একটি শিশু জন্মের পর আস্তে আস্তে যখন বড় হতে থাকে তখন মা প্রথমে শিশুকে শিক্ষায় মনোনিবেশ করার বিভিন্ন প্রক্রিয়া অবলম্বন করে। প্রথমে মা মুখে মুখে সংখ্যা বলতে শিখায় এবং বর্ণমালাগুলোর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। শিশু যতই বড় হতে থাকে, মা শিশুকে নিজস্ব কায়দায় আস্তে আস্তে পড়াতে বসায়। এরপর শিশুর বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে মা তাঁর শিশুকে স্কুলে পাঠাতে চেষ্টা করে। সন্তানকে শিক্ষা দানের জন্য মায়ের যুদ্ধ এখান থেকে শুরু হয়। মা প্রথমে সন্তানকে ভর্তি করায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যেখানে শিশু শ্রেণি বলে একটি শ্রেণি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সৃষ্টি করেছে। এ শ্রেণি কি ইংরেজি মাধ্যম বা কি বাংলা মাধ্যম সব প্রতিষ্ঠানে দেখা যায়। এমন কি মাদ্রাসা সমুহেও এরূপ একটি শ্রেণি চালু করা হয়েছে। শিশু আস্তে আস্তে ৫ম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়। এটা হচ্ছে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রথম স্তর। ইহাকে সাধারণভাবে প্রাথমিক শিক্ষাও বলা হয়। এরপরে রয়েছে মাধ্যমিক স্তর বা মাধ্যমিক স্কুল যেখানে পর্যায়ক্রমে একটি শিশু ক্রমাগত বড় হয়ে মাধ্যমিক পর্যায় থেকে কলেজ স্তরে চলে যায়। কলেজের পড়াশুনা শেষে সন্তানটি পরবর্তীতে নিজ নিজ লক্ষ অনুসারে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের দিকে ধাবিত হয়। এখানে বলে রাখা ভালো যে, মাধ্যমিকের পর সাধারণ শিক্ষায় না গিয়ে কিছু কিছু শিক্ষার্থী টেকনিক্যাল শিক্ষার দিকেও যেতে পারে।
কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে পাঠ্যক্রমগুলোর সকল পুস্তক সরকারি বিধি বিধান অনুসারে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো তৈরি করে। এতে সরকারের নিজস্ব চিন্তা ভাবনা উক্ত পাঠ্যক্রমের মধ্যে প্রতিপালিত হয়। সরকার যদি মনে করে সমগ্র জাতিকে তথা ভবিষ্যৎ বংশধরদেরকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করবে, তবে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পাঠ্যক্রমকে অনুরূপভাবে সাজাতে হবে। আর যদি সরকার মনে করে ভবিষ্যৎ জাতিকে উগ্রবাদ তথা স্ট্রিম জাতি হিসেবে গড়ে তুলবে, তবে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পাঠ্যক্রমকে এইভাবে সাজাতে পারে। এ কারণে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পাঠ্যক্রম একটা জাতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আবার পাঠ্যপুস্তক ও সাধারণ বই এর মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য আছে। পাঠ্যবই কেবল শিক্ষার্থীদের শিক্ষা প্রদানের উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়। পাঠ্যপুস্তক অধ্যয়নে একাডেমিক স্বীকৃতি লাভ হয়। আর সাধারণ বই পাঠে দক্ষতা ও জানাশুনা বৃদ্ধি পায়। সাধারণ বই যে কোন ব্যক্তি পাঠ করতে পারে। মূলত: কারিকুলাম কিংবা পরীক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তন হলে নতুনভাবে পাঠ্যপুস্তক লেখার প্রয়োজন হয়। এ পাঠ্যপুস্তকের ওপর ভিত্তি করে একটি জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জ্ঞান, ধারা, বুদ্ধিবৃত্তি এগিয়ে যায়। এ কারণে সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে জ্ঞান, বিজ্ঞান, পরিবেশ এবং সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তিত হয় বলে কারিকুলামকে কয়েক বছর পর পর পরিবর্তন করতে হয়। ফলে পাঠ্যপুস্তকও পরিবর্তন করার প্রয়োজন হয়।
ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গড়ে তোলার জন্য নতুন করে কারিকুলাম তৈরির সাথে পাঠ্যপুস্তক লিখার প্রয়োজন হয়। পাঠ্যপুস্তক এমনভাবে লিখতে হবে যাতে সকল বিষয় এবং এর উদাহরণ সত্য, সহজ ও সঠিক হয়। কারণ পাঠ্যপুস্তকে যা থাকবে তাকে ভিত্তি করে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের মধ্যে সেই বিষয়গুলো সঞ্চারিত হয়। ফলে মৌলিক জ্ঞানের অভিন্নতা তৈরি হয়। আর এই অভিন্ন জ্ঞানের আধারে তৈরি করতে গবেষকদের গবেষণার আলোকে পাঠ্যপুস্তকের বিভিন্ন বিষয় রচনা করতে হয়। যে সব বিষয়গুলো দীর্ঘদিন আগে থেকে প্রতিষ্ঠিত সত্য হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে সেই সব বিষয়গুলোকে অবিকৃতভাবে উপস্থাপন করতে হবে পাঠ্যপুস্তকে।
যেমন– বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আইনস্টাইনের তত্ত্ব, নিউটনের সূত্র, আর্কিমিডিসের তত্ত্ব ইত্যাদি। তাই এসব বিষয় সহজবোধ্য ভাষায় পাঠ্যপুস্তকে উপস্থাপন করতে হবে। পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করার সময় একটি বিষয় অবশ্যই পালন করতে হবে। যেমন– পাঠ্যপুস্তক ‘পরোক্ষ’ বাক্যে লিখা ঠিক নয়। বরং শিক্ষার্থীদের মধ্যে শক্তিশালী মনোবল তৈরি করতে ‘প্রত্যক্ষ’ বাক্যে পাঠ্যপুস্তক রচনা করতে হবে।
পাঠ্যপুস্তকে কোন কোন বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকবে তা নির্ধারণের জন্য শিক্ষা কারিকুলাম থাকে। সেই কারিকুলাম অনুসরণ করে সুন্দর ও সাবলীল ভাষায় পাঠ্যপুস্তক রচনা করতে হয়। পাঠ্যপুস্তকটি ঠিক কোন শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য রচনা করা হচ্ছে তা অবশ্যই মনে রাখতে হবে। আবার শিক্ষার্থীদের বয়সের কথাও বিবেচনায় নিয়ে পাঠ্যপুস্তক রচনা করতে হয়। পাঠ্যপুস্তকে বর্ণিত কোন তথ্য ব্লগ, ওয়েবসাইট, উইকিপিডিয়া, কোচিং সেন্টার, বা কোন কোম্পানি ওয়েবসাইট থেকে নেয়া যাবে না। কারণ এসব মাধ্যম থেকে যদি তথ্য নেয়া হয় তবে তথ্যগুলো যথাযথ নাও হতে পারে। এই অনির্ভরযোগ্য উৎসগুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্য একাডেমিয়ায় ব্যবহারের কোন সুযোগ নেই। মনগড়া কোন তথ্য যেমন পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা যায় না তেমনি দ্বিধাদ্বন্দ্ব তৈরি করে এমন তথ্যও পাঠ্যপুস্তকে দেয়া যায় না। পাঠ্যপুস্তকে লেখার জন্য সাধারণত একাডেমিশিয়ানদের ওপর দায়িত্ব দেওয়া হয়। যাঁরা জ্ঞান সৃষ্টি করেন, বিশেষ করে সিনিয়র অভিজ্ঞ ও উচ্চতর ডিগ্রিধারী কলেজ শিক্ষক বা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সরাসরি গবেষণায় জড়িত এবং যাঁরা সুনির্দিষ্ট বিষয়ে কাজ করার ফলে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে লব্ধ জ্ঞান রাখেন, তাঁদেরকে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের দায়িত্ব দেয়া উচিত। এসব গবেষকেরা নির্দিষ্ট বিষয়ে অতীতে যে সব কাজ করেছে, সেই সব বিষয়ে যেমন ধারণা রাখেন তেমনি নতুন নতুন কী গবেষণা হচ্ছে, সে সব সম্পর্কেও ধারণা রাখেন। ফলে এসব অভিজ্ঞ শিক্ষক দিয়ে পাঠ্যপুস্তক লেখালে হালনাগাদ তথ্য পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হয়। আবার সাধারণ বই লেখা আর পাঠ্যপুস্তক লেখার মধ্যে পার্থক্য আছে।
পাঠ্যপুস্তক তাঁরাই লিখবেন, যাঁরা দীর্ঘ দিন শিক্ষার্থীদের পাঠদান করে আসছেন এবং তাঁদের আছে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা। পাঠ্যপুস্তকের লেখকেরা যেমন শিক্ষক বা গবেষক হতে পারেন, তেমনি তাঁরা কেবল শিক্ষার্থীদের শিক্ষক নন, বরং শিক্ষকদেরও শিক্ষক। ফলে তাঁদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার অনেক বড়। এ কারণে পাঠ্যপুস্তক রচনার সময় একাডেমিশিয়ানদের সহায়তা গ্রহণ করা বাঞ্চনীয়।
তাছাড়া পাঠাসূচীতে রাষ্ট্রের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয় করা উচিত। এমন কিছু রাষ্ট্রীয় বিষয় আছে যেগুলোকে অস্বীকার যেমন করা যায় না তেমনি পাঠ্যসূচী থেকেও বাদ দেয়া যায় না। যেমন– বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন আলোচনার ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধকে কখনো বাদ দেয়া যায় না। একইভাবে দেশকে এগিয়ে নেয়ার জন্য দক্ষ ও সৃজনশীল নাগরিক হিসেবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গড়ে তোলার জন্য, পাঠ্যপুস্তকে এমন বিষয় ও অধ্যায় সংযোজন করতে হবে যা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম মেধাশীল ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠে। মনে রাখতে হবে পাঠ্যপুস্তক কোন মৌলিক গবেষণা প্রবন্ধ নয়। এখানে যেসব তথ্য দেয়া থাকে তা অতীতে প্রকাশিত গবেষণা, জরিপ বা নির্ভরযোগ্য তথ্যের ভাণ্ডার থেকে নেয়া হয়েছে। যাঁরা বিজ্ঞানের পাঠ্যপুস্তক রচনা করেন তাঁরা মূলত: পূর্বে গবেষণা লব্ধ সঠিক তথ্য ও তত্ত্ব পাঠ্যপুস্তকে সংযোজন করেন। যারা সামাজিক বিজ্ঞানের পাঠ্যপুস্তক রচনা করেন তাঁরা গবেষণা লব্ধ তথ্য ও তত্ত্ব সংগ্রহ করে তা উপস্থাপন করেন। অতএব এখানে ভুল হওয়ার কোন অবকাশ থাকে না।
সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে সমাজে অনেক কিছুর পরিবর্তন হয়। মানুষের ধ্যান–ধারণা, চিন্তা–ভাবনা, লাইফ স্টাইল ইত্যাদির পরিবর্তন আসে। অতএব পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তনশীল সমাজ ব্যবস্থার আলোকে রচনা করতে হয়। আর একটি কথা না বললেই নয়। প্লেগারিজম (চুরি) এড়াতে তথ্যের উৎসকে স্বীকার করা একাডেমিক সততার মধ্যে পড়ে। এ কারণে প্রতিটি উন্নত দেশের পাঠ্যপুস্তকে দেখা যায়, প্রতিটি পাতার নীচে অথবা বইয়ের শেষে নির্ঘণ্ট রাখা হয়। উক্ত নির্ঘণ্টে তথ্যের উৎস সম্পর্কে পরিষ্কারভাবে লিখা থাকে। এতে পাঠ্যবইয়ের গুণগত মান বৃদ্ধি পায়। শিক্ষার্থীরাও সৎ চরিত্র গঠনে উৎসাহিত হবে। কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের বা অন্য যে কোন পর্যায়ের গবেষকেরা গবেষণা থিসিস রচনা করার সময় এ বিষয়টি স্পষ্টভাবে উপস্থাপন করে। অন্যথায় উক্ত থিসিস যথাযথ বলে মনে করা হয় না।
পাঠ্যপুস্তক লেখা অন্যান্য একাডেমিক কাজের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সে ক্ষেত্রে যদি অনৈতিক বিষয় বিশেষ করে অন্যের মেধাস্বত্ব চুরি (প্লেগারিজম) হয়ে থাকে তবে সেটার বিরুদ্ধে আইনগত বিধান থাকা বাঞ্চনীয়। মনে রাখা প্রয়োজন, পাঠ্যপুস্তকের ভুল অন্য দশটি ভুলের ন্যায় নয়। পাঠ্যপুস্তকগুলো নবাগত প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা পড়ে। ভুল হওয়ার পর সংশোধনী দিলেও এতে রাষ্ট্রীয় মেধা ভুল পথে পরিচালিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সর্বশেষে বলা যায়, নবাগত প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের কল্পনা শক্তিকে বৃদ্ধি করার জন্য এবং নতুন এক জ্ঞানের রাজ্যে প্রবেশ করানোর জন্য নির্ভুলভাবে পাঠ্যপুস্তক রচনা করতে হবে। শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন দেখাতে হবে। তাদের কল্পনা শক্তিকে শাণিত করতে হবে। কারণ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন মত প্রকাশ করেছিলেন যে, কল্পনাশক্তি জ্ঞানের চেয়েও মূল্যবান। জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা আছে। কিন্তু কল্পনাশক্তির কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। এজন্য প্রজন্মের কল্পনাশক্তিকে জাগ্রত করতে এমন ধারণা অন্তর্ভুক্ত করে পাঠ্যপুস্তক রচনা করতে হবে।
লেখক : পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, ইউএসটিসি