বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রায়োগিক সাক্ষরতা নিরূপণ জরিপে বলা হয়েছে, দেশে প্রায়োগিক সাক্ষরতার হার ৬২.৯২ শতাংশ। পড়তে পারেন, লিখতে পারেন, বুঝতে পারেন ও গণনা করতে পারেন–দেশে এমন প্রায়োগিক সাক্ষরতা সম্পন্ন মানুষের হার এটা। তাদের বয়স সাত বছর থেকে বেশি। ৭ থেকে ১৪ বছর বয়সীদের মধ্যে প্রায়োগিক সাক্ষরতায় পুরুষের চেয়ে এগিয়ে রয়েছেন নারীরা।
গত সোমবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পরিসংখ্যান ভবন মিলনায়তনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে জরিপের ফলাফল প্রকাশ করা হয়। জরিপে দেখা যায়, গ্রামের তুলনায় শহরে প্রায়োগিক সাক্ষরতার হার বেশি। পুরুষদের (৭–১৪ বছর) মধ্যে যেখানে প্রায়োগিক সাক্ষরতার হার ৬৯ দশমিক ৬৭, সেখানে নারীদের ক্ষেত্রের এ হার ৭৬ দশমিক ৪২। বিবিএস জানিয়েছে, যিনি পড়তে, অনুধাবন করতে, মৌখিক ও লিখিতভাবে বিভিন্ন বিষয় ব্যাখ্যা করতে, যোগাযোগ স্থাপন করতে এবং গণনা করতে পারেন, তাঁকেই প্রায়োগিক সাক্ষরতার আওতায় হিসাব করা হয়েছে। ২০২৩ সালের জরিপে প্রথমবারের মতো সাত বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সীদের জরিপ করা হয়েছে। সাক্ষরতার হার যাচাইয়ে নির্বাচিত প্রত্যেক ব্যক্তির ১০০ নম্বরের পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ন্যূনতম ৫০ নম্বর পেলে প্রায়োগিকভাবে সাক্ষর হিসেবে ধরা হয়েছে। জরিপটি করা হয় ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। এ কাজে দেশের সব জেলা থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। জরিপে বলা হয়, দেশের ৭ থেকে ১৪ বছর বয়সীদের প্রায়োগিক সাক্ষরতার হার ৭২ দশমিক ৯৭। এ ছাড়া ১৫ বছরের বেশি বয়সী নাগরিকদের ক্ষেত্রে এ হার ৬০ দশমিক ৭৭। এর আগে ২০১১ সালে ১১ থেকে ৪৫ বছর বয়সীদের নিয়ে জরিপ চালানো হয়। তখনকার জরিপে প্রায়োগিক সাক্ষরতার হার ছিল ৫৩ দশমিক ৭০। এই বয়সসীমা ধরলে বর্তমান জরিপে প্রায়োগিক সাক্ষরতার হার ৭৩ দশমিক ৬৯। এর অর্থ গত ১৩ বছরে এই হার বেড়েছে ১৯ দশমিক ৯৯।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, আভিধানিক অর্থে সাক্ষরতা হলো অক্ষরপরিচিতি, লেখা ও পড়ার ক্ষমতাসম্পন্ন হওয়া। অর্থাৎ যদি কোনো ব্যক্তি কোনো বিষয় পড়ে, সেটা লেখার মাধ্যমে প্রকাশ করতে সক্ষম হয়, তাহলে তাকে সাক্ষর বলে। ইউনেসকোর বিশেষজ্ঞ কমিটি সাক্ষরতার সংজ্ঞা দিয়েছে এভাবে: ‘একজন ব্যক্তির পাঠের ক্ষমতা অক্ষরপরিচয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে পাঠের বিষয়ের বোধগম্যতা ও লিখে নিজের মনের ভাব প্রকাশের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।’ সাক্ষরতা শব্দটি দুটি অর্থে ব্যবহৃত হয়: ব্যবহারিক সাক্ষরতা ও আনুষ্ঠানিক সাক্ষরতা। ব্যবহারিক সাক্ষরতা বলতে বোঝায় লেখা, পড়া ও গণিতের সাধারণ জ্ঞান অর্জন করা আর আনুষ্ঠানিক সাক্ষরতা হলো স্কুল–কলেজে পড়ে যে শিক্ষা পাওয়া যায়। একসময় সাক্ষরতা বলতে সাধারণত অক্ষরজ্ঞানসম্পন্নতাকেই বোঝানো হতো। অর্থাৎ নিজের নাম লিখতে যে কয়টি বর্ণমালা প্রয়োজন, তা জানলেই তাকে সাক্ষর বলা হতো। কিন্তু দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এর পরিধি। এখন শুধু সাক্ষরজ্ঞান থাকলেই তাকে সাক্ষরতা বলা চলে না। ১৯৪০ সালের দিকে পড়ার সঙ্গে লেখার দক্ষতাকে সাক্ষরতা বলে অভিহিত করা হতো। ষাটের দশকে পড়া আর লেখার দক্ষতার সঙ্গে হিসাবনিকাশের যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষ সাক্ষর হিসেবে পরিগণিত হতো। ১৯৬৭ সালে ইউনেসকো প্রথম সাক্ষরতার সংজ্ঞা দেয়। পরে ১৯৯৩ সালে ইউনেসকো সাক্ষর সম্পর্কে যে সংজ্ঞাটি নির্ধারণ করে তা হলো: যে ব্যক্তি নিজ ভাষায় সহজ ও ছোট বাক্য পড়তে পারবে, সহজ ও ছোট বাক্য লিখতে পারবে এবং দৈনন্দিন জীবনে সাধারণ হিসাবনিকাশ করতে পারবে। বাংলাদেশে সাক্ষরতার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ১৯০১ সালে। বর্তমানে দেশে সাক্ষরতার হার ৭৪.৭০ শতাংশ।
দেশের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এসডিজি অর্জনের যে লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়েছে, তাতে বলা আছে, ২০৩০ সালের মধ্যে দেশকে নিরক্ষরমুক্ত করতে হবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ‘দেশে বর্তমানে সাক্ষরতার হার বাড়ানোর জন্য সরকারকে সাক্ষরতাকেন্দ্রের প্রসার ঘটানোর পাশাপাশি দেশের যেসব অঞ্চলে সাক্ষরতার হার কম, সেসব অঞ্চলে এই কেন্দ্রগুলোর বেশি করে প্রসার ঘটাতে হবে’। তাঁরা বলেন, জনসংখ্যাকে যথার্থ অর্থেই সম্পদে পরিণত করার লক্ষ্য নিয়ে এগোতে হবে।