প্রাপ্ত বয়স্কদের প্রতি ১১ জনে একজন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত

বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস আজ

আজাদী প্রতিবেদন | শনিবার , ১৪ নভেম্বর, ২০২০ at ৯:২৭ পূর্বাহ্ণ

ডায়াবেটিস এবং ডায়াবেটিস জনিত রোগে বিশ্বে প্রতি বছর ১০ লাখেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। এছাড়া ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ রোগীর পা কেটে ফেলার অন্যতম কারণও ডায়াবেটিস। ফলে রোগটি চিহ্নিত হয়েছে একটি নীরব ঘাতক ব্যাধি হিসেবে। আর বিশ্বব্যাপী এই রোগের ভীতিকর প্রভাবকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ডায়াবেটিসের বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছে জাতিসংঘ। যক্ষা ও এইচআইভি/এইডস সহ নানা সংক্রামক রোগের পাশাপাশি কোনো অসংক্রামক ব্যাধিকে প্রথমবারের মতো বিশ্বজনীন স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে মারাত্মক হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সেটি হলো ডায়াবেটিস।
আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের তথ্য মতে- ২০১৯ সালে প্রতি ১১ জন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের একজন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। হিসেবে বিশ্বে ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা ৪২৫ মিলিয়ন। তবে ২০৪৫ সালে ৪৮ শতাংশ বেড়ে আক্রান্তের এই সংখ্যা ৬২৯ মিলিয়নে পৌঁছবে বলে আশঙ্কা সংস্থাটির। সংস্থাটি বলছে- পৃথিবীর মোট ডায়াবেটিস রোগীর ৮৭ শতাংশই উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোর বাসিন্দা। এছাড়া গড়ে প্রতি ৬টি নবজাতকের ১ জন মায়ের ডায়াবেটিস দ্বারা আক্রান্ত।
তবে আতংকের বিষয় যে, প্রাপ্ত বয়স্ক প্রতি দুজন মানুষের একজন জানেনইনা তিনি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। এর পিছনে সচেতনতার অভাবকেই দেখছেন চিকিৎসকরা।
প্রতি ৭ জন গর্ভবতী নারীর ১ জনের শরীরে ডায়াবেটিস ধরা পড়ছে বলে জানান চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতালের প্রধান পুষ্টি কর্মকর্তা হাসিনা আক্তার লিপি। উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, এটি গভীর আতংকের বিষয়। কারণ, নারীর গর্ভধারণের আগে বা গর্ভকালীন সময়ে সচরাচর ডায়াবেটিস পরীক্ষা করানো হয় না। গর্ভবতী নারীর শরীরে ডায়াবেটিস থাকলে গর্ভের শিশুটিও ডায়াবেটিসে আক্রান্তের ঝুঁকি থাকে। অথচ, প্রাথমিকভাবে ডায়াবেটিস ধরা পড়লে চিকিৎসার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। কিন্তু ধরা না পড়লে মায়ের পাশাপাশি শিশুর যথেষ্ট ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। তাই সচেতন হওয়ার পাশাপাশি যত দ্রুত সম্ভব শরীরে ডায়বেটিস রয়েছে কিনা তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। আর আগে বয়স্করা ডায়াবেটিসে বেশি আক্রান্ত হলেও বর্তমানে ৩০ থেকে ৪৫ বছর বয়সীদের শরীরে ডায়াবেটিস বেশি ধরা পড়ছে বলে জানান হাসিনা আক্তার লিপি। বেশি বেশি ধূমপান, ত্রুটিযুক্ত খাদ্যাভাস ও শারীরিক পরিশ্রম না করার কারণেই তরুণরা এ রোগে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন বলে মনে করেন তিনি।
চিকিৎসকরা বলছেন- বাংলাদেশে বর্তমানে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৯০ লাখ। প্রতিবছর এ সংখ্যা বাড়ছেই। তবে শঙ্কার বিষয় হলো প্রতি দু’জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মধ্যে একজন এখনও জানতে পারছেন না যে তাঁর ডায়াবেটিস রয়েছে। রোগ শনাক্ত করা গুরুত্বপূর্ণ। শনাক্ত করা না থাকলে ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়। বর্তমানে সারাবিশ্বে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান ১০ম স্থানে। এরই মাঝে আজ (১৪ নভেম্বর) পালিত হচ্ছে বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস। ‘ডায়াবেটিস সেবায় পার্থক্য গড়ে দেন নার্সিংয়ে’ প্রতিপাদ্য নিয়ে চট্টগ্রামেও পালিত হচ্ছে দিবসটি।
বিশ্বজুড়ে ডায়াবেটিস রোগ ব্যাপক হারে বেড়ে যাওয়ায়, বিশ্ব ডায়াবেটিস ফেডারেশন (আইডিএফ) ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৯১ সালে ১৪ নভেম্বরকে ডায়াবেটিস দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। এদিন বিজ্ঞানী ফ্রেডরিক বেনটিং জন্ম নিয়েছিলেন এবং তিনি বিজ্ঞানী চার্লস বেস্টের সঙ্গে একত্রে ইনসুলিন আবিষ্কার করেছিলেন।
দিবসটি উপলক্ষে চট্টগ্রামেও নেয়া হয়েছে নানা কর্মসূচি। চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক সমিতির উদ্যোগে নগরীর ডায়াবেটিক জেনারেল হাসপাতাল প্রাঙ্গণে দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি পালন করা হবে। কর্মসূচির মধ্যে বর্ণাঢ্য র‌্যালি ও সেমিনারের পাশাপাশি রোগী ও ডাক্তারদের মাঝে থাকছে উন্মুক্ত প্রশ্নোত্তরের পর্ব। তাছাড়া বিভিন্ন ডায়াবেটিক সেন্টারে ফ্রি ডায়াবেটিক স্ক্রিনিং কর্মসূচিও রয়েছে দিবসটি উপলক্ষে।
ডায়াবেটিসের জন্য চট্টগ্রামের একমাত্র বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতাল দীর্ঘ দিন ধরে ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীদের সেবা দিয়ে আসছে। হাপাতালে প্রাপ্ত বয়স্ক (টাইপ-২) নিবন্ধিত (নিয়মিত চিকিৎসা সেবাগ্রহণকারী) রোগীর সংখ্যা বর্তমানে দুই লাখ ছাড়িয়েছে বলে হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে। এছাড়া অপ্রাপ্ত বয়স্ক টাইপ-১ (১- ১৮বছর) রোগীর সংখ্যাও কয়েক হাজার। আক্রান্ত রোগীদের সেবা দিতে চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক জেনারেল হাসপাতাল শহরের বিভিন্ন এলাকার পাশাপাশি গ্রামে-গঞ্জেও শাখা স্থাপন করছে। এছাড়া খুলশীস্থ হাসপাতালে আউটডোর এবং ইনডোর দুই বিভাগেই সেবা প্রদান তো রয়েছেই।
খুলশীস্থ ডায়াবেটিক হাসপাতাল ছাড়াও নগরীর এনায়েত বাজার, বন্দর টিলা, কর্নেলহাট মোস্তফা হাকিম ও অক্সিজেন এলাকায় (মোট চারটি পয়েন্টে) সাব সেন্টার চালু করেছে ডায়াবেটিক সমিতি। চারটি সাব সেন্টারসহ নগরীর মোট ৫টি চিকিৎসা কেন্দ্রে আড়াই লাখেরও বেশি ডায়াবেটিস রোগী নিয়মিত চিকিৎসা নেন বলে ডায়াবেটিক হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা জানান।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডায়াবেটিস মূলতঃ একটি বিপাকজনিত রোগ। ইনসুলিন নামক হরমোনের অভাবে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যায়। যা দেহে জটিলতা সৃষ্টি করে। এছাড়া, শারীরিক পরিশ্রমের অভাব, খাওয়া- দাওয়ার ব্যাপক পরিবর্তন, স্থুলতার পাশাপাশি বার্ধক্যও ডায়াবেটিসের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ডায়াবেটিস সারা জীবনের রোগ। একারণে এই রোগের ব্যয়টাও একটু বেশি। ডায়াবেটিস প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জাহাঙ্গীর চৌধুরী। আর প্রতিকার হিসেবে জীবন যাত্রার পরিবর্তন, খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন, ব্যায়াম ও ওজন নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বারোপ করে চিকিৎসকরা বলছেন- শুধু সচেতন হলে এবং কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করলে এ রোগ ৭০ ভাগ প্রতিরোধ সম্ভব।
ডায়াবেটিস আক্রান্তের নেপথ্যে কায়িক পরিশ্রম না করা (যেমন সামান্য দূরত্বে রিকশা বা যানবাহন নেয়া), মোটা হওয়া, ওজন নিয়ন্ত্রণে না রাখা. ফাস্ট ফুড খাওয়া ও কোমল পানীয় পান করাকেই অন্যতম কারণ হিসেবে বলছেন চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জাহাঙ্গীর চৌধুরী। এর জন্য সচেতনতা জরুরি জানিয়ে জাহাঙ্গীর চৌধুরী বলেন, সচেতনতার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ না করলে রোগীর কিডনি, চোখ, হার্ট, যৌন দুর্বলতা, দাঁত, চামড়া, পা ইত্যাদি মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হতে পারে। ফলে শারীরিক জটিলতার পাশাপাশি অন্ধত্ব ও পঙ্গুত্ব বরণ করা ছাড়াও অকালে মৃত্যুবরণ করতে হবে।
ডায়াবেটিস জটিলতার কারণে অনেক সময় পায়ে পচনশীল রোগ হয়ে পা কেটে ফেলার মতো ভয়ংকর অবস্থারও সৃষ্টি হতে পারে। তবে ডায়াবেটিস চিকিৎসায় পাঁচটি নিয়ম মেনে চললে বেশ কিছু জটিলতা (অন্ধত্ব, হার্ট এটাক, কিডনি বিকল হওয়া এবং পঙ্গুত্ব) রোধ করা সম্ভব বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন- খাদ্য ব্যবস্থা অর্থাৎ সুষম খাদ্য ব্যবস্থায় অভ্যস্ত হওয়া, শরীরের ওজন আদর্শ ওজনে রাখা অর্থাৎ বি.এম.আই ২৫ এর মধ্যে রাখা, ডায়াবেটিস শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া, নিয়মিত ব্যায়াম করা এবং ওষুধ-ইনসুলিন ও নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শ মতো চলা। এই নিয়মগুলো মেনে চললে ডায়াবেটিস রোগীদের বড় ধরণের জটিলতায় পড়ার আশঙ্কা কম বলে দাবি চিকিৎসকদের।
চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতালের সাবেক পরিচালক ডা. নওশাদ আহমেদ খান জানান, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাঙামাটি ও ফেনী জেলার প্রায় ১৮ হাজার মানুষের ডায়াবেটিস স্ক্রিনিং করেছেন তিনি। এর মধ্যে অপ্রাপ্ত বয়স্ক টাইপ-১ (১- ১৮ বছর বয়সী) ডায়াবেটিসে আক্রান্তের হার ৫-৭ শতাংশ। আর প্রাপ্ত বয়স্কদের প্রায় ৪০ শতাংশ জানেনই না তাঁরা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। এটি খুবই ভয়ানক পরিস্থিতি বলে মনে করেন ডা. নওশাদ আহমেদ। এর কারণ হিসেবে তিনি বলছেন, প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা সম্ভব হলে চিকিৎসায় ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ রাখা যায়। কিন্তু শনাক্তই যদি না হয়, তবে ডায়াবেটিসের কারণে শরীরের বিভিন্ন অংশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যার মধ্যে চোখ, কিডনি ও হার্ট অন্যতম। আর নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারলে এই ডায়াবেটিস মানুষকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ধাবিত করে। তাই নীরব ঘাতক হিসেবে পরিচিত এই ডায়াবেটিস থেকে বাঁচতে হলে এখনই সচেতন হওয়া জরুরি বলছেন ডা. নওশাদ আহমেদ খান।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅধ্যক্ষ মোহাম্মদ হোসেন খানের ৭ম মৃত্যুবার্ষিকী আজ
পরবর্তী নিবন্ধযুবকরা জাতির মূল্যবান সম্পদ