প্রার্থিতা ঘিরে মিত্রদের অসন্তোষ, কী ভাবছে বিএনপি?

বিবিসি বাংলা | রবিবার , ৭ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ৪:৩৭ পূর্বাহ্ণ

আগামী সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি এককভাবে প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করায় ক্ষোভ ও অসন্তোষ তৈরি হয়েছে তাদের দীর্ঘদিনের মিত্র দলগুলোর মধ্যে। বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর নেতাদের সাথে কথা বলে যে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে তাতে শেষ পর্যন্ত সর্বোচ্চ ১০১২টি আসন মিত্র কিংবা সমমনা দলগুলোর জন্য ছেড়ে বাকি সব আসনে দলীয় প্রার্থী দিতে পারে বিএনপি। তবে এসব দলকে নিয়ে জোটবদ্ধ নির্বাচন হবে নাকি আসনভিত্তিক সমঝোতা হবে তা এখনো চূড়ান্ত করেনি বিএনপি।

দলটির নেতারা ইঙ্গিত দিয়েছেন, দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করতে হবে বলেই মিত্র দলগুলোর অনেক শীর্ষ নেতার প্রত্যাশিত আসনে দলীয় প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে বিএনপি। আর এটিই ক্ষুব্ধ করেছে বিএনপির দীর্ঘদিনের মিত্র হিসেবে পরিচিত কয়েকটি দলকে। আবার কোনো মিত্র দল মনে করছে আলোচনার মাধ্যমে এসব বিষয়ের নিষ্পত্তি হওয়ার সময় ও সুযোগ ফুরিয়ে যায়নি। বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, মিত্রদের সাথে আলোচনা করে তাদের সাথে নিয়ে এগুবে বিএনপি। এজন্য দলের একটি কমিটি কাজ করছে।

ওদিকে নির্বাচনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী জামায়াতে ইসলামী তাদের আট দলীয় জোট নিয়ে আসন সমঝোতার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আগামী সপ্তাহ নাগাদ তাদের প্রার্থী তালিকা ঘোষণার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানা গেছে।

সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রথম দফায় গত ৩ নভেম্বর ২৩৭ আসনের (পরে একটি স্থগিত করা হয়) প্রাথমিক তালিকা প্রকাশ করেছিল বিএনপি। তখন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, পরে যথাসময়ে অন্যান্য আসনের প্রার্থী ঘোষণা করা হবে। তিনি বলেছিলেন, আমাদের অ্যালায়েন্সের সঙ্গে যারা আছেন তাদেরগুলো এবং আমাদের দুইএকটা ডিসিশন হবে, সেগুলো আমরা আরও পরে ঘোষণা করব। বাকিগুলো আমরা যথাসময়ে ঘোষণা করব। তখন ধারণা করা হয়েছিল, বাকি ৬৩টি আসনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য আসন হয়তো দলটি তার মিত্রদের জন্য ছেড়ে দিতে পারে।

এ নিয়ে আলোচনার পর গত সপ্তাহ মিত্র দলগুলোর নেতাদের বৈঠকে ডাকা হলেও শেষ পর্যন্ত বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার অসুস্থতার কারণে তা আর হয়নি বলে বিএনপির মিত্র দলগুলোর কয়েকজন জানিয়েছেন। কিন্তু এরপর ৪ ডিসেম্বর আরও ৩৬ আসনে দলীয় প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেন বিএনপি মহাসচিব।

এই দুই পর্বে ঘোষিত প্রার্থী তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মিত্র দল হিসেবে পরিচিত কয়েকটি দলের শীর্ষ নেতাদের আসনেও দলীয় প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে বিএনপি, যা ওইসব দলের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি করে।

লেবার পার্টির সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান ইরান বলেন, আমাদের সাথে আলোচনা না করে যেভাবে আমাদের প্রত্যাশিত আসনগুলোতে বিএনপি প্রার্থী দিয়েছে তাতে আমরা ক্ষুব্ধ ও ব্যথিত। ২০ বছর একসাথে চলেছি বিএনপির সাথে। আর ২০ দিনও চলতে চাই না। তারা আমাদের অবদান অস্বীকার করেছে। তিনি ঝালকাঠির একটি আসনে প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন।

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, দুর্দিনে এবং কঠিন সময়ে যেসব দল ঝুঁকি নিয়ে বিএনপির সাথে ছিল তাদের সাথে আলোচনা না করে বিএনপি ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। তিনি বলেন, বিএনপি প্রজ্ঞার পরিচয় দিতে না পারলে তার ভবিষ্যৎ ঝুঁকি হবে অনেক বড়। ছোট ভুল থেকে বড় বিপর্যয় আসতে পারে। সাইফুল হক ঢাকা৮ আসনে প্রার্থী হয়ে বিএনপির সমর্থন পাবেন আশা করেছিলেন। ওই আসনে বিএনপি দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য মীর্জা আব্বাসের নাম ঘোষণা করেছে।

তবে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে বিএনপির মিত্রদের মধ্যে যাদের প্রতি দলটির সমর্থন ইতোমধ্যে পরিষ্কার হয়ে গেছে তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ ও গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি। পার্থ ঢাকা১৭ আসনে বিএনপির সমর্থন পাচ্ছেন, কিন্তু নির্বাচন কমিশনের নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাকে তার দলীয় প্রতীক গরুর গাড়ি নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে হবে। তিনি বলেন, আমার মনে হয় নির্বাচন প্রস্তুতির প্রক্রিয়া চলছে। বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর সবাই মিলে আলোচনার মাধ্যমে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ আছে।

জোনায়েদ সাকি বলেন, বিগত দিনের যুগপৎ আন্দোলনের সমঝোতা কীভাবে নির্বাচনী সমঝোতায় প্রতিফলিত হবে সেটা নিয়ে কাজ করতে হবে। নির্বাচনী সমঝোতার প্রশ্নে আলোচনা শুরু হয়েও থেমে আছে। সেজন্যই সেটা নিয়ে ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে। আমার বিশ্বাস আলোচনার মাধ্যমে এগুলোর নিষ্পত্তি হবে।

তবে বিএনপির নির্বাচন প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত কয়েকজনের সাথে আলোচনা করে যে ধারণা পাওয়া গেছে তাতে সর্বোচ্চ ১০১২টি আসন সমমনা দলগুলোর নেতাদের ছেড়ে দিতে পারে দলটি। সেক্ষেত্রে ঢাকা১৭ আসনে আন্দালিব রহমান পার্থ, ঢাকা১৩ আসনে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের (এনডিএম) চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া৬ আসনে জোনায়েদ সাকি এবং বগুড়া২ আসনে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বিএনপির সমর্থন পাওয়া অনেকটাই নিশ্চিত। এর বাইরে পিরোজপুর, লক্ষ্মীপুর, কিশোরগঞ্জ, ঝিনাইদহ, চট্টগ্রাম ও পটুয়াখালীতে একটি করে আসনে সমমনা কয়েকটি দলের নেতারা বিএনপির সমর্থন পাবেন বলে আভাস দেওয়া হয়েছে।

দলীয় নেতাদের দেওয়া এসব তথ্য শেষ পর্যন্ত সঠিক হলে বিএনপির সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা জাসদ (রব), গণফোরাম, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি ও লেবার পার্টির নেতারা আদৌ নির্বাচনে বিএনপির সমর্থন পেয়ে প্রার্থী হতে পারেন কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে অনেকের মধ্যে। মাহমুদুর রহমান মান্না বৃহস্পতিবার এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, বিএনপি সমমনাদের সাথে আলোচনা না করে প্রার্থী ঘোষণা করায় জটিলতা তৈরি হয়েছে এবং জোটবদ্ধ নির্বাচন নিয়ে স্পষ্টতা কমে গেছে।

প্রথম দফায় প্রার্থী তালিকা ঘোষণার পর বিএনপির দিক থেকেই ইঙ্গিত ছিল যে, তাদের মিত্র ও সমমনা দলগুলোকে বেশ কিছু আসন ছেড়ে দেওয়া হতে পারে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই অবস্থান থেকে সরে এসেছে দলটি। দলটির নেতাদের সাথে কথা বলে ধারণা পাওয়া গেছে, মূলত দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করতে হবে বলে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা কিছু নেতাকে নির্বাচনে প্রার্থী করে ঝুঁকি নিতে চাইছে না দলের শীর্ষ মহল। তবে এর পরিবর্তে তাদের নিয়ে কীভাবে এগোনো যাবে তা নিয়ে কাজ করছে দলের একটি কমিটি।

হঠাৎ করে বেশি আসনে দলীয় প্রার্থী দেওয়ার নীতি নেওয়ার পিছনে নির্বাচনী কার্যক্রম শুরু করায় বিএনপির বিলম্বকেও দায়ী করছেন কোনো কোনো দলের নেতা। তাদের মতে, জামায়াত সমমনা আট দলকে নিয়ে অগ্রসর হওয়ায় এখন আর কোনো ঝুঁকি নিতে চাইছেন না বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। কেউ নিজ প্রতীকে জয়ী হয়ে আসতে না পারলেও যেন আসন হাতছাড়া না হয় সেই ভাবনা হয়তো কাজ করছে তাদের মধ্যে।

দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, নির্বাচনে জোট, প্রার্থী ও মনোনয়ন নিয়ে এসব সমস্যা খুবই স্বাভাবিক বিষয়। আমাদের একটি কমিটি এসব নিয়ে কাজ করছে। ধীরে ধীরে এসব সমস্যা কেটে যাবে। সবাইকে নিয়ে বিএনপি সামনের দিকে অগ্রসর হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাণিজ্যিক আদালত শীঘ্রই বাস্তবে রূপ নিচ্ছে
পরবর্তী নিবন্ধবিয়ের বৈঠকে হত্যার ঘটনায় মামলা, ঘাতক গ্রেপ্তার