কয়েক দশক আগের বা মাত্র কয়েক বছর আগের যে বিষয়গুলো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মনে দাগ কেটে আছে যেমন– ঝুপড়ি, হলের করিডর, স্টেশনের আড্ডা সেই সব স্মৃতি যেন হঠাৎ করেই জীবন্ত হয়ে উঠল। প্রাক্তনরা ফিরে পেলেন অতীতের সেই আনন্দময় দিনগুলো। আবার কিছু কিছু মুহূর্তে চোখের পানি মুছলেন অগোচরে। গতকাল শুক্রবার নগরীর অভিজাত জিইসি কনভেনশন সেন্টারে মিলিত হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় চার হাজার প্রাক্তন শিক্ষার্থী। ঘণ্টার পর ঘণ্টাজুড়ে চলা পুনর্মিলনী যেন হয়ে উঠেছিল অতীত আর বর্তমানের এক অদ্ভুত মেলবন্ধন। প্রবীণ–তরুণ–প্রাক্তনরা খুঁজে নিলেন পুরোনো সহপাঠীদের। কেউবা বিস্ময়ে তাকালেন, সময়ের এত দীর্ঘ ব্যবধানও যে এক মুহূর্তে মিলিয়ে যেতে পারে। মঞ্চে প্রাক্তনদের কণ্ঠে ধ্বনিত হলো স্মৃতির নানা কথা। কেউ বললেন আন্দোলন–সংগ্রামের দিনের কথা, কেউ স্মরণ করলেন বন্ধুত্বের প্রথম সকাল। আবার কেউ ঝুপড়িতে পাওয়া প্রেম কিংবা বন্ধুর সঙ্গে কাটানো বিকেল স্মরণ করে চোখের পানি মুছলেন অগোচরে।
পুনর্মিলনীতে আসা ১৮তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সেলিমা বলেন, আজকে এই পুনর্মিলনীতে এসে যেন ফিরে গেছি ৩৯ বছর আগের ক্যাম্পাস জীবনে। জীবনের সোনালি সময় কাটানো বন্ধু বান্ধবীদের সঙ্গে খুনসুটি করতেছি। তবে অনেক বন্ধু এখন নেই, তাদের কথা মনে হলে খুব খারাপ লাগে। ১৬ ব্যাচের কাজী নুরুল ইসলাম বলেন, ৪১ বছর পর আবার সেই সহপাঠীদের সঙ্গে দেখা হওয়া জীবনের সবচেয়ে আনন্দের মুহূর্ত। সবার চুলে পাক ধরেছে, তবুও চোখ–মুখে সেই আগের উচ্ছ্বাস। মনে হচ্ছিল আবার ক্লাসের বেঞ্চে ফিরে গেছি। এ সময় তার পাশে থাকা ২১ ব্যাচের প্রাক্তন শিক্ষার্থী জাহান নূর বিউটি যোগ করেন– বন্ধুত্ব, আবেগ ও স্মৃতির মিলনমেলা এমন এক অভিজ্ঞতা যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। ৪০ বছর পরও সবাইকে দেখে মনে হল, আমরা একে অপরের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সম্পর্কের বন্ধন এত বছর পরও অটুট আছে, এটাই সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।
বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ও জাতীয় নির্বাহী কমিটির সাবেক যুগ্ম মহাসচিব, চবি এলামনাই এসোসিয়েশনের আহ্বায়ক মোহাম্মদ আসলাম চৌধুরী উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলেন, দীর্ঘ সাড়ে ৮ বছর কারাগারে থাকার পর আজকের আয়োজনের মাধ্যমে সবার সাথে দেখা হল। যেন একটা পরিবারের সব সদস্য মিলিত হল। পুনর্মিলনী শুধু স্মৃতিচারণ নয়, বরং প্রাক্তনদের ভ্রাতৃত্ববোধ ও সহযোগিতার নতুন দিগন্ত খুলে দেবে।
এর আগে বিকাল ৩টায় বেলুন ও পায়রা উড়িয়ে অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এলামনাই এসোসিয়েশনের এডহক কমিটির আহ্বায়ক মোহাম্মদ আসলাম চৌধুরী। এসময় উপস্থিত ছিলেন পুনর্মিলনী উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক মোহাম্মদ একরামুল করিম, এডহক কমিটির সদস্য মাহবুবের রহমান শামীম, এম এ হালিম, পুনর্মিলনী কমিটির সদস্য সচিব কামরুল হাসান হারুন। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন এমডি ফখরুল ইসলাম, শাহ মোহাম্মদ, সেলিম, ইফতেখার হোসেন চৌধুরী মহসিন, কাজী মাহমুদ ইমাম বিলু, আমজাদ হোসেন চৌধুরী, সোহরাব হোসেন সোহেল, আবুল বাশার, হাফিজ আল আসাদ, কামরুল মেহেদী, দাউদ আব্দুল্লাহ হারুন, মজুমদার শাহীন, মোর্শেদুল আলম, আতিক উল্ল্যাহ, আবু সাঈদ, রেজোয়ান সিদ্দিকী মামুনুর রশীদ, শাহেদুল ইসলাম প্রমুখ।
অনুষ্ঠানের শুরুতে পবিত্র কোরআন হতে তেলাওয়াত করেন ৩০ ব্যাচের প্রাক্তন শিক্ষার্থী এডভোকেট আবু সাঈদ। এরপর জুলাই আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে শোক প্রস্তাব পাঠ করেন যুগ্ম–সদস্য সচিব এম ডি ফখরুল ইসলাম। শহীদ ফরহাদ হোসেন, হৃদয় চন্দ্র তারুয়া, চট্টগ্রাম কলেজ শিক্ষার্থী ওয়াসিম আকরামসহ সব শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। জুলাই শহীদদের পরিবারকে সম্মাননা স্মারক ও সম্মানী প্রদান করা হয়।
সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা : উদ্বোধনী নৃত্যের মধ্য দিয়ে শুরু হয় সাংস্কৃতিক আয়োজন। প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা নৃত্য, গান, আবৃত্তি, কৌতুকসহ নানা কর্মকাণ্ডে অংশ নেন। সংগীত পরিবেশন করেন শাহরিয়ার খালেদ, ইকবাল হায়দার, জাকিয়া সুলতানা, হোসাইন মাসুদ, সালাউদ্দীন মামুন, শাহেদুল কবির, সাগর বড়ুয়া, সোমা রায়। কুমিল্লা থেকে আগত প্রাক্তনদের সমন্বয়ে একটি দল পরিবেশন করেন দলীয় সংগীত। অনুষ্ঠান উপস্থাপন করেন হাফিজ আল আসাদ, নাসরিন ইসলাম, কঙ্কন দাশ, নাজনীন আকতার রেখা ও দিলরুবা খানম ছুটি। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে ছিলেন হানিফা নাজিবা হেনা। সন্ধ্যা ৭টায় অনুষ্ঠিত হয় এডহক কমিটি ও পুনর্মিলনী কমিটির পরিচিতি পর্ব। শেষপর্বে র্যাফেল ড্র অনুষ্ঠিত হয়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অ্যালামনাই পুনর্মিলনী প্রমাণ করল যে, সময় যতই কেটে যাক, স্মৃতি, বন্ধুত্ব এবং সম্পর্কের বন্ধন চিরকাল অটুট থাকে। রাত বাড়লেও প্রাক্তনদের আড্ডা থামছিল না। সেলফির ঝলকানি, কোলাহল আর বিদায়ের প্রতিশ্রুতিতে মুখর হয়ে উঠেছিল কনভেনশন হল। বিদায়ের মুহূর্তে মনে হচ্ছিল, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেবল একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয় এটি আজীবনের সম্পর্কের বন্ধন।












