প্রাণ ফিরে পাক ঐতিহ্যবাহী বাজার চাকতাই-খাতুনগঞ্জ

| বুধবার , ৮ ডিসেম্বর, ২০২১ at ৬:১১ পূর্বাহ্ণ

দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ইতিহাসে চাকতাই-খাতুনগঞ্জ একটি ঐতিহ্যবাহী নাম। এই দুটি নাম যেমন অনন্য, তেমনি ঐতিহাসিকও। চট্টগ্রামের এই দুই বাণিজ্যিক এলাকার অবস্থান কাছাকাছি। পাশাপাশি উচ্চারিত হয় নাম দুটি। চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় পাইকারী বাজার। চট্টগ্রাম নগরীসহ বিভিন্ন উপজেলা থেকে ব্যবসায়ী ও ক্রেতাদের আনাগোনায় প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর এ দুটি বাজার। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে পণ্য এসে জমা হয় এই বাজারের আড়তগুলোতে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, প্রায় দেড়শ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত এ বাজারগুলোর সাথে দেশের অর্থনীতির প্রবাহ সমৃদ্ধি ও উন্নতির বিষয় ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। এ বাজার দুটি মূলত দেশের সকলপ্রকার খাদ্য-নিত্যপণ্যসহ মানুষের মৌলিক চাহিদার অধিকাংশই যোগান দিয়ে থাকে। এই বাজারের উপর নির্ভর করে দেশের পণ্যদাম, পণ্য সরবরাহ ও বাজারজাতকরণ। এখান থেকেই তৈরি হয়েছে দেশের স্বনামধন্য শিল্পপতি, ব্যবসায়ী ও সমাজপতির। চট্টগ্রামসহ দেশে ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতৃত্বের বিশাল একটি অংশ এ খাতুনগঞ্জ-চাকতাই থেকেই উঠে এসেছে।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যিই যে চাকতাই-খাতুনগঞ্জের সেই জৌলুস আর নেই। নানা রকম সংকটে জর্জরিত এ দুটি বাজার। গত ৬ ডিসেম্বর দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত হয়েছে ‘সংকুচিত হয়ে আসছে চাক্তাই খাতুনগঞ্জের বাজার’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়েছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ওজন নিয়ন্ত্রণ স্কেল স্থাপন, নৌ পথে পণ্য পরিবহনে ধস এবং সরু সড়কে দিনভর যানজটসহ বহুমুখী সংকটে সংকুচিত হয়ে আসছে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের ভোগ্যপণ্যের বাজার। এছাড়া বর্ষায় জলাবদ্ধতা চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের নিত্য চিত্র। কেবল জোয়ারের পানিতে শুষ্ক মৌসুমেও তলিয়ে যায় এখানকার নিচু এলাকা।
চাক্তাই খাতুনগঞ্জে ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা বলেন, গত দুই বছর যাবৎ ব্যবসায়ীরা ক্ষয়-ক্ষতিতে আছে। কোন ব্যবসায়ী লাভের মুখ দেখেনি গত দুই বছরে। একদিকে করোনা পরিস্থিতি অন্যদিকে জোয়ারের পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ব্যবসায়ীরা। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যে দুটো স্কেল বসানো হয়েছে, তার কারণে ব্যবসায়ীরা আরো বেশী ক্ষতিগ্রস্ত। দেশে আরো ৩৫ টা হাইওয়ে রোড আছে সেগুলোতে স্কেল বসানো হয়নি কিন্তু ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে স্কেল বসিয়ে যেন ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়েন বা টিকতে না পারেন, সেজন্য উদ্দেশ্যমূলকভাবে স্কেলগুলো বসানো হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তাঁরা। আগে একটা গাড়ি মাল নিয়ে যেতো আর এখন দুইটা গাড়ির প্রয়োজন হচ্ছে। এতে খরচ বেশী হয়ে ভোক্তাদের উপর চাপ পড়ছে এবং ঢাকার বাজার ও চট্টগ্রামের বাজারের মধ্যে দামের পার্থক্য সৃষ্টি হচ্ছে। ঢাকায় চট্টগ্রামের তুলনায় প্রতি কেজিতে চার-পাঁচ টাকা কম। এ বৈষম্যমূলক আচরণ কেন করা হলো তাঁরা বুঝতে পারছেন না।
ব্যবসায়ীরা বলেন, সরকার আমাদের প্রণোদনা দিয়েছে কিন্তু যেভাবে চেয়েছি সেভাবে পাইনি। কিছু কিছু ব্যবসায়ী পেয়েছে, সবাই পায়নি। যে স্কেলগুলো বসানো হয়েছে সে স্কেলগুলোর কারণে এখানে আমাদের ব্যবসা বাণিজ্য অনেক কমে গিয়েছে। এমনকি হাইওয়ে পথে মাল না নিয়ে নৌপথে অনেক ব্যবসায়ী মাল নিয়ে যাওয়ার সময় গত এক মাসে ৪ কোস্টার মালসহ ডুবে গেছে। এতে প্রায় ২৫-৩০ কোটি টাকার মত ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে ব্যবসায়ীদের। এগুলোর ইন্সুরেন্স না থাকায় ক্ষতি পোষানো সম্ভব হয়না।
‘স্থানীয় বাণিজ্যে জলাবদ্ধতার অর্থনৈতিক প্রভাব: খাতুনগঞ্জ’ শীর্ষক একটি সমীক্ষা পরিচালিত হয়েছে সম্প্রতি। এতে দেখা গেছে, গত বছর জলাবদ্ধতার কারণে খাতুনগঞ্জ ও আশপাশের এলাকার ব্যবসায়ীদের অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে আনুমানিক ৫১৪ কোটি টাকা, যা ২০১১ সালে ছিল ১৭৪ কোটি টাকা। প্রতিবেদনে ২০১১ থেকে ২০২০ পর্যন্ত ১০ বছরের ক্ষতির পরিমাণ উল্লেখ করা হয়েছে। শুধুমাত্র অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়, সমীক্ষায় ব্যবসায়ীদের মানসিক ক্ষতির বিষয়টিও উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, ৯১ দশমিক ৫৩ শতাংশ ব্যবসায়ী হতাশায় ভুগছেন, ব্যবসায়ে অনীহা তৈরি হয়েছে ৬৪ দশমিক ৪১ শতাংশ ব্যবসায়ীর এবং ক্রেতাদের কাছে সুনাম নষ্ট হয়েছে ৭১ দশমিক ১৯ শতাংশ ব্যবসায়ীর। খাতুনগঞ্জের অর্থনৈতিক ক্ষতি এতে বিবেচনায় নেওয়া হলেও এর প্রভাব রয়েছে আঞ্চলিক ও জাতীয় অর্থনীতিতেও। এ ছাড়া অর্থনৈতিক ক্ষতির পাশাপাশি সামাজিক ও মানসিক ক্ষতির কারণও জলাবদ্ধতা। ব্যবসায়ীরা জলাবদ্ধতার কারণে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন, ব্যবসায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। ফলে তাদের মধ্যে হতাশার জন্ম নেয়। সময়ের স্বল্পতার কারণে পরোক্ষ উৎস থেকে তথ্য ব্যবহারের কথাও বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।
এত সমস্যার মধ্যেও চাকতাই-খাতুনগঞ্জ ব্যবসায়ীদের মূল ভরসা। আমরা চাই, প্রাণ ফিরে পাক ঐতিহ্যবাহী এই দুই বাজার। সরকারের সহযোগিতায় উন্নত ও আধুনিক বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসাবে গড়ে উঠুক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে