শিক্ষা একটি জীবনব্যাপী প্রক্রিয়ার নাম। যার সূচনা ঘটে প্রাথমিক শিক্ষার মাধ্যমে। যেমন বীজতলা তেমন বীজ। তাই বীজতলা ভালো হলেই ভালো বীজ পাওয়া যাবে। এজন্য বীজতলা ভালো করে তৈরি করা দরকার। এমনি এমনি তো আর ভালো বীজ আসবে না। বীজ ভালো না হলে ভালো ফলও আশা করা উচিত নয়।
প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্যই হলো শিশুর শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, নৈতিক, মানবিক, নান্দনিক, আধ্যাত্মিক ও আবেগ–অনুভূতির বিকাশ সাধন এবং তাদের দেশাত্মবোধে, বিজ্ঞানমনস্কতায়, সৃজনশীলতায় ও উন্নত জীবনের স্বপ্নদর্শনে উদ্বুদ্ধ করা। এ লক্ষ্যে অর্জন করা কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়।
প্রাথমিক শিক্ষাস্তরের একজন শিক্ষক আমি। খুব কাছ থেকে দেখে যাচ্ছি এই পর্যায়ের শিক্ষা ব্যবস্থাকে। সে হিসেবে মাঠ পর্যায়ে যেসব সমস্যার সম্মুখীন হই কিংবা কোন কোন ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসলে প্রাথমিক শিক্ষা আরও মানসম্মত হবে বলে আশা করা যায় সে বিষয়ে আমার কিছু মতামত তুলে ধরছি।
একজন শিক্ষার্থীর প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি, আচার–আচরণ, চিন্তা–ভাবনা, কথা বলার ধরণ ইত্যাদির প্রাথমিক বিকাশ হয় প্রাথমিক শিক্ষাকে কেন্দ্র করেই। সুতরাং নড়বড়ে খুঁটিতে সুউচ্চ দালান গড়ার স্বপ্ন যেমন আশংকাজনক, এক্ষেত্রে ও ঠিক তাই। প্রাথমিক শিক্ষার দিকে নজর দিতে গেলে মূলত যেসব বিষয়গুলোতে ফোকাস দিতে হয়, সেগুলো হলো :
ক) প্রাথমিক বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা, খ) প্রাথমিক শিক্ষা কারিকুলাম সংশোধন এবং গ) প্রাথমিক শিক্ষকের পেশাগত উন্নয়ন।
প্রাথমিক বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা: প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরিবেশ হতে হবে শিক্ষার্থী–শিক্ষক বান্ধব। বিশদভাবে বলতে গেলে –
১। বৈষম্য নিরসনের লক্ষ্যে প্রতিটি বিদ্যালয়কে এক শিফটের বিদ্যালয়ে রূপান্তর করা দরকার। ২। শিক্ষার্থীদের শারীরিক–মানসিক ধারণক্ষমতা বিবেচনায় বিদ্যালয় সময়সূচি সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৩টা কিংবা সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২ টা নির্ধারণ করা উচিত। ৩। সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খলভাবে পাঠ পরিচালনার লক্ষ্যে প্রাক–প্রাথমিক এবং প্রথম শ্রেণিতে ২ জন শিক্ষকের উপস্থিতিতে শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনা করা প্রয়োজন। ৪। বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি প্রথা বিলুপ্ত করে সম্পূর্ণ প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় বিদ্যালয় পরিচালনা করা অব্যাহত রাখতে হবে। ৫। বিদ্যালয়সমূহে নিরাপত্তার জন্য আয়া/ দপ্তরী কাম প্রহরী এবং অফিসিয়াল কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অফিস সহায়ক কাম কম্পিউটার অপারেটর আবশ্যিকভাবে নিয়োগ দেয়া জরুরি দরকার। ৬। বিদ্যালয়সমূহে যুগোপযোগী এবং আকর্ষণীয় কক্ষসহ পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষের ব্যবস্থা করতে হবে।
৭। বিদ্যালয় অফিসকক্ষগুলোকে মানসম্মতকরণ এবং মাসিক কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে আনুষঙ্গিক ব্যয় বাবদ বরাদ্ধ বাড়াতে হবে। ৮। অভিভাবক ও মা সমাবেশ, জাতীয় দিবস সমূহ পরিচালনা বা অন্যান্য সমাবেশ পরিচালনার জন্য সুসজ্জিত মিলনায়তন কক্ষ রাখতে হবে।
প্রাথমিক শিক্ষা কারিকুলাম সংশোধন: কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মেধা–মননের সামর্থ্য বিবেচনায় প্রাথমিক শিক্ষা কারিকুলামের গঠনমূলক সংশোধন আবশ্যক। এ জন্য করণীয় হলো– ১। বৈষম্য নির্মূলের লক্ষ্যে ইংরেজি মাধ্যম, বাংলা মাধ্যম, মাদ্রাসা ও এবতেদায়ী সকল স্তরে একই কারিকুলাম নিশ্চিত করতে হবে। ২। সঠিকপ্রবাহ এবং শুদ্ধ হাতের লেখা নিশ্চিতের প্রয়াসে প্রাক–প্রাথমিকের ন্যায় অন্তত ২য় শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি ‘এসো লিখি‘র আলোকে বাৎসরিক পাঠ পর্যালোচনাপূর্বক শ্রেণিভিত্তিক খাতা সরবরাহ করতে হবে। ৩। ১ম শ্রেণি থেকে পরীক্ষাপদ্ধতি এবং পঞ্চম শ্রেণিতে সমাপনী পরীক্ষার ব্যবস্থা রাখতে হবে। ৪। চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত শিখনফল অর্জনভিত্তিক এবং ৫ম শ্রেণিতে শতভাগ উত্তীর্ণের ব্যবস্থা করতে হবে। ৫। কারিকুলামের পাঠ্যবইয়ের অধ্যায় অনুযায়ী শ্রেণিভিত্তিক সংশ্লিষ্ট উপকরণসমূহ সরবরাহ করতে হবে। ৬। ‘ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা‘ পাঠদানের লক্ষ্যে এলাকাভিত্তিক ধর্ম বিবেচনায়, বিদ্যালয়সমূহে প্রত্যেক ধর্মাবলম্বী শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। ৭। শিক্ষার্থীদের ‘শারীরিক–শিক্ষা‘ কার্যক্রম নিয়মিতকরণের লক্ষ্যে প্রতিটি বিদ্যালয়ে ‘শারীরিক শিক্ষা‘ বিষয়ের শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। ৮। মাঠ পর্যায়ের কর্মরতদের প্রতিনিধি ও সম্মানিত নীতি–নির্ধারকদের পরিচালনায় একটি শিক্ষার্থীবান্ধব, আদর্শ, যুগোপযোগী এবং আন্তর্জাতিক মানের কারিকুলাম প্রণয়ন করতে হবে।
প্রাথমিক শিক্ষকের পেশাগত উন্নয়ন: উন্নত দেশগুলোর মতো প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার পাশাপাশি প্রাথমিক শিক্ষকদের কর্মসম্পাদন এবং জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে সুনজর দিতে হবে। বিশদভাবে বলা যায়– ১। বিদ্যালয়সমূহে শূন্যপদে প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষক নিয়োগসহ পর্যাপ্ততার লক্ষ্যে পদসংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। ২। শিখন–শেখানো কার্যাবলি ছাড়া শিক্ষকদের অন্যান্য কাজে ব্যস্ত রাখা থেকে বিরত থাকতে হবে। ৩। প্রতিদিন ৭টা থেকে ৮টা পর্যন্ত শ্রেণিপাঠদানের মতো অমানষিক নির্যাতন বন্ধ করে পরিকল্পনা ও উপকরণ ব্যবহারসহ সর্বোচ্চ ৪টা শ্রেণিপাঠদানের ব্যবস্থা করতে হবে। ৪। প্রধান শিক্ষকদের পদ ৯ম গ্রেডে এবং সহকারী শিক্ষকদের পদ ১০ম গ্রেডে উন্নীত করতে হবে। ৫। অভিজ্ঞতার পাশাপাশি যোগ্যতাকে প্রাধান্য দিয়ে শিক্ষকদের পর্যায়ক্রমে পদোন্নতির ব্যবস্থা করতে হবে এবং বিভাগীয় পরীক্ষার মাধ্যমে ‘সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার‘ এবং ‘ইউআরসি ইন্সট্রাক্টর‘ পদে নিয়োগ দিতে হবে। ৬। নির্ধারিত সময়ে শ্রান্তি বিনোদন ভাতা, উচ্চতর গ্রেড ও সিলেকশন গ্রেড অটো প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। ৭। শিক্ষকদের যেকোনো প্রয়োজনে, উপজেলা–জেলা–বিভাগীয় শিক্ষা অফিস কিংবা তদসংশ্লিষ্ট পর্যায়ে হয়রানি বন্ধ করার লক্ষ্যে সরকারি চাকুরিবিধির আলোকে সুস্পষ্ট ও নির্ধারিত নীতিমালা প্রতিটি কার্যালয়ে দৃশ্যমান রাখতে হবে।
প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা যেনো আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুদৃঢ়তার হাতিয়ার হয়, সেদিকে সংশ্লিষ্ট সকলকে নজর দেওয়ার অনুরোধ রইল।
একটি শিশু ভবিষ্যতে কতটুকু ন্যায় নীতিবান, আদর্শবান,চরিত্রবান হবে কিংবা দেশ, জাতি, সমাজের প্রতি কতটুকু দায়িত্বশীল হবে এটি অনেকাংশেই নির্ভর করে তাঁর প্রাথমিক জীবনের শিক্ষার উপর। বিনয়ী, সৎ ও যোগ্যতা সম্পন্ন একটি জাতি গঠনের জন্য যে সব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে সেগুলো অবশ্যই একদিন দূর হবে এবং যে স্বপ্ন সাধ নিয়ে এই জাতির পথ চলা শুরু হয়েছিল তা অচিরেই পূর্ণ হবে। আমরা পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, দায়িত্ববোধ এবং সেবাধর্মী একটি জাতি গঠনে সবাই কাজ করব–এই প্রত্যাশা রইল সংশ্লিষ্ট সবার কাছে। প্রাথমিক শিক্ষা তথা প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো হোক সকলের নির্ভরতার নিশ্চিন্ত প্রাক–স্থল।
লেখক: শিক্ষক ও সংগঠক।