এক কোষ থেকে বহুকোষী– গর্ভসঞ্চার মুহূর্তে শিশু থাকে কেবল মাত্র শূন্য দশমিক ১ মি.মি. আকারের এককোষী। বৃদ্ধিও বিকাশে উদ্দীপ্ত সূচনালগ্নের সেই কোষ পরবর্তীতে বিভাজিত হয়ে বহুকোষী হয়। মাতৃগর্ভের ভ্রুণাবস্তা পেরিয়ে শৈশব–কৈশোর অতিক্রম করে পুর্ণবয়স্ক রুপে যখন হাজির থাকে, তখন তার কোষ সমষ্টির সংখ্যা দাঁড়ায় ১০২৬।
শিশুর দৈহিক বৃদ্ধির সবচেয়ে শুরুত্বপূর্ণ সময় প্রারম্ভিক শৈশব, প্রথম পাঁচ বছর সময়কাল। যখন তার স্বাভাবিক বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণে রাখা অবশ্য কর্তব্য। যেমন–
১. শিশু জীবনের প্রথম ক’মাস অন্ততপক্ষে মাসে একবার করে ওজন মেপে দেখা। পরবর্তীতে ৫ বছর পর্যন্ত (বেশি বিরতিতে হলেও) ওজনের চার্ট পূরণ।
২. শিশুর প্রথম ৫ বছর বয়স পর্যন্ত (অন্তত বছরে ২ বার) দৈর্ঘ্য / উচ্চতা নির্ণয়।
৩. শিশুর প্রথম ৬ মাস যেন মাথায় বেড় বা আকার এর পরিমাপ নেওয়া হয়।
৪. যদি এসবের কোনো কিছুই করা সম্ভব না হয়, তবে নিদেনপক্ষে শিশুর ১ম ও ২য় বছরে ওজন মেপে দেখা। কেননা শিশু অসুস্থ হলে ওজন বৃদ্ধিতে প্রভাব পড়ে সবচেয়ে আগে।
প্রিস্কুল বয়সে (২ থেকে ৫ বছর বয়সে)-
- ভাষাজ্ঞান অর্জন ও মনমানসিকতার সামাজিকীকরণ।
- খাওয়ানোর সময় খিটখিটে মেজাজ ।
- বছরে প্রায় ২ কেজি (৪– ৫ পাউন্ড) ওজন, ও ৭– ৮ সে.মি. (২– ৩ ইঞ্চি) উচ্চতা প্রাপ্তি ।
- দৈহিক বৃদ্ধির সাথে প্রজনন অঙ্গের বৃদ্ধিসাধন ।
- ৪ বছরের আগে কন্যাসন্তান ও ৫ বছর বয়স পুরানোর পূর্বে পুত্রসন্তানে ‘বিছানা ভেজানো’ স্বাভাবিক বলে গণ্য করা হয়। এরপর হতে শিশু প্রস্রাব– পায়খানার নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্ষম থাকে।
- বাক্শক্তি ও ভাষাজ্ঞান নৈপুণ্য বিস্ময়করভাবে এগিয়ে চলে। পূর্বের ৫০– ১০০ শব্দ ক্ষমতা এখন ২০০০ এর অধিক ছাড়িয়ে যায়।
- বয়স বৃদ্ধির সাথে তার বাক্য–নির্মিতি ক্ষমতা অর্জিত হয়। যেমন ২ বছর বয়সে দুই শব্দের, তিন বছরে তিন শব্দের, ৪ বছরে চার শব্দের বাক্য গঠনে সক্ষমতা।
- ৪ বছর বয়সে বেশির ভাগ শিশু ৪ পর্যন্ত গুণতে পারে এবং অতীতকাল ব্যবহার করে কথা বলতে সক্ষম। ৫ বছর বয়সে শিশু ভবিষ্যৎকাল ব্যবহারপূর্বক বাক্য তৈরি করতে পারে।
শৈশবে (৬ থেকে ১১ বছর বয়স)-
- ক্রমশঃ মা–বাবা হতে পৃথক থেকে স্বাধীন সত্তায় অধিষ্ঠিত হয়। শিক্ষক, বন্ধুবান্ধব ও অন্যান্য বয়স্কজনের কাছে নিজের গ্রহণযোগ্যতা পেতে উৎসুক থাকে।
- হঠাৎ হঠাৎ সে দ্রুতগতিতে বেড়ে ওঠে, বছরে প্রায় ৩–৩.৫ কেজি (৬.৬ –৭.৭ পাউন্ড) ওজন, ও ৬–৭ সে. মি. (২.৪–২.৮ ইঞ্চি) উচ্চতা নিয়ে।
- পুরো সময়টাতে তার মাথার বেড় বাড়ে ২ সে. মি. এর মতো।
- সব ‘দুধে দাঁত’ পড়ে যায় ও বছরে ৪টা করে স্থায়ী দাঁত গজায়। ৯ বছরে পৌঁছে তার ১২ টা স্থায়ী দাঁত ওঠে।
- টনসিল ও এন্ডিনয়্যড গ্রন্থিদ্বয় সফীত থাকে, যা স্বাভাবিক।
- এ বয়সে তার জন্য সপ্তাহে তিনদিন ফিজিক্যাল এডুকেশন ক্লাশ থাকা উচিত। তাকে দৈনিক অন্তত ১ ঘণ্টা কায়িকশ্রমে যুক্ত করানো প্রয়োজন।
বয়ঃসন্ধিতে –
অ্যাডালিসেন্স, বা প্রাক্যৌবনকাল বয়ঃসন্ধি সাধারণভাবে শুরু হয় ১১– ১২ বছর বয়সে। আর সমাপন ঘটে ১৮ থেকে ২১ বছরের মধ্যে। লকলকিয়ে বেড়ে ওঠে তার শরীর। মানসিক সামাজিক ভুবনে ঘটে প্রচুর পরিবর্তন।
ফিজিক্যাল গ্রোথ: বয়ঃসন্ধিকাল পর্বে সে প্রায় দ্বিগুণ ওজন লাভ করে। উচ্চতা বৃদ্ধি পায় প্রায় ১৫– ২০ শতাংশ। দেহের সব প্রধান অঙ্গ আকারে প্রায় দ্বিগুণ হয়। ব্যতিক্রম টিস্যু–গ্ল্যান্ড, যা আকারে ছোট হতে থাকে। দেহ মাংসপেশী আকার ও শক্তি– দুটোতেই বাড়ে। ছেলেদের মধ্যে এটি বেশি রকমের বাড়ে। এ সময়টাতে ছেলে–মেয়ে উভয়ে দ্রুতলয়ে উচ্চতায় বাড়ে।
- কন্যা সন্তানে ঋতুচক্র শুরু হবার ০৬ মাস পূর্বে বছরে প্রায় ৮– ৯ সে.মি. উচ্চতা যুক্ত হয়।
- ছেলে সন্তানে একটু দেরিতে উচ্চতার বাড়ন শুরু হয়, যার হার বছরে ৯–১০ সে. মি.।
- বয়ঃসন্ধির সূচনা মেয়েদের মধ্যে ছেলেদের তুলনায় প্রায় বছর দুয়েক আগে সূচীত হয়।
- সাড়ে ১১ থেকে ১২ বছরের মধ্যে একজন মেয়ে তার উচ্চতা বৃদ্ধির সর্বোচ্চ গতি পায়। ছেলেদের তা ঘটে ১৩ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে।
- বয়ঃসন্ধিকালে এই বাড়ন সময়কাল মোটামুটি ২– ৪ বছরের মতো। তবে ছেলেদের ক্ষেত্রে মেয়েদের তুলনায় তা দীর্ঘসময় ধরে হতে পারে।
- ১১ বছরে পৌঁছে একজন মেয়ে ও ১২ বছরে পৌঁছে একজন ছেলে তার সম্পূর্ণ উচ্চতাপ্রাপ্তির প্রায় ৮৩– ৮৯ শতাংশ পর্যন্ত অর্জন করে।
- পরের সময়কালে একজন মেয়ে ১৮– ২৩ সেন্টিমিটার ও একজন ছেলে ২৫– ৩০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত উচ্চতায় বাড়তে পারে।
- ঋতুস্রাব শুরু হয়ে যাবার পর একজন মেয়ে সচরাচরভাবে ৫– ৭.৫ সেন্টিমিটারের বেশি উচ্চতা যোগ করতে পারে না।
শিশুর ওজন নির্ণয়ের পদ্ধতি: (ডিজিটাল–স্কেল)-
- পোশাক ছাড়া খালি গায়ে ওজন নিতে হয়।
- ওজন নেওয়ার সময় শিশু যেন অন্য কোথাও হাত দিয়ে কিছু ধরে না থাকে।
- পায়ে জুতো থাকবে না।
উচ্চতা নির্ণয়ের পদ্ধতি–
(২ বছর ওপরের বয়সে উচ্চতা নির্ণয়ের ইন্সট্রুমেন্টের নাম স্ট্যাডিওমিটার, এতে ৬ ফুট পর্যন্ত উচ্চতা মাপা যায়)
- মাপার সময় শিশুর পা দুটো যুক্ত অবস্থায় থাকবে।
- জুতো ছাড়া খালি পায়ে দাঁড়াবে।
- পায়ের গোড়ালি পেছনে লাগিয়ে।
- পা সোজা থাকবে।
- পশ্চাদদেশ বোর্ডের সাথে লাগানো থাকবে।
- হাত ঝোলানো অবস্থায় থাকবে।
- চোখের কোণা, কানের ট্রেগাস একই লাইনে থাকবে (ফ্র্যাঙ্কফোর্ট লাইন)।
লেখক : অধ্যাপক, সাবেক বিভাগীয় প্রধান, শিশুস্বাস্থ্য বিভাগ,
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল।