বাংলাদেশের বৃহত্তম উপজেলাগুলোর মধ্যে অন্যতম চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলা। ১৯১৮ সালে ফটিকছড়ি থানায় হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করলেও ১৯৮৩ সালে ফটিকছড়িকে উপজেলা হিসেবে উন্নীত করা হয়। বর্তমানে এই উপজেলায় দুটি থানার অধীনে দুটি পৌরসভা এবং ১৮টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। ৭৭৩.৫৫ বর্গ কিলোমিটার আয়তন অনুযায়ী ফটিকছড়ি বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার সবচেয়ে বড় উপজেলা। লোকসংখ্যা প্রায় ৬,৪২,০৭৬ জন। বাংলাদেশের অত্যন্ত পুরাতন উপজেলা হিসেবে আয়তনে প্রায় ফেনী জেলার সমান এই উপজেলার অবকাঠামোগত উন্নয়নের অনেকটা পিছিয়ে আছে। এর অন্যতম কারণ বিশাল আয়তন। উপজেলার মানুষদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল উপজেলাকে অন্তত তিনটি উপজেলায় ভাগ করা। যাইহোক সরকারি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার পর গত ৮ সেপ্টেম্বর প্রাক নিকার সচিব কমিটির সভায় ফটিকছড়ি উপজেলাকে ভেঙ্গে ফটিকছড়ি উত্তর উপজেলা নামক আরেকটি নতুন উপজেলা গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। উপজেলার মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি অনুযায়ী এই নতুন উপজেলাকে যেখানে সর্বস্তরের জনগণ স্বাগত জানানোর কথা, সেখানে উল্টো চিত্র দেখতে যাচ্ছে। সংযুক্তির জন্য প্রস্তাবিত ৬টি ইউনিয়নের মধ্যে ৫টি ইউনিয়নের জনগণের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। প্রতিবাদে উত্তাল ৫টি ইউনিয়নের জনগণ বিভিন্ন ধরনের আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। এর মূল কারণ সরকারি নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে, জনগণের মতামত উপেক্ষা করে, অযৌক্তিকভাবে গুটিকয়েক মানুষের ব্যক্তিগত অভিলাষ এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে সমগ্র উপজেলায় মানুষের মধ্যে ক্ষোভ, হতাশা এবং আন্দোলনের ভয়াবহতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
উপজেলার দক্ষিণের বৃহত্তর সুয়াবিল এলাকার মানুষের ক্ষোভের কারণ একটি কুচক্রী মহল সরকারের এই মহৎ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা ও আইনি জটিলতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ফটিকছড়ি উপজেলা হতে সুয়াবিল ইউনিয়নকে প্রস্তাবিত ‘ফটিকছড়ি উত্তর’ উপজেলার সাথে সংযুক্ত করে গত ৮ সেপ্টেম্বর তারিখে প্রাক নিকার সচিব কমিটির সভায় ৯নং এজেন্ডাভুক্ত করে অপ্রত্যাশিতভাবে প্রস্তাব পাশ। এই খবরে বৃহত্তর সুয়াবিল ইউনিয়নের সর্বস্তরের জনগণ উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করে। এই এলাকার জনগণ মনে করে ‘ফটিকছড়ি উত্তর’ (প্রস্তাবিত) উপজেলার সাথে সুয়াবিল ইউনিয়ন ও নাজিরহাট পৌরসভার অংশ বিশেষকে সংযোজন করা হয়রানিমূলক, প্রচলিত আইন ও জনস্বার্থ বিরোধী।
প্রস্তাবিত ‘ফটিকছড়ি উত্তর’ উপজেলার মাঠ প্রশাসনের কাজ শুরু হয় মূলত ২০২১ সাল থেকে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফটিকছড়ি স্মারক নং–২৭৩ (০১/০৩/২০২১ তারিখ), স্মারক নং ৯০/০১ (০৫/০৯/২০২৩ তারিখ) এবং জেলা প্রশাসক চট্টগ্রামের ২৪/০৯/২০২৩ তারিখের পত্রমূলে প্রেরিত প্রতিবেদনে ভূজপুর থানার ৬টি ইউনিয়ন থেকে দুরত্ব ও অবস্থানগত কারণে বৃহত্তর সুয়াবিল ইউনিয়নকে বাদ দিয়ে বাকি ৫টি ইউনিয়ন অন্তর্ভুক্ত করে ‘ফটিকছড়ি উত্তর’ উপজেলা গঠনের বিষয়ে সুস্পষ্ট ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
ভৌগলিকভাবে যোগাযোগ ব্যবস্থায় বৃহত্তর সুয়াবিল ইউনিয়ন হতে প্রস্তাবিত ‘ফটিকছড়ি উত্তর’ উপজেলা হেড কোয়াটার সমূহের (বাগানবাজার, দাতমারা ও নারায়নহাট) দূরত্ব যথাক্রমে ৪০ কি.মি., ৩০ কি. মি. এবং ২২ কি. মি.। অথচ ফটিকছড়ি উপজেলা সদরের দূরত্ব মাত্র ৪.৫–৫ কি.মি.। প্রস্তাবিত উপজেলার সাথে সুয়াবিলকে সংযোজন করলে অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, যানবাহনের অপ্রতুলতার কারণে আইন শৃঙ্খলা রক্ষা ও জনসেবার পরিবর্তে বৃহত্তর সুয়াবিল ইউনিয়নের অধিবাসীদের দুর্ভোগ আরো অনেকগুণ বাড়বে। এই ধরনের কার্যক্রম বাস্তবায়নে সরকার জনগণের মতামতের প্রাধান্য ও গণশুনানির ব্যবস্থা করা হয়। এ ক্ষেত্রে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে কোন গণশুনানি না করে সুয়াবিল এলাকার জনগণের উপর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে, যার পরিণতি কখনো সুখকর নয়।
ইতিমধ্যে সুয়াবিল ইউনিয়নের অংশ বিশেষ (১, ২ ও ৩নং ওয়ার্ড) নাজিরহাট পৌরসভার অংশ হিসাবে ফটিকছড়ি উপজেলার সাথে সম্পৃক্ত। প্রস্তাবিত ‘ফটিকছড়ি উত্তর’ উপজেলার সাথে পৌরসভার অংশকে সংযুক্ত করা হলে এতে দ্বৈত প্রশাসনিক জটিলতার সৃষ্টি হবে।
ফটিকছড়ি উত্তরের তিন ইউনিয়ন বিশেষ করে বাগান বাজার, দাঁতমারা এবং নারায়ণহাট ইউনিয়নের মানুষের ক্ষোভের অন্যতম কারণ উপজেলা হেড কোয়ার্টারের অবস্থান নিয়ে। এই তিন ইউনিয়নের আয়তন প্রস্তাাবিত উপজেলার প্রায় ৬৫% এলাকা এবং জনসংখ্যার শতকরা হার প্রায় ৬২%। দূরত্বের দিক থেকেও ফটিকছড়ি উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে সীমান্তবর্তী উপজেলা রামগড় সংলগ্ন। দীর্ঘদিন ধরে তারা উপজেলার সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এই অবস্থায় তাদের তিন ইউনিয়নের (বাগান বাজার, দাঁতমারা এবং নারায়ণহাট) যেকোন মাঝামাঝি যৌক্তিক স্থানে তারা ফটিকছড়ি উত্তর উপজেলা সদর স্থাপন করতে চায়। ফটিকছড়ি সদর থেকে মাত্র ৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ভুজপুর এলাকায় যদি ফটিকছড়ি উত্তর উপজেলার হেডকোয়ার্টার হয় তাহলে তিন ইউনিয়নের মানুষ নতুন উপজেলার সুবিধা থেকে বঞ্চিত থেকে যাবে। এই তিন ইউনিয়নের জনগণ তাদের স্ব স্ব এলাকায় উপজেলা হেডকোয়ার্টারের দাবিতে ইতিমধ্যে রাস্তায় নেমে এসেছে। তারা কিছুতেই ভুজপুর এলাকায় উপজেলা হেডকোয়ার্টার মেনে নিবে না। আবার দক্ষিণের হারুয়ালছড়ি ইউনিয়নের মানুষও চায়না নতুন উপজেলার সাথে সম্পৃক্ত হতে। তারা ইতোমধ্যে মানববন্ধন, সংবাদ সম্মেলন সহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে ফটিকছড়ি উপজেলা সদরের সাথে থাকার জন্য। প্রস্তাবিত ফটিকছড়ি উপজেলার সাথে সংশ্লিষ্ট ৬ ইউনিয়নের মধ্যে ৫ ইউনিয়নের মানুষের জনমত উপেক্ষা করে প্রস্তাবিত ফটিকছড়ি উত্তর উপজেলা বাস্তবায়ন করা অন্যায্য এবং অগ্রহণযোগ্য হবে।
জন–আকাঙ্ক্ষাকে উপেক্ষা করে, গণশুনানি না করে, সরকারী তথ্য বিকৃত করে সুন্দর একটি সিদ্ধান্তকে যারা বিতর্কিত করেছে তাদের খুঁজে বের করে শাস্তির আওতায় আনা জরুরি। বৃহত্তর সুয়াবিল ইউনিয়নবাসীর দাবীর প্রতি সরকারের সানুগ্রহ হস্তক্ষেপে প্রস্তাবিত ‘ফটিকছড়ি উত্তর’ উপজেলা হতে বৃহত্তর সুয়াবিল ইউনিয়নের নাম বাদ দিয়ে প্রস্তাবিত ‘ফটিকছড়ি উত্তর’ উপজেলা বাস্তবায়নের অনুরোধ জানাচ্ছি। আয়তন, দূরত্ব, জনসংখ্যার হার এবং জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে যৌক্তিক স্থানে উপজেলা সদর স্থাপন করলে প্রস্তাবিত ফটিকছড়ি উত্তর উপজেলার সুন্দর বাস্তবায়ন সম্ভব হবে।
লেখক : প্রফেসর, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।












