উন্নয়নের স্বয়ংক্রিয় ধারা বেগবান ও চলমান রাখার নিমিত্ত দেশের জনসংখ্যাকে মানব সম্পদে পরিণত করতে প্রয়োজন শিক্ষা। আর শিক্ষা বিস্তারের এই মহান অথচ দুরূহ দায়িত্বটি নিরলসভাবে– অনেকটা মায়ায় পালন করে থাকেন শিক্ষক। এ জন্য শিক্ষাকে ‘জাতির মেরুদণ্ড’, আর শিক্ষককে ‘শিক্ষা ব্যবস্থার মেরুদণ্ড’ বলা হয়। তবে সে শিক্ষাটি হতে হবে সুশিক্ষা; যার জন্য প্রয়োজন হয় সুশিক্ষকের। জীবনের সাথে জীবনের আশ্রয়স্থল খোঁজার নামই শিক্ষা অর্থাৎ মানুষ অপার শক্তির মহিমা অনুসন্ধান ও আবিষ্কারে আত্মজিজ্ঞাসার যে উন্মেষ ঘটায় তাই শিক্ষা। অন্যদিকে যে শিক্ষা মানুষকে মনুষ্যত্বের বিকাশের মাধ্যমে চরিত্রবান, সুশীল, পরিমার্জিত, সংস্কৃতিবান ও আদর্শবান করে গড়ে তোলে তাই সুশিক্ষা। সুশিক্ষা মানুষকে সৎ চিন্তা ও সৎ কর্মে উদ্দীপ্ত করে কর্মকৌশল উদ্ভাবনের মাধ্যমে দক্ষতার উন্নয়ন ঘটায়। অর্থাৎ যে শিক্ষায় মানবীয় গুণাবলী বিকশিত হয় সৎ, যোগ্য ও চরিত্রবান নাগরিক তৈরি হয় তাই সুশিক্ষা। সুশিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর কোমল হৃদয়কে আন্দোলিত করে তাদেরকে সুদক্ষ, সৃজনশীল, দায়িত্বশীল, দেশপ্রেমিক, কর্তব্য পরায়ণ, নিষ্ঠাবান, সৎ ও যোগ্য জনসস্পদে রূপান্তরে সুশিক্ষকের ভূমিকা অপরিসীম। শিক্ষক বলতে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দায়িত্বরত থেকে ছাত্রদের সুশিক্ষা প্রদানের ব্যাপারে যাঁরা নিয়োজিত থাকবেন, তাঁদেরকে বুঝানো হয়েছে। অন্যদিকে নৈতিকতা ও বিবেকবোধ সম্পন্ন মানবিক মূল্যবোধ সমৃদ্ধ শিক্ষকই সুশিক্ষক। শিক্ষক হলেন শিক্ষাগুরু; যাঁর মর্যাদা অবস্থানগতভাবে সমাজের সবার উর্ধ্বে। যে সমাজে শিক্ষককে সম্মান দেয়া হয় না, সে সমাজে মানুষ তৈরি হয় না। শিক্ষার্থীর সামাজিকীকরণ ও তাদের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধের ভিত নির্মাণ এবং সামাজিক পরিবর্তনে শিক্ষক অনুঘটক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে থাকেন। তাই শিক্ষকতা কোনো পেশার নাম নয় বরং এটা নেশা। শিক্ষক হলেন মানুষ গড়ার কারিগর। মানুষ হয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো কারখানায় মানুষ তৈরির কাজটি অত্যন্ত জটিল এবং সংবেদনশীল। একজন সুশিক্ষক জটিল এ কাজটিকে সহজতর করে থাকেন পূত–পবিত্র হৃদয়ের ছোঁয়ায় ভালোবেসে আর জ্ঞান ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর আত্মাকে উদ্বেলিত করার মাধ্যমে। সুশিক্ষক সবসময় সুশিক্ষিত, সুদক্ষ ও সুনিপুণ যিনি আলোক বর্তিকার মতো উদ্ভাসিত হতে থাকেন মমতা, ন্যায়পরায়ন, দয়ালু, সরলতা, কর্তব্যপরায়ণ, বিনয়ী ও দেশপ্রেমের আলোক ছটায়। শিশু হয়ে জন্মগ্রহণ করা একটি অপরিপক্ক মানব সন্তান শুরুতে মা–বাবার নিবিড় তত্ত্বাবধানে বেড়ে উঠতে থাকে এবং জীবনের অনুবর্তিকায় প্রাক–শৈশব, শৈশব, বয়:সন্ধি, যৌবন, বয়স্কতা হয়ে বার্ধক্যে উপনীত হয়। প্রাক–শৈশব অতিক্রম করার পর মানব সন্তান বিদ্যালয় নামক শিক্ষাগৃহে বাবা–মার বন্ধন তুচ্ছ করে সুশিক্ষা অর্জনের অভিপ্রায়ে এক অজানা অদৃশ্য শূন্যতায় যে মানুষগুলোর কোমল স্নেহস্পর্শী ছোঁয়ায় প্রাণোচ্ছল ও গতিময় হয়ে ওঠে তারাই হলেন শিক্ষক। শিক্ষকের প্রভাব অনন্তকালে গিয়েও শেষ হয় না। অর্থাৎ একজন সুশিক্ষকের কখনো অবসর হয় না। শিক্ষার্থীর প্রমোশন হয়, প্রতিষ্ঠানের বদল হয় কিন্তু শিক্ষক তাঁর হৃদয়ের সুদৃষ্টি সুপ্রসারিত করে অপরিবর্তিতই থেকে যান অনাদি অনন্তকাল! একজন সুশিক্ষক তাঁর শিক্ষার্থীকে কী চিন্তা করতে হবে তা না শিখিয়ে, কীভাবে চিন্তা করতে হবে তা শিখিয়ে দেন। অর্থাৎ শিক্ষার্থীর সৃজনশীলতা ও মননশীলতাকে এমনভাবে গড়ে তোলেন যাতে তারা স্বাধীনভাবে চিন্তা করার মানসিকতা অর্জনে সক্ষম হয়। তাইতো সুশিক্ষক একজন দার্শনিক। ‘দর্শনবিহীন শিক্ষক কাণ্ডারী বিহীন নৌকার মত’। শিক্ষার্থীর কাছে শিক্ষক হবেন বিজ্ঞ, প্রাজ্ঞ, দক্ষ, নিষ্ঠাবান ও দার্শনিক। আমাদের যাপিত জীবনে প্রত্যেক মানুষের সবচেয়ে বেশি যা প্রয়োজন তা হল পারিবারিক শিক্ষা। আর এগুলো রপ্ত করতে হয় প্রথমত পরিবার থেকেই। কারণ সভ্যতা, ভদ্রতা, নৈতিকতা, কৃতজ্ঞতা বোধ, অপরের প্রতি শ্রদ্ধা–স্নেহ, পরোপকার, উদার মানসিকতা– এগুলো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে খুব বেশি অর্জন করা যায় না। একাডেমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পড়ালেখা করে শিক্ষিত হওয়া যায়, মেধাবী হলে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করে দেশের সীমানা পেরিয়ে ভিনদেশেও নাম কুড়ানো যায়; কিন্তু পরিবার থেকে সুশিক্ষা না পেলে একসময় সব শিক্ষাই ম্লান হয়ে যাবে। গ্রাম্য ভাষায় একটা প্রবাদ চালু আছে: থলি যদি ভালো হয়, তাহলে সেখানে ভালো কিছু থাকবে। আম যদি মিষ্টি হয়, তাহলে তার আঁটিও মিষ্টি হবে। অর্থাৎ আদর্শ পরিবারের সন্তান সুসন্তান হবে এটাই স্বাভাবিক। শিশু যখন নিজ থেকেই হাত–পা নাড়তে শেখে, তখন থেকেই মূলত সে পরিবারের বড়দের কাছ থেকে শিখতে শুরু করে। আর তখন থেকেই তার সামনে বাবা–মা তথা বড়দের কথাবার্তাসহ বিভিন্ন বিষয়ে বেশ সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। বাড়ন্ত শিশুকে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ভালো–মন্দ বিষয়ে অবহিত করতে হয়। তার সঙ্গে নরম সুরে, মার্জিত আচরণে বিভিন্ন বিষয় শেয়ার করতে হয়। শিশুদের মন–মানসিকতা থাকে খুবই কোমল, তাই খুব সহজেই যে কোনো বিষয়ে তারা শিখে নিতে পারে। বড়দের কর্তব্য, আদর–স্নেহের মাধ্যমে বুঝিয়ে তাদের যে কোনো বদঅভ্যাস থেকে বিরত রাখা। কোনো অবস্থায়ই শিশুকে গালমন্দ করা যাবে না। তাই একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে সন্তানকে গড়ার জন্য পিতা–মাতা ও পরিবারের সদস্যদেরই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। সন্তানকে মাঝেমধ্যে কাছে কিংবা দূরে কোথাও প্রকৃতির সান্নিধ্যে নিয়ে যেতে হবে। ভ্রমণেও শিশু অনেক কিছু শিখতে পারে। বর্তমান শহুরে সমাজে অনেক পরিবারের দুই অভিভাবকই থাকেন নিজ কর্মস্থলে ব্যস্ত।
ফলে তাদের কাছ থেকে যতটুকু সময় সন্তানের প্রাপ্য তা থেকে সে হয় বঞ্চিত। তাই কার্টুন ছবি দেখে আর মোবাইল–গেম খেলে শিশু সময় কাটায়। এতে তার মস্তিষ্ক ধারণ করে যতসব উদ্ভট চিন্তা। বাবা–মা’কে সন্তানের সঙ্গে বন্ধুত্বসুলভ আচরণ করতে হবে। তাহলে সন্তান সবকিছুই বাবা–মা’র সঙ্গে শেয়ার করবে। যে সন্তান শেয়ার করতে শিখবে সে কখনও আদর্শহীন হবে না। ঘরের পরিবেশ ভালো বলেই যে সন্তান সভ্য–ভদ্র ও আদর্শবান হবে তা ঠিক নয়। সন্তান কাদের সঙ্গে মেশে, বন্ধুত্ব করে সেদিকেও দৃষ্টি রাখতে হবে। মোটামুটি পাঁচ–ছয় বছর বয়স থেকেই শিশুর মধ্যে নিজস্ব সম্মানবোধ সৃষ্টি হয়। অবশ্যই ছোট থেকেই সন্তানের সামনে সুশিক্ষার বিষয়ে আলোচনা এবং তার মধ্যে তা চর্চার প্রচলন ঘটাতে হবে। শিক্ষিত হওয়ার জন্য যেমন একাডেমিক শিক্ষার প্রয়োজন, তেমনি সন্তানকে সুস্থ মানসিকতার ধারক–বাহক করার জন্য সভ্যতা–ভদ্রতা–নৈতিকতা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার মতো মননের অধিকারী করে গড়ে তুলতে হবে। মোদ্দা কথা, বিচক্ষণ বাবা–মা বা অভিভাবকদের সন্তানরাই সমাজে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠে।
লেখক: কলেজ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক।