মাঝে মধ্যে কিছু খবর শুনলে গর্বে বুকটা ফুলে ওঠে। তেমনি একটি খবর হলো সাফ মহিলা ফুটবলে বাংলাদেশের চ্যাম্পিয়ন হওয়া। একঝাঁক নারীর ইস্পাত কঠিন প্রত্যয় ও ধারাবাহিক সংগ্রামের অনিবার্য ফসল এটি। এই মেয়েদের বেশির ভাগই অতি দারিদ্রপীড়িত প্রান্তিক জনগোষ্ঠী থেকে উঠে আসা মানুষ। এই মেয়েগুলো শত বাধা বিপত্তি ডিঙিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সাফল্য পাওয়া একটি আশ্চর্যের ব্যাপার। তাদের এই যাত্রাটি ছিলো দুরূহ ও কণ্টকাকীর্ণ। তারা সামাজিক ও আর্থিক ভাবে বৈরী পরিস্থিতি জয় করে তবেই সাফ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। এই জন্য সাফ মহিলা ফুটবল দলের খেলোয়াড়সহ সকল সদস্যকে প্রাণঢালা অভিনন্দন। চ্যাম্পিয়ন দলের মেয়েদের মধ্যে ৮জন ময়মনসিংহ কলসিন্দুরের, ৫ জন রাঙামাটির কাউখালি স্কুলের, ২ জন সাতক্ষীরার এবং বাকীরা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের। তবে এসব ফুটবলাররা এতো বড় সাফল্য এনে দেশের মুখ উজ্জ্বল করলেও বাফুফে তাদের জন্য তেমন কিছু করেনি। তাদেরকে যে মাসিক ভাতা ১০-১২ হাজার টাকা দেওয়া হয়, এটি দেশের ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারী বা দারোয়ান পিয়নের বেতনের চেয়েও কম। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিরলস প্রচেষ্টায় মেয়েগুলো আজ এই পর্যায়ে উঠে এসেছে। এই মেয়েগুলো একেবারে নিম্ন আয়ের পরিবার থেকে উঠে আসা মানুষ। এদের অনেকের থাকার ঘরটিও নেই। এরা খেয়ে না খেয়ে কঠোর পরিশ্রম করে দেশের মুখ উজ্জ্বল করে আজ সাফ চ্যাম্পিয়ন। অথচ বিমানবন্দরে ল্যান্ড করার পর প্রেস কনফারেন্সে এদেরকে বসার জায়গাটি পর্যন্ত আমরা দিতে পারিনি। আমলা ও রাজনৈতিক নেতারা বসে কথা বলেছেন আর তারা পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন। বিষয়টি যে দৃষ্টিকটু এটা বুঝার ক্ষমতাও আমাদের নেই। তার উপর দলের একজন সদস্যের লাগেজ কেটে মূল্যবান জিনিসপত্র চুরি হওয়ায় অনেককে পীড়া দিয়েছে। বাফুফের সংবর্ধনায় সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন সাহেব বলেছেন তাদেরকে পুরস্কৃত করার মত টাকা বাফুফের ফান্ডে নেই। কী বিচিত্র এই দেশ? যেখানে বাজেটে বাফুফের বরাদ্দ শত শত কোটি টাকা। সেখানে সাফ চ্যাম্পিয়ন দলের খেলোয়াড়দেরকে দেওয়ার মত কিছু টাকা বাফুফের ফান্ডে নেই। এখন প্রশ্ন হলো, এই মেয়েগুলোর ভবিষ্যৎ কী? কারণ দেশে মেয়েদের নিয়মিত ফুটবল লীগ হয় না। কালেভদ্রে শুধু মাত্র বিদেশে টুর্নামেন্ট খেলে কি উন্নতি করা যায়? উন্নতির জন্য লাগে সারা বছর টুর্নামেন্ট খেলা ও লাগাতার প্র্যাকটিস। তাই এই মেয়েগুলোকে যথাযথ সুযোগ ও নার্সিং না করলে অচিরেই হারিয়ে যাবে অথবা সুযোগ পেলে স্থায়ীভাবে বিদেশে পাড়ি জমাবে, এটি নিশ্চিত করে বলা যায়।
স্বাধীনতার পর দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ করে খেলাধুলার জগতে যারা আলো ছড়িয়েছেন তাদের বেশিরভাগই যথাযথ মূল্যায়ন ও উপযুক্ত কর্মসংস্থানের অভাবে একসময় দেশান্তরি হয়েছেন। কারণ খেলা থেকে অবসর নেওয়ার পর, তাদের জন্য মর্যাদাপূর্ণ, মানসম্পন্ন ও উপযুক্ত কোনো কাজের ব্যবস্থা আমরা করতে পারিনি। অথচ এই প্রাক্তন খেলোয়াড়দের কাজে লাগিয়ে দেশে খেলাধুলায় রিভোল্যুশান করা যেতো। বিশ্বমানে না হলেও অনেক আগে আমরা এশিয়া মানে পৌঁছাতে পারতাম।
শুধু খেলাধুলা নয়, স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও লেখাপড়ায় প্রান্তিক ও মফস্বলের ছেলেমেয়েরা এগিয়ে। একটু খেয়াল করলে দেখা যায়, এখন যারা দেশ ও জাতিকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বা সাংস্কৃতিক জগতে আলো ছড়াচ্ছেন তারা সবাই মফস্বল থেকে উঠে আসা মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। লেখাপড়ার ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি বা মেডিক্যাল কলেজে যারা ভর্তি হয়, তাদের মধ্যে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী মফস্বলের মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। যাদের বেশিরভাগ বাংলা মিডিয়ামে সরকারি প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও কলেজে লেখাপড়া করা ছাত্রছাত্রী। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হলো মাদ্রাসা থেকে লেখাপড়া করা শিক্ষার্থী। আর আমরা যারা শহরে থেকে সন্তানকে বড় করছি অতিরিক্ত স্নেহ, তদারকি ও সতর্কতা অবলম্বন করায়, আমাদের সন্তানেরা সঠিকভাবে বেড়ে উঠতে পারছে না। শিশু অবস্থা থেকে তাদেরকে লেখাপড়ার ব্যাপারে অতিরিক্ত প্রেসার ও নানা রকম বিধিনিষেধের ফলে শিক্ষা জীবনের এক পর্যায়ে তারা খেই হারিয়ে ফেলে। অন্যদিকে নিরাপত্তার অজুহাত দিয়ে তাদেরকে ইচ্ছে মত খেলাধুলা, চলাফেরা করতে প্রতিবন্ধকতা ও প্রকৃতির সান্নিধ্যে যেতে বাধা সৃষ্টি করায় তারা প্রকৃতি থেকে শিক্ষা নিতে পারে না। জীবন ও বাস্তবতার অভিজ্ঞতা না থাকায় তারা যন্ত্রের মত আচরণ করে। ফলে পরবর্তী জীবনে বিশেষ করে সংসার ও কর্মজীবনে তাদেরকে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়। একটু খেয়াল করলে দেখা যায় ইঞ্জিনিয়ারিং, ডাক্তারী ও বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধা তালিকায় স্থান পাওয়া সবাই মফস্বল থেকে ওঠে আসা শিক্ষার্থী। অন্য দিকে সরকারি চাকরি বা বিসিএসে যারা উত্তীর্ণ হয় তাদের মধ্যেও প্রান্তিক ও মফস্বলের শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি।
যে কোনো মানুষ সফল হতে হলে জীবনে একটা লম্বা সময় কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। লেখাপড়া ও কর্মজীবনের শুরুতে নিষ্ঠা ও একাগ্রতার সহিত কাজ করতে হয়। যারা জীবনের শুরুতে ত্যাগ স্বীকার করে না, তারা পরবর্তী সময়ে কষ্টে দিনাতিপাত করে। এই সাধারণ কথাটি শহুরে বড় হওয়া শিক্ষার্থীরা বুঝে না বলেই পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা পাওয়ার পরেও সফল হতে পারে না। কয়েকদিন আগে কথা প্রসঙ্গে দেশের নামকরা একটি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সিনিয়র অধ্যাপক দুঃখ করে বলেছিলেন, কঠোর তদারকি ও নজরদারির পরও তাঁর সন্তানেরা কাঙ্ক্ষিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেনি। অথচ তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারীর সন্তানেরা লেখাপড়ায় তাঁর সন্তানের চেয়ে এগিয়ে। এটি শুধু তাঁর কথা নয়, সমগ্র দেশের চিত্র এটি। কারণ প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা ছোটোবেলা থেকে আর্থিক অনটনের মধ্যে বড় হয়ে কিশোরকাল থেকেই জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা লাভ করে। অভাব অনটন বা আর্থিক টানাপোড়েনে বড় হওয়ায় তাদের চিন্তা থাকে লেখাপড়ায় ভাল রেজাল্ট করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার। তারা নিয়মিত খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠে এবং সন্ধ্যায় রুটিন মাফিক পড়াশোনা করে। আর্থিক অসংগতির জন্য মোবাইল ও প্রযুক্তির প্রতি তেমন একটা আকৃষ্ট হতে পারে না। ফলে তাদের লেখাপড়া ছাড়া অন্যকিছু নিয়ে ভাবনা থাকে না। একাগ্রতা ও কঠোর পরিশ্রমের ফলে তারা শিক্ষাজীবনে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল লাভ করে। আর শহরে আরাম আয়েশে বড় হওয়া শিক্ষার্থীরা শিশুকাল থেকে পড়ালেখার চেয়ে ইন্টারনেট ফেসবুক টিভি পর্নোগ্রাফি ইউটিউবের প্রতি অত্যধিক ঝুঁকে একপ্রকার এডিকটেড হয়ে যায়। এর ফলে তারা ভালো রেজাল্ট করতে পারে না। এরা মোবাইলে চার্ট, ফেসবুকিং করে ও ইউটিউব দেখে সারারাত পার করে। এতে করে মধ্যাহ্নের আগে ঘুম থেকে উঠতে পারে না। তারা মনে করে ইন্টারনেট ফেসবুকই হচ্ছে জীবন এবং এটা ছাড়া তারা বাঁচতে পারবে না। সারাক্ষণ কানে হেড ফোন লাগিয়ে মোবাইলে কথা বলে। নিজের অজান্তে রেডিয়েশনের ক্ষতিকারক প্রভাবে তাদের ব্রেনে মারাত্মক ক্ষতিসাধন হয়। ফলে অল্প বয়সে অনিদ্রা, ক্ষুধামন্দা, খিটখিটে মেজাজসহ বিভিন্ন মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়, লেখাপড়ায় অনীহা তৈরি হয়। তাই নির্দ্বিধায় বলা যায় ইন্টারনেট ও ফেসবুক হচ্ছে বর্তমান শিক্ষার্থীদের বিশেষ করে শহুরে শিক্ষার্থীদের মানসিক বৈকল্য ও ধ্বংস হওয়ার অন্যতম অনুষঙ্গ। যা থেকে তারা আর বের হয়ে আসতে পারে না।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট