দীর্ঘদিন পর বেল বাজার শব্দ শুনলাম। অদ্ভুত এক শিহরণ ছড়িয়ে পড়লো সারাদেহ মনে। দারুণ উচ্ছ্বাস নিয়ে প্রবেশ করলাম প্রেক্ষাগৃহে। আলো জ্বলে উঠলো। শুরু হলো আমার পঠিত অসাধারণ একটি নাটক ‘সারারাত্তির।’ বাদল সরকারের নাটকের মধ্যে একেবারে ভিন্নধর্মী একটি ভাবনা ‘সারারাত্তির’। প্রসেনিয়াম-এর প্রথম প্রযোজনা ‘সারারাত্তির।’ নির্দেশনা দিয়েছেন মোকাদ্দেম মোরশেদ। ইতিমধ্যে মোকাদ্দেম মোরশেদ-এর মৌলিক নাটক এবং নির্দেশনা প্রশংসা কুড়িয়েছে সারা দেশে।
নাটকের সমালোচনা নিয়ে আমার নিজের মধ্যে একটা সংশয় আছে। সংশয়টা আসলে সম্পর্কের কথা ভেবে। কিন্তু আমার মনে হয়েছে ‘প্রসেনিয়াম’-এর ঐ ধৈর্য আছে। তাই লিখতে সাহসী হলাম।
নাটকটির সময়কাল পুরনো হলেও খুব প্রাসঙ্গিক বর্তমান সময়ে। যেমন প্র্রাসঙ্গিক বাদল সরকারের আরেকটি কালজয়ী নাটক ‘এবং ইন্দ্রজিৎ।’ একটু বলে রাখি সৌভাগ্যক্রমে বাদল সরকারের সাথে দেখা করার পুণ্য আমি অধম অর্জন করেছিলাম। তখন হয়তো স্পেসিফিক ‘সারারাত্তির’ নিয়ে আলোচনা হয়নি । আলোচনা হয়েছিল নাটক লেখার ক্ষেত্রে উনার দার্শনিক ভাবনা নিয়ে।
‘সারারাত্তির’ নাটকটি শুরু হয় প্রবল বৃষ্টির মধ্য দিয়ে। এক দম্পতি ছুটিযাপনে বের হয়ে প্রবল বৃষ্টির তোপে পড়ে খোলামাঠের ধারে একটি পোড়োবাড়িতে আশ্রয় নেয়। বৃৃষ্টির ঘোরটা এমন যে ঐ পোড়োবাড়িতে রাতকাটানো ছাড়া আর কোন উপায় নেই। আর সেখানে তারা আবিষ্কার করে এক পৌঢ় ব্যক্তিকে। যার অভ্যুদয় ঘটে একটা ভৌতিক ধুম্রজালের ভিতর দিয়ে। তারপর সেই প্রৌঢ়ের আতিথেয়তা, আন্তরিকতা এইসবের পাঁচিল ডিঙিয়ে অদ্ভুত এক সত্য বেরিয়ে আসে। তা হলো সম্পর্কের প্রতিরূপ। সাত বছরের বিবাহিত জীবনে ঐ দম্পতির কাছে যা ছিল অজানা, অচেনা। ওরা উপলব্ধি করে যে কেবল কাছে থাকলে কাছের মানুষ হওয়া যায় না। পারস্পরিক বোঝাপড়ার অলক্ষ্যে একটা অদেখা ফাঁক যেন ওদের সম্পর্কের বুননে রেখাপাত করে। আর এই উপলব্ধির আয়নায় দুজনকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে সম্পর্কের সেই অদেখা রূপকে আবিষ্কারে অনুঘটক হয়ে কাজ করে প্রৌঢ়। রাত গভীর হতে থাকে, বৃষ্টিপ্লাবিত রাতে ভেসে যায় ছকবাঁধা সংস্কারের প্রাচীর, রাত্রি শেষ হতে হতে জেগে ওঠে অন্যরঙের এক প্রেমময় দিগন্তরেখা। রেখে যায় একটি প্রশ্ন। এ রাত কি সত্য? এ রাত কি সত্যিই এসেছিল ঐ দম্পতির জীবনে? সমস্তটাই কি কল্পনা? দুঃস্বপ্নের রাত? নাকি কারো স্বপ্নবোনা একটি রাত! সারারাত্তির! এই হলো নাটকের কাহিনি। মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের ভিতর স্যুরিয়ালিস্টিক হাওয়াও সমান প্রবাহমান।
আমি সমগ্র নাটকের মধ্যে বিশেষ করে অভিনয়টা নিয়ে কিছু বলতে চাই। নিজেও যেহেতু কোন এককালে অভিনয়টা একটু-আধটু করতাম তাই ঐ ক্ষেত্রে আমার মনোনিবেশটা একটু বেশি। ভাল অভিনয় হলে অনেকেক্ষেত্রে সেট লাইট -এর প্রভাব আমার চোখ এড়িয়ে যায়। সমগ্র নাটকে মূলতঃ ৩টি চরিত্র। যুবক, যুবতী এবং প্রৌঢ়। প্রথমে আমি প্রৌঢ় চরিত্রটির রূপায়ন সম্পর্কে কিছু বলতে চাই। এ-চরিত্রে অভিনয় করেছেন প্রতীক গুপ্ত। বেশ সিরিয়াস একজন অভিনেতা। ছাত্রজীবনে উনার বেশ ভাল কিছু কাজ দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। চরিত্রটির বয়স কোথাও উল্লেখ নেই কিন্তু পৌঢ়। ঘুমহীন প্রৌঢ়ের চোখজুড়ে অন্ধকার এসে যেন ভিড় করে আছে। অনেকটা সময় একা ভাবনার রাজ্যে থাকেন বলে একটু হেয়ালি, আনমনে কবিতা বলে চলার এক অদ্ভুত ঘোর অবয়বজুড়ে। সেই ভাবনার স্পর্শটুকু অভিনয়ে খুঁজে পেলাম না। অভিনেতা শব্দের গূঢ় অর্থকে বোঝাতে গিয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শব্দের উচ্চারণের সময় সুরটাকে প্রলম্বিত করেছেন। যার ফলে মনে হয়েছে সমগ্র বাক্যের অন্তর্গত অর্থটা মূল অর্থের কাছাকাছি যায়নি। ফলে স্বাভাবিক বলাটা তার দিশা হারিয়েছে। তাই মনে হয়েছে সংলাপের গঠন নিয়ে আরো দীর্ঘ পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন আছে। কারণ সংলাপ বলার ধরণটা এতো গুরুত্বপূর্ণ যে তা অভিনেতার চরিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে দারুণভাবে প্রভাব বিস্তার করে। উচ্চারণ বেশ ভাল। একটা শব্দও আমার শোনা থেকে বিচ্যুত হয়নি। এবার আসি মেয়েটার চরিত্র। বয়স ৩৫। সবকিছুতে বর্তমান কিন্তু হেঁয়ালি। অনিদ্রাজনিত কারণে মাঝরাতে একা বসে থেকে থেকে সে তার ভিতর এক ইচ্ছাকূপের সন্ধান পেয়েছে। সেই ইচ্ছাকূপে আছে তার বিবাহিত জীবনে না পাওয়া যত কথা। প্রতিদিন মাঝরাতে ইচ্ছাকূপে সে ডুব দেয়। ওখানে তার সাথে একজনের দেখা হয়। যার সাথে নিজের যাপিত ভাবনার অদ্ভুত মিল খুঁজে পায় সে। ইচ্ছাকূপের নায়কের চরিত্রটি অনেকটা ‘রক্তকরবী’র রঞ্জনের মতো। ইচ্ছেপূরণের ঘাটতির কারণে মেয়েটি সংসারী হয়েও কখনো কখনো সংসারসন্ন্যাসীনি। ভালবেসে বিয়ে করলেও ভালবাসাটা এখন তার কাছে নিতান্ত অভ্যাস ছাড়া আর কিছু নয়। অনেকটা এইরকম একটি ভাবনার চরিত্র সে। এই চরিত্রে অভিনয় করেছেন ফারহানা আনন্দময়ী। যতদূর জানি থিয়েটারে প্রথম পদার্পণ। সেইদিক থেকে বাচনপথ অনেকটা স্বাভাবিক। কিন্তু সংলাপের ওঠা-নামার পথে আরেকটু হাঁটতে হবে। সংলাপের সাথে Physical expression -এর দিকটাও একটু মেলাবার প্রয়োজন আছে। সবকিছুর পরেও সমগ্র অভিনয়ে নিষ্ঠার ছাপ লক্ষনীয়। আগামীতে নিষ্ঠার গোড়ায় আরেকটু জল ঢাললে চরিত্রটি ফলবতী বৃক্ষ হবে তা কিন্তু বেশ বোঝা যায়। সবশেষে যে চরিত্রটি আলোচনার দাবি রাখে সেটা হচ্ছে- যুবক। বয়স ৪২। খুব বাস্তববাদী। সকালে ঘুম থেকে ওঠা, দাঁত মাজা, স্নান করা, ব্রেকফাস্ট করে অফিস যাওয়া, অফিস থেকে এসে টিভি দেখা কিংবা মাঝেমাঝে বৌকে নিয়ে একটু মার্কেটে যাওয়া, রাত ১০ টায় ডিনার এবং অতঃপর ঘুম। এর বাইরে জীবনটাকে আরেকটু অন্যরকম করে ভাবা, জীবনের নতুন কোন মানে খুঁজে বের করা এগুলো যেন ওর কাছে নিরর্থক কোন পাগলামি ছাড়া আর কিছু নয়। এ চরিত্রে অভিনয় করেছেন মিশফাক রাসেল। সংলাপ বলনে স্বাভাবিক। তবে expression বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারেন না। সংলাপ ছাড়া যখন উনি থাকেন তখন মঞ্চে ছোট ছোট business – গুলো করার ক্ষেত্রে আরেকটু মনোযোগের প্রয়োজন। ছোটছোট ত্রুটি-বিচ্যুতির পথ দিয়ে চলতে-চলতে শুধুমাত্র সংলাপের অসাধারণ বুননকৌশল আমাদের কখন জানি সমাপ্তির পথে টেনে নিয়ে যায়। আমরাও হয়তো জীবনটাকে নিয়ে খানিকটা ভাবতে বসি।
নাটকে আলো চরিত্রকে চিনিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে আরাম দেয় বটে কিন্তু সমগ্রতাজুড়ে যে একটা Mysterious ছাপ আছে সে ক্ষেত্রে আলো তার দুয়ার খুলতে পারেননি । আলোয় যে মুহূর্ত তৈরি করার খেলা আছে তা তেমন করে চোখে পড়েনি।
নাটকের আবহ নিয়ে আরো অনেক ভাবার অবকাশ আছে। নাটকে শুরুর আবহ এবং কোরিওগ্রাফির ব্যবহার তেমন কোন illusion তৈরি করেছে বলে আমার মনে হয়নি। নাটকের শেষের গানটি মিউজিক ছাড়া খালি গলায় হলে ভাল লাগতো। থিয়েটারে ভিতর থেকে গান বেজে ওঠা এবং অভিনেতার ঠোঁট মেলানো ব্যাপারটা খুব দৃষ্টিকটু।
নাটকের সেট-এর মধ্যে mysterious ব্যাপারটা খুঁজে পেলাম না। এত কিছু বলছি কেননা নাটকটা শেষ পর্যন্ত দেখার জন্য আমরা বসেছিলাম। নতুন দল হিসাবে প্রসেনিয়ামকে মনে হয়েছে অনেকদূর এগিয়ে। নিষ্ঠা থাকলে ভবিষ্যতে বেশ কিছু ভাল প্রযোজনার দেখা পাবো বলে আশা রাখি।