ছে মানুষ। বিশেষ করে ওপার থেকে আসা মানুষের কষ্ট দেখলাম। বহুদূরে গাড়ি, যা আমার দৃষ্টির আড়ালে। ওখান থেকে ছেলে বুড়ো সবাই লাগেজ টেনে টেনে হেঁটে আসছেন এপারে। জানতে পারলাম এভাবেই আসে। স্থল সীমান্তে কষ্ট অনেক।
চতুর্থদিনে আমরা গেলাম দিনাজপুরে। প্রথমে দেখতে পেলাম কান্তজিউ মন্দির। টেরাকোটায় মহাভারত, রামায়নের সচিত্রকরণ করা হয়েছে। দিনাজপুরের রাজবাড়ি, তার কাঠামো, ভগ্নাংশ ঘুরে দেখলাম। রামসাগরও গেলাম।
আমাদের ভ্রমণসঙ্গী কবি, সাংবাদিক ওমর কায়সার ভাই ও ভাবী রাতে চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা দেবেন। তাই আমরা পার্বতীপুর গেলাম ট্রেনে তুলে দিতে । ওখানে আমাদের জন্য চমক অপেক্ষা করছিলো। পাবর্তীপুর পৌঁছে জানতে পারলাম ট্রেন ছাড়তে দেরি হবে। আমাদের এতো ঘন্টার অপেক্ষা যেন নিমিষেই শেষ হয়ে গেলো পাবর্তীপুরের নবনির্বাচিত মেয়র আমজাদ হোসেন ভাইয়ের আন্তরিকতায়। উনি এবং ওনার সাথে থাকা মানুষগুলো বুঝতেই দিলো না এই আমরা আজই পরিচিত হলাম। উত্তরবঙ্গের মানুষ ভালো শুনেছি। কিন্তু এতো ভালো মানুষ আমার জীবনে এ–ই দেখলাম। সবার ব্যবহার কী করে এতো ভালো হয়। মেয়রের অফিস একেবারেই জংশন লাগোয়া। পাবর্তীপুর রেল জংশন খুব সুন্দর। মানুষ গিজগিজ করছে। অথচ শোরগোল নেই। আমি কখনও ভুলবো না এই মানুষদের কথা। যারা রাত একটায় ট্রেন ছেড়ে যাওয়া অব্দি আমাদের সঙ্গে ছিলেন। কায়সার দম্পতিকে বিদায় দিয়ে আবার ফিরলাম দিনাজপুরে।
পরেরদিন রওনা হলাম তেঁতুলিয়ার উদ্দেশে। পঞ্চগড় চা বাগান দেখে ভাবলাম, আগে জানতাম পাহাড়ি ঢালু জায়গায় চা উৎপাদিত হয়। অথচ এখানে সমতলে প্রতিটা বাড়ির খোলা জায়গায় চা বাগান। দেখতেও সুন্দর । উঠোন মানেই চা বাগান।
পঞ্চগড় জেলা সদর হতে প্রায় ৩৯ কিলোমিটার উত্তরে হিমালয়ের পাদদেশে মহানন্দা, ডাহুক ও করতোয়া নদী, এবং তিন দিকে ভারতবেষ্টিত ৭টি ইউনিয়ন (বাংলাবান্ধা, তিরনইহাট, তেঁতুলিয়া, শালবাহান, বুড়াবুড়ি, ভজনপুর ও দেবনগর)।
তেঁতুলিয়া পুলিশ অফিসার্স মেস থেকেও কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পাওয়া যায় অক্টোবর, নভেম্বরের দিকে। সেসময়ে নাকি রীতিমতো সামিয়ানা টাঙিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার জন্য প্রস্তত রাখা হয় মাঠ। অফিসার মেস এবং তার চারপাশ খুব সুন্দর। লাগোয়া চা বাগান আর বাগানের ঢালুতে মহানন্দা নদী। দিনরাত পাথর তুলছেন ওখানকার মানুষ। নদীতে পানি কম বালু বেশি। কিছুক্ষণ পর পর বিএসএফএর লোকজন খেদিয়ে দেয় পাথর উত্তোলনকারীদের।
তেঁতুলিয়া ছোট্ট এলাকা। ছিমছাম, কোলাহলশূন্য। দুপুরে আমরা ডাক বাংলো, মহানন্দা নদী, বাংলাবান্ধা বর্ডার, আর জিরো পয়েন্টে গেলাম। বিশাল প্রশস্ত রাস্তা। দ’ুপাশেই দু–দেশের সেনা দাঁড়িয়ে আছে। তারা খুব নমনীয়। আমরা জিরো পয়েন্টের ওপারে গেলাম। শিলিগুড়ি থেকে আসা মানুষের সাথে কথা বললাম। ওরাও দেখতে এসেছে এক টুকরো বাংলাদেশ। দু’দেশের ভাষা এক, সংস্কৃতি এক অথচ আমাদের দূরত্ব যোজন–যোজন। এই বাংলাবান্ধা বর্ডারে দু–দেশের পতাকা নামানো হয় বিউগল বাজানোর মাধ্যমে। এই দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য হয়েছিলো আমাদের।
সন্ধ্যায় পুলিশ অফিসার্স মেসে ফিরে এলাম। রাতে ভ্যানগাড়ি করে তেঁতুলিয়া বাজার ঘুরলাম। নিরব একটা শহর। পরের দিন নীলফামারী হয়ে নীলসাগর দেখে আমরা সৈয়দপুরের জন্য রওনা হলাম। মে দিবসের মিছিল, মিটিং খুব চোখে পড়লো। দোকানপাট বন্ধ ছিলো। আমরা পরে একটা হোটেলে খাবারটা সারলাম। তারপর এয়ারপোর্টের জন্য রওনা হলাম।
আমার মায়া পড়ে আছে উত্তরবঙ্গের জন্যে। ওখানে আবারও যেতে মন চাইছে। পুরো ভ্রমণে উত্তরবঙ্গের পুলিশ প্রশাসন, রংপুরের পুলিশ কমিশনারের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। তাদের অপরিসীম, ক্লান্তিহীন সৌজন্যতা আমাদের অনেক ঋণী করেছে। আর আমাদের বন্ধু এজাজ মাহমুদ তো আছেই সব–সময়ে ভালো–মন্দে রাখবার জন্যে।