টাইগারপাস–সিআরবির দ্বিতল সড়কে গাছ কেটে র্যাম্প নির্মাণের প্রস্তাব সংশোধনের আশ্বাস দিয়েছে সিডিএ। গতকাল মঙ্গলবার বিকালে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সম্মেলন কক্ষে মতবিনিময় সভায় সিডিএ চেয়ারম্যান ও কর্মকর্তারা জানান, র্যাম্পের নতুন নকশার প্রস্তাবনা তৈরি শেষে ঈদের পর আন্দোলনকারীদের সাথে আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তবে আন্দোলনকারীরা সভায় জানান, টাইগারপাস–সিআরবি এলাকার দ্বিতল সড়ক নষ্ট করে ও গাছ কেটে কোনো র্যাম্প তারা চান না।
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে নিউ মার্কেট–কদমতলী এলাকা থেকে যেসব যানবহান উঠবে সেগুলোর জন্য টাইগারপাস–সিআরবির দ্বিতল সড়কে গাছ কেটে একটি র্যাম্প নির্মাণ করার প্রস্তাব আছে সিডিএর প্রকল্প পরিকল্পনায়। বিষয়টি জানার পর সোমবার থেকে আন্দোলনে নামে চট্টগ্রামের একাধিক নাগরিক সংগঠন। এই সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবি জানায় রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও পরিবেশবাদী সংগঠন। এর প্রেক্ষিতে গতকাল সিডিএ চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষের সাথে মতবিনিময় সভায় বসেন নাগরিক সমাজ, চট্টগ্রাম এবং সম্মিলিত পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ।
সভার শুরুতে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য সমাজবিজ্ঞানী ড. অনুপম সেন বলেন, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপার সম্ভার চট্টগ্রাম। কিন্তু সভ্যতার আগ্রাসনে সবকিছু যেন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। চট্টগ্রামের চমৎকার প্রাকৃতিক স্থান সিআরবিকে আমরা আগ্রাসন থেকে রক্ষা করেছি। দেশরত্ন শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে বহু উন্নয়ন করেন, যা ঈর্ষণীয়। উন্নয়ন তো দরকার। কিন্তু পরিবেশ বিঘ্নিত হলে সব উন্নয়নই ব্যর্থ হয়ে যাবে। খালি শতবর্ষী গাছের কথাই নয়। ১৪–১৫টি র্যাম্প করা হচ্ছে। ২–৩টি র্যাম্প হলেই চলে। অতিরিক্ত র্যাম্পগুলো শহরে যানজটের সৃষ্টি করে। এলিভেটেড এঙপ্রেসওয়েতেও যানজট হবে। বিশেষ করে দ্বিতল রাস্তা এক অপূর্ব সুন্দর জায়গা। সেখানে আমার মনে হয় না র্যাম্পের কোনো প্রয়োজন আছে। হলে একটি কুৎসিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে।
তিনি বলেন, আমিও তো আরবান প্ল্যানিংয়ের ছাত্র। আরবান প্ল্যানিং হবে এমন, যেখানে প্রাকৃতিক পরিবেশ অবশ্যই বজায় রাখতে হবে এবং জঞ্জাল যেন সৃষ্টি না হয়। এলিভেটেড মানেই উপর দিয়ে দূরদূরান্তের গাড়ি যাবে। সব রাস্তায় সেটাকে কেন নামাতে হবে? বেশি র্যাম্প এলিভেটেড এঙপ্রেসওয়ের মধ্যেই যানজট সৃষ্টি হবে। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, ঢাকায় র্যাম্প অনেক কম। কোলকাতায় ইডেন থেকে এলিভেটেড এঙপ্রেসওয়ে উঠে থিয়েটার রোডে নামছে। মাঝে কোনো র্যাম্প নেই। এটা ধনী লোকের জন্য। নিচের রাস্তা যদি বারবার খোঁড়েন সেটাও ছোট হয়ে যায়। ৪৮ সাল থেকে এই দ্বিতল সড়কটি দেখে আসছি। চমৎকার সুন্দর সেই অংশটি যেন কোনোভাবে নষ্ট না হয়। দ্বিতল রাস্তা কোনোভাবে নষ্ট করা যাবে না।
এরপর আন্দোলনকারীদের পক্ষে অধ্যাপক শফিক আহমেদ চৌধুরী বলেন, এখানে কোনো র্যাম্প আমরা চাই না। বরং যত র্যাম্প হচ্ছে সেগুলোই অনেক বেশি।
সিডিএর প্রকল্প পরিচালক মাহফুজুর রহমান বলেন, শতবর্ষী গাছ কাটা হবে না। শুধু একটি শতবর্ষী গাছের ডাল কাটা যাবে। র্যাম্প যদি এখানে তুলতে চাই ডিজাইন আরেকটু মডিফাই করব। ঈদের পরে আপনাদের দেখাব। সবাই যদি মত দেন, তাহলে কাজ বাস্তবায়ন করা আমার দায়িত্ব। সেখানে র্যাম্প দরকার না হলে করব না।
সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, র্যাম্পের বিষয়টি জনঘনত্ব অনুসারে ঠিক করা হয়। এখানে না করলে ২ নম্বর গেট থেকে উঠতে হবে। প্রতি বছর গাড়ি বাড়ছে। পোর্ট সিটি বলে ট্রাক, লরির সংখ্যা বেশি। ৫০–১০০ বছর পরে গাড়ি যে বাড়বে তার উপর ডিজাইন। ওঠানামা সহজ করব, এটা টার্গেট ছিল। এলাকার গুরুত্ব বিবেচনা করে প্রস্তাব করা হয়। চট্টগ্রাম শহরে পরিবেশ বিধ্বংসী কিছু করব না। গাছ কেটে আমরা কোনো র্যাম্প করব না। নতুন ডিজাইন করে জানাব। দ্বিতল রাস্তা নষ্ট করব না।
এ সময় আন্দোলনকারীরা টাইগারপাস–সিআরবি অংশে র্যাম্পটি বাতিলের দাবি জানাতে থাকেন। এই পর্যায়ে নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব ও নগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ইব্রাহিম হোসেন বাবুল বলেন, চট্টগ্রামের মানুষের সেন্টিমেন্টের বাইরে উনারা (সিডিএ) কিছু করবেন না। আমরা বিশেষজ্ঞদের নাম দেব। সবাই মিলে যেটা ঠিক করব সেভাবে হবে।
কবি–সাংবাদিক কামরুল হাসান বাদল বলেন, চট্টগ্রামের জনগণ এটা চায় না। এখানে র্যাম্প করবেন না। এখানে টোল দিয়ে উঠতে হবে। সাধারণ মানুষ এই এলিভেটেড এঙপ্রেসওয়ে ব্যবহার করতে পারবে না। এখানে কোনো র্যাম্প করবেন না।
ডা. মনজুরুল করিম বিপ্লব বলেন, আপনারা লালখান বাজারেও এলিভিটেড এঙপ্রেসওয়ের জন্য পাহাড় কেটেছেন। অনেক র্যাম্প করেছেন। যারা এলিভেটেড এঙপ্রেসওয়ে ব্যবহার করবে তারা জিইসি মোড় বা আগ্রাবাদ থেকে উঠতে পারবে। এই অনন্য সড়কটি নষ্ট করার কোনো প্রয়োজন নেই।
সবার বক্তব্য শুনে ঈদের পর আন্দোলনকারী ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বসে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা হবে বলে আশ্বাস দেন সিডিএ চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষ।
সভায় উপস্থিত ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমান, দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান, পিপল’স ভয়েসের সভাপতি শরীফ চৌহান, বিএফইউজের যুগ্ম মহাসচিব মহসীন কাজী, প্রেস ক্লাবের সহসভাপতি চৌধুরী ফরিদ, ন্যাপ নেতা মিটুল দাশগুপ্ত, সাংস্কৃতিক সংগঠক প্রণব চৌধুরী, রাজনীতিবিদ হাসান মারুফ রুমি ও আন্দোলনকারী রিতু পারভী।
এদিকে দ্বিতল সড়ক রক্ষা ও শতবর্ষী গাছ না কাটার দাবিতে গতকাল সকালে ও দুপুরে দ্বিতীয় দিনের মতো কর্মসূচি পালন করেছে সম্মিলিত পরিবেশ রক্ষা আন্দোলন এবং নাগরিক সমাজ, চট্টগ্রাম। সম্মিলিত পরিবেশ রক্ষা আন্দোলন শতবর্ষী গাছে লাল কাপড় জড়িয়ে এবং হাতে ব্যানার নিয়ে প্রতিবাদে সামিল হয়। অন্যদিকে নাগরিক সমাজ সিডিএর প্রধান ফটকে মানববন্ধন করে।