আমাদের ঘাড়ে চেপে বসা বিশাল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নিয়ে এর আগেও একাধিকবার লিখেছি। আবারও সেই একই বিষয় নিয়ে লিখতে হচ্ছে। কারণ অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে ১১ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে ফেরত নিতে মোটেই আগ্রহী নয় তাদের নিজ দেশ মিয়ানমার। আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ও মিয়ানমারের উপর কোনো চাপ সৃষ্টি না করে বারংবার বাংলাদেশের উপর চাপ সৃষ্টি করে চলছে, রোহিঙ্গাদের আদর আপ্যায়নে যেন কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি না হয়। জাতিসংঘ জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যান (জেআরপি) এর অধীনে বাংলাদেশে আশ্রয়গ্রহণকারী রোহিঙ্গাদের জন্য যে সাহায্য সহযোগিতা আসে তার ৭০ ভাগই খরচ হয়ে যায় জাতিসংঘের শরনার্থী বিষয়ক হাই কমিশনের (ইউএনএইচসিআর) হয়ে যারা কাজ করছেন তাদের পেছনে।
জেআরপির নিজস্ব রিপোর্টের আলোকে এই তথ্য সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। রোহিঙ্গাদের জন্য দাতাদের তহবিল বাংলাদেশ সরকার পায় না। তা জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআরের মাধ্যমে আসে, তারাই খরচ করে। কোথায় কত খরচ হল তার কোনো জবাবদিহিতার সুযোগ নেই। হিসেব চাওয়ার কোনো সুযোগ আমাদের নেই। তাদের দেয়া হিসেবেই আমরা দেখতে পাই রোহিঙ্গারা প্রাপ্ত সাহায্যের সামান্যই পাচ্ছে। আবার ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয় বাসিন্দাদের যা সহায়তা পাওয়ার কথা তার কিছুই পাচ্ছে না।
জেআরপির প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী ২০১৭ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য প্রয়োজনীয় তহবিল নির্ধারণ করা হয়েছিল ৪৩০৬ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু পাওয়া গেছে ২৯৮৪ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ পাঁচ বছরে প্রয়োজন ছিল ৩ লাখ ৬৬ হাজার ১০ কোটি টাকা। বিপরীতে পাওয়া গেছে ২ লাখ ৫৩ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ৮৫ টাকা হিসেবে)। যা চাহিদার ৬৭ দশমিক ৮০ শতাংশ। প্রাপ্ত এই তহবিলের ৭০ ভাগ অর্থাৎ ১লাখ ৭৭ হাজার ৫৪৮ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে কক্সবাজারে অবস্থানরত জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার কর্মী ও তাদের হয়ে যারা কাজ করছে তাদের পেছনে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য খরচ করা হয়েছে প্রাপ্ত তহবিলের মাত্র ৩০ ভাগ অর্থাৎ ৭৬ হাজার ৯২ কোটি টাকা। শরণার্থীদের কারণে উখিয়া-টেকনাফের স্থানীয় বাসিন্দারা দারুনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জাতিসংঘের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রাপ্ত তহবিলের ২৫ ভাগ স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য ব্যয় করার কথা থাকলেও তা করা হয়নি। জাতিসংঘের মাধ্যমে জেআরপি তহবিল চাহিদার তুলনায় পাওয়া যায় অনেক কম। যা মেলে তারও সিংহভাগ শরণার্থী সংস্থা কর্মীদের পেছনে ব্যয় হচ্ছে। চাহিদার বাকিটা পূরণ করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। যা আমাদের অর্থনীতির উপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করছে।
রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নিয়ে যাওয়ার জন্য স্থাপনা তৈরিতে বাংলাদেশ সরকার ৩৫০ কোটি টাকা ব্যয় করলেও শুরু থেকেই জাতিসংঘ তার বিরোধিতা করে আসছিল। কারণটা সহজেই অনুমেয়। যারা শরণার্থীদের নিয়ে কাজ করছেন তারা কক্সবাজারে ফাইভ স্টার হোটেলে থাকা-খাওয়াসহ বিলাসবহুল জীবন-যাপন ছেড়ে নির্জন উপকূলে যেতে চান না। রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরে যাক তা তারা মন থেকে চাইবেও না। সমস্যা জিইয়ে থাকলেই যে তাদের পোয়াবারো। এদিকে জেআরপির তহবিল প্রাপ্তি প্রয়োজনের তুলনায় কমে আসছে। ইউক্রেন শরণার্থীদের কারণে ২০২২ সালে এই তহবিল যে আরও কমবে তার আভাস এখনই মিলছে।
গত ৩০ মার্চ জেনেভায় জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার সাথে অংশীদার সংস্থাগুলোর বৈঠকে ২০২২ সালে রোহিঙ্গাদের মানবিক সঙ্কট মোকানেলায় ৮৮১ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের তহবিল চাওয়া হয়েছে। চলতি বছরে এ পর্যন্ত মিলেছে সামান্য পরিমান তহবিল। জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক হাই কমিশনের (ইউএনএইচসিআর) প্রধান ফিলিপো গ্রান্ডির উপস্থিতিতে বৈঠকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম ভার্চুয়ালি অংশ নেন। সেখানে তিনি আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের কাছে আহবান জানান, বাংলাদেশকে বিশাল বোঝা থেকে মুক্তি দিতে এবং মানবিক সঙ্কটে সহায়তায় তাদের দায়িত্ব থেকে পিছপা না হতে। তিনি বলেছেন, রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে মিয়ানমার এখনও রাজনৈতিক সদিচ্ছা দেখাতে পারেনি। রাখাইনে অনুকূল পরিবেশ ও আত্মবিশ্বাস তৈরি না হলে বাস্তচ্যুতরা স্বেচ্ছায় তাদের প্রত্যাবর্তন বেছে নেবে বলে আশা করা যায় না।
মিয়ানমার যখন রাখাইন (আরাকান) থেকে রোহিঙ্গাদের জোরপূর্বক বিতারণ করে তখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অং সাং সূচির দল। নোবেল জয়ী অং সাং সূচির একসময় খুবই অনুরক্ত ছিলাম। বিশ্ব দরবারে তাঁর স্থান অনেক উঁচুতে ছিল। কিন্তু সেই সূচি মিয়ানমারে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ট হয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকতে আপসের পথ বেছে নিলেন। সামরিক বাহিনীকে না চটিয়ে ক্ষমতায় থাকতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর বর্বরোচিত জুলুম- নির্যাতনের তিনি সামান্য প্রতিবাদ তো করলেন-ই না, বরং আন্তর্জাতিক আদালতে তিনি নিজে গিয়ে সাফাই সাক্ষ্য দিলেন তেমন কিছু হয়নি বলে। অথচ শেষ রক্ষা হল না। মিয়ানমারের সামরিক জান্তা তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে রেখে এখন নানা অভিযোগে বিচারের সম্মুখীন করছে। সামরিক জান্তা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় ব্যস্ত। তাদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ-বিদ্রোহ দেশটির নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ছে। এমন অবস্থায় তারা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন বিষয়ে মাঝে মধ্যে নিচু লয়ে আগ্রহ প্রকাশ করছে। রোহিঙ্গা শব্দটিই তারা এখন উচ্চারণ করে না। ১১ লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে প্রথম পর্যায়ে মাত্র ৭০০ জনকে তারা বাছাই করেছে তালিকা থেকে। তাও সেই প্রত্যাবাসন কখন শুরু হবে তা অনিশ্চিত। যদি খুব সহসা এই গতিতে শুরু হবে এমনটি ধরেও নিই- তাহলে ১১ লাখ শরণার্থীর প্রত্যাবাসন আগামী এক’শ বছরেও শেষ হবে না।
আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের কাছ থেকে মিয়ানমারের উপর এই দীর্ঘ সময়ে কোনো রকম চাপ কার্যত সৃষ্টি করা হয়নি। এ নিয়ে যা কথাবার্তা কিছুটা হত তা এখন চাপা পড়ে গেছে ইউক্রেন শরণার্থী নিয়ে ডামাডোলের আড়ালে।
ইউক্রেনের এক কোটি লোক বাস্তুচ্যুত এবং এদের ৪০ লাখের অধিক প্রতিবেশী অন্যান্য দেশে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছে। জাতিসংঘ এই তথ্য প্রকাশ করে তাদের মানবিক সহায়তায় আরও বেশি উদ্যোগী হতে দাতা দেশসমূহের প্রতি আহবান জানিয়েছে। দেশটিতে রাশিয়ার আগ্রাসনের পর থেকে ইউক্রেনের পাশে দাঁড়িয়েছে ইউরোপের অন্য সবগুলো দেশ। ন্যাটোর পাইলট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ নিয়ে খুবই খোশ মেজাজে রয়েছে। সুইজারল্যান্ডসহ আরও অনেক শান্তিপ্রিয় দেশ যারা কখনো যুদ্ধাস্ত্র কেনাকাটার দিকে মনযোগই দেয়নি তারাও এখন বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র কিনছে। আমেরিকার অস্ত্র বিক্রির পরিমান বেড়ে গেছে। তাদের উসকানিতেই ইউক্রেন- রাশিয়া যুদ্ধের সূচনা বলে বিভিন্ন তরফে দাবি করা হলেও এ নিয়ে তাদের কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। ইউক্রেন শরণার্থীরা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যে মনোযোগ পাচ্ছে তার সামান্যতমও রোহিঙ্গাদের জন্য হয়নি এবং হচ্ছে না। এই বোঝা নিয়ে আমাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার দিকে আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের নজর তেমন আছে বলে গত পাঁচ বছরে লক্ষ্য করা যায়নি। জেআরপির মাধ্যমে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ সহায়তা আসছে তেমনটাই সাধারণ মানুষের ধারণা। কিন্তু কোনো সাহায্যই বাংলাদেশ সরকারের কাছে আসে না। আসে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার মাধ্যমে। জেআরপির রিপোর্টেই পরিষ্কার হওয়া যায় প্রাপ্ত সাহায্যের ৭০ শতাংশই খরচ হয়ে যায় শরণার্থী সংস্থার কর্মীদের জন্য। ৩০ ভাগ রোহিঙ্গার ভাগে জুটলেও অনেক ব্যয় চাপছে আমাদের ঘাড়ে। রোহিঙ্গাদের কারণে পরিবেশ- প্রকৃতির ক্ষতির পাশাপাশি বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতিও আমাদের বহন করতে হচ্ছে। এই ভার আমরা কতদিন বহন করতে পারব- কতদিন বইতে হবে এই বিরাট বোঝা সেটিই আজ বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।
লেখক : সাংবাদিক-প্রাবন্ধিক