‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে’। কোথায় সেই সন্তান? মা–বাবা তাকে কাছে পাচ্ছেন? আবার সন্তানকে দেওয়ার মতো সময় কোথায় তাদের? এ দুটো প্রশ্নের সমাধান হচ্ছে না বলেই সন্তানরা হয়ে পড়ছে অচেনা। বাড়ছে সন্তানের সাথে দূরত্ব। ভুগতে হচ্ছে সমাজকে। প্রায় প্রতিটি অপরাধে আজ উঠে আসছে অল্পবয়সী কিশোরের নাম। জন্ম নিচ্ছে একের পর এক কিশোর গ্যাং। আবার তাদের দাবি অনুযায়ী যে চাহিদা মা–বাবা মেটাতে পারছে না বা চাইছে না, তা মিটিয়ে দিচ্ছে কথিত বড় ভাইয়েরা। এর ফলে পরিবারের সদস্যদের তুলনায় কথিত ‘বড় ভাইয়েরাই তাদের আপন হয়ে উঠছে।
এ প্রসঙ্গে সিএমপি কমিশনার কৃষ্ণ পদ রায় বলেন, কিশোর গ্যাং এখন সামাজিক সমস্যায় রূপ নিয়েছে। অনাবিল আবেগ ও কল্পনায় বিভোর কিশোর বয়স। যুক্তি ও বাস্তবতা আবেগের কাছে হেরে যায়। একদিকে প্রযুক্তির অপব্যবহার, সাথে মাদকের সহজলভ্যতায় তারা হয়ে পড়ছে একরোখা, বেপরোয়া। ক্রোধের বশবর্তী হয়ে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে জীবন নিয়ে তারা ছিনিমিনি খেলছে। কখনো নিজেই নিজেকে ঠেলে দিচ্ছে মৃত্যুর দিকে, কখনো আবার প্রতিপক্ষকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়ে বা তাকে জন্মের মতো শায়েস্তা করতে গিয়ে নানা পন্থা বেছে নিচ্ছে। তৈরি করছে কিশোর গ্যাং।
চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময় সভায় সিএমপি কমিশনার বলেছিলেন, সামাজিকীকরণ ও সাংস্কৃতিকীকরণের সমস্যা থেকেই সমাজে নানা অসঙ্গতি দেখা যায়। কিশোরদের অপরাধে জড়ানোর পেছনে একক কোনো কারণ নেই। এর সঙ্গে দুষ্টু বন্ধুদের প্রভাব, পারিপার্শ্বিক অবস্থা, শিশুদের সঠিক পরিচর্যার অভাব, মৌলিক চাহিদা পূরণ না হওয়া, স্যাটেলাইট চ্যানেল, ইন্টারনেটের অপব্যবহারসহ বেশ কিছু কারণ রয়েছে। অতি উচ্চাকাক্সক্ষা কিশোর বয়সের জন্য ক্ষতিকর জানিয়ে সন্তানকে বোঝানোর জন্য বাবা–মাকে পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। তিনি বলেন, মা–বাবাকে এখনই সচেতন হতে হবে। পারিবারিক অনুশাসন বাড়াতে হবে। সামাজিক অনুশাসন পুনরুদ্ধার করতে হবে।
সরেজমিনে নগরীর জামালখান, চেরাগী পাহাড়, সিঁড়ির গোড়া, আন্দরকিল্লাসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, কিশোর গ্যাংয়ের একাধিক গ্রুপ সক্রিয়। এসব গ্রুপের সদস্যরা এলাকার বিভিন্ন দোকান ও ফুটপাত থেকে নিয়মিত চাঁদাবাজিতে জড়িত। তাদের উৎপাতে অতিষ্ঠ এলাকার বাসিন্দা ও দোকানদাররা। ভয়ে কেউ মুখ খুলতে পারে না।
গত শুক্রবার খুলশী থানাধীন পাহাড়তলী আমবাগান এলাকায় তুচ্ছ কারণে খুন হয় এক এইচএসসি পরীক্ষার্থী। তুচ্ছ ঘটনায় ১৬ থেকে ২১ বছর বয়সী দুটি গ্রুপের সংঘর্ষে প্রতিপক্ষের ছুরিকাঘাতে খুন হয় সে। আহত হয় তার এক বন্ধু।
খুলশী থানার ওসি রুবেল হাওলাদার আজাদীকে বলেন, এ ঘটনায় জড়িত সাতজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাদের মধ্যে তিনজনই ১৬ বছরের কিশোর। এলাকা সূত্রে জানা গেছে, তারা সবাই এলাকাভিত্তিক গ্রুপিং করে; মানে এলাকাভিত্তিক চলাফেরা করে, আড্ডা দেয়। কেউ কেউ বিভিন্ন কার্যক্রমেও যোগ দেয়। তারা কেউ নির্ধারিত পেশায় জড়িত নয়। তবে দুই–একজন বলছে তারা লেখাপড়া করে।
৮ মে পাহাড়তলী বিটাক মোড়ে বান্ধবীকে ইভটিজিং করাকে কেন্দ্র করে দুই কিশোর গ্যাংয়ের সংঘর্ষে দুজন নিহত হয়। পরে পুলিশ জানতে পারে, পাহাড়তলীতে জোড়া খুনের ঘটনায় অংশ নিয়েছিল ১০–১২ জন। তাদের সবার বয়স ১৬ থেকে ২৪ বছরের মধ্যে। তাদের মদদ দেন ইয়াছিন নামে এক শ্রমিকলীগ নেতা। সাগরিকা শিল্প এলাকায় দাঙ্গা–হাঙ্গামা, ছিনতাই, জমি দখল, মাস্তানি, অস্ত্রবাজি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ নানা অপকর্মে জড়িত এই কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা।
এভাবে প্রতিদিন কোথাও না কোথাও গ্যাং সদস্যরা নানা অঘটন ঘটাচ্ছে। খুন, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, অপহরণসহ এমন কোনো অপকর্ম নেই যা তারা করছে না। আইনশৃক্সখলা বাহিনীর নানামুখী তৎপরতার পরও নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না কিশোর অপরাধীদের।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের তথ্যমতে, গত পাঁচ বছরে কিশোর গ্যাংয়ের হাতে অন্তত অর্ধশত খুনের ঘটনা ঘটেছে। তাদের দৌরাত্ম্য কমাতে চার বছর আগে তালিকা করা হলেও সেটি আর হালনাগাদ করা হয়নি। ফলে দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে পাড়া–মহল্লার উঠতি কিশোররা। নগরীর ৪১টি ওয়ার্ডের ৩০০ স্পটে উঠতি বয়সী কিশোররা বড়ভাইদের মাধ্যমে গ্যাংয়ে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে।
নগরীতে ছিনতাইয়ের কবলে পড়েছেন এমন কয়েকজন ব্যক্তি জানান, তাদের টাকা–পয়সা ছিনতাইকারীদের বেশিরভাগের বয়স ১৪ থেকে ১৮ বছর। সন্ধ্যার পরে নগরীর স্টেশন রোড, বিআরটিসি মোড়, কদমতলী, চকবাজার, মেডিকেল হোস্টেল, শিল্পকলা একাডেমি, সিআরবি, খুলশী, ফয়’স লেক, ডেবারপার, চান্দগাঁও শমসের পাড়া, ফরিদের পাড়া, আগ্রাবাদ সিজিএস কলোনি, সিডিএ, ছোটপুল, হালিশহর, বন্দর কলোনি ও পতেঙ্গার বেশ কয়েকটি এলাকায় মাদক বেচাকেনা, মোটরসাইকেল ও সাইকেল ছিনতাই করছে তারা। গান–বাজনা, খেলার মাঠ, ডান্স ও ডিজে পার্টি, বিভিন্ন ক্লাবের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রাখতে চায় এসব কিশোর গ্যাং।