প্রসঙ্গ : বিশ্বপ্রেক্ষাপটে খাদ্য নিরাপত্তা কতটা জরুরি

রতন কুমার তুরী | সোমবার , ১৪ নভেম্বর, ২০২২ at ৭:৫৮ পূর্বাহ্ণ

শস্যভাণ্ডার নামে খ্যাত ইউক্রেন এবং রাশিয়া। সামপ্রতিক দু’টি দেশই যুদ্ধ জড়িয়ে পড়েছে। এমন কী এ যুদ্ধ কবে শেষ হবে কেউ জানে না। ফলে পৃথিবীর অনেক দেশই খাদ্যশস্য নিয়ে পড়েছে বিপাকে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, পৃথিবীর কিছুকিছু এলাকায় খরা, দাবানল, গৃহযুদ্ধ অর্থাৎ বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে সামনের দিনগুলোতে অনেকেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা করছেন। ফলে পৃথিবীর দেশেদেশে খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে বেশ জোরেশোরেই। সামপ্রতিক বাংলাদেশের প্রাধানমন্ত্রীও সামনের দিনগুলোতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন এবং দেশের খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি কীভাবে নিশ্চিত করা যায় খাদ্যনিরাপত্তা বিষয়ে অভিজ্ঞজনেরা দেশের সবাইকে এগিয়ে আসার অনুরোধ করেছেন। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের সিংহভাগ খাদ্য কৃষকশ্রেণি কিংবা কৃষিশ্রেণিভূক্ত পরিবার থেকে আসে এর মধ্যে বেশিরভাগ খাদ্যই ধান। যেহেতু বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ সেহেতু কৃষকরাই এদেশের জনগণের বেশিরভাগ খাদ্যে যোগান দিচ্ছে। বাংলাদেশের ফসলি জমিগুলোর বেশিরভাগ জমিতেই উৎপাদিত হয় ধান। ধান বাংলাদেশের প্রধান খাদ্যও বটে। ধান থেকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত চাল থেকে ভাতই বহুকাল আগে থেকে এদেশের মানুষ ক্ষুধা নিবারণের জন্য খেয়ে আসছে। ধানের বাইরেও এদেশে কিছু কিছু এলাকায় গম, ভুট্টা উৎপাদিত হচ্ছে। ১ লাখ ৪৭ হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশে সর্বমোট আবাদযোগ্য জমি আছে ৮৮.২৯ লাখ হেক্টর জমি তার মধ্যে ৭৮.৭৮ লাখ হেক্টর জমি হচ্ছে কৃষি জমি যেগুলোতে সেচ দেয়া যায়। দেশের বসতবাড়ি এবং কিছু সংরক্ষিত বনাঞ্চল বাদ দিলে সারাদেশে এখনও পতিত এবং অনাবাদি জমি আছে ৪.৩৯ লাখ হেক্টর যা বাংলাদেশের মানুষের জন্য নেহায়েত কম নয়। এসব পতিত এবং অনাবাদি জমিকে আবাদ করে ফসলের আওতায় আনতে পারলে বাংলাদেশের খাদ্যনিরাপত্তা আরো টেকসই এবং মজবুত হবে।
সরকারি বিভিন্ন তথ্যমতে মূলতঃ বর্তমানে দেশে খাদ্য ঘাটতি নেই। দেশে উৎপাদিত খাদ্য সামগ্রী দিয়েই বেশিরভাগ সময় আমাদের চলে গেলেও যতসামান্য বিদেশ থেকে আমদানিও করতে হয়। এসমস্ত খাদ্য বিশেষ করে আনতে হয় দেশের দুর্দিনে দেশে যাতে খাদ্যাভাব দেখা না দেয় তা মজুত রাখার জন্য। খাদ্য নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে বর্তমানে সরকার দেশের বিভিন্ন সরকারি খাদ্যগুদামে প্রায় ১৫ লক্ষ ৬৩ হাজার ৯০ মেট্রিকটন খাদ্য শস্য জমা রেখেছে, যার মধ্যে রয়েছে ১৩ লাখ ৫৩ হাজার ৭ শ ৭ মেট্রিক টন চাল, ১ লাখ ৯৮ হাজার ৩০০ মেট্রিকটন গম এবং ধান জমা রয়েছে ১৭ হাজার ৫৩ টন। পরিসংখ্যান অনুযায়ী আপাতঃ দৃষ্টিতে দেশে খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত আছে কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব যেভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পড়েছে এই যুদ্ধ আরো দীর্ঘায়িত হলে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কাকে একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না, যার কারণে দেশের খাদ্যনিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে আরো গভীরভাবে চিন্তা করে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। প্রয়োজনবোধ দেশের পতিত জমি সমূহ সরকারি উদ্যোগে ফসলি জমির আওতায় আনতে হবে। সরকারের পাশাপাশি জনগণকেও বিশ্বপরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে খাদ্যনিরাপত্তা বিষয়ে এগিয়ে আসতে হবে। জনগণ যদি তাদের আশেপাশের পতিত জমি সমূহে নিজ উদ্যোগে আবাদ করে ফসল ফলায় তাহলে খাদ্যনিরাপত্তার পাশাপাশি তা তাদের জন্য দুর্দিনে কাজে আসবে।
এর বাইরে আমাদের দেশের রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি এই তিন পার্বত্য জেলায় এখনও অনেক দুর্গম জায়গায় বিশাল বিশাল পাহাড় হাজার হাজার হেক্টর জায়গাজুড়ে পতিত রয়েছে। সেসব পাহাড় আবাদ করার মাধ্যমে স্থানীয় জনগণকে চাষাবাদে উৎসাহিত করতে হবে।
সেসব পাহাড়ে যেসব দ্রব্য ফলবে, সেসব দ্রব্যের বীজ রোপের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে সার্বিক সহযোগিতা করতে হবে। প্রয়োজনবোধ ওসব দুর্গম পাহাড়ি এলাকার খাদ্যাভ্যাস বদলাতে হবে, পাহাড়ে যা উৎপাদন হবে তাই খেয়েই জীবিকা নির্বাহ করতে হবে। অন্যদিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মানুষ আলু খেয়েও জীবনযাপন করছে আমাদের দেশে যেসমস্ত জায়গা আলুর ফলন বেশি হয় সেসমস্ত জায়গার মানুষকে আলু দিয়ে প্রস্তুতকৃত খাদ্যদ্রব্যের দিকে ঝুঁকাতে হবে তাহলেই দেশের খাদ্যনিরাপত্তা অনেকটা নিশ্চিত হবে এবং ভবিয্যতে সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষের কবল থেকে রক্ষা পাওয়া সহজ হবে। খাদ্যনিরাপত্তা কিংবা বিভিন্ন দুর্যোগকালীন সময়ে যাতে আমাদের চরম কষ্ট ভোগ করতে না হয় সেজন্য আমাদের উচিত খাদ্যাভ্যাস বদলানো ভাতের উপর বেশি নির্ভর না করে দেশে যাই সহজে উৎপাদন করা যায় তাই খেয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে অভ্যস্ত হওয়া। এর বাইরে স্বপ্লাহারি হতেও চেষ্টা করা উচিত এতে করে কম খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন করেও দুর্দিনের সময় পথচলা যাবে। কোনো অবস্থাতে যাতে খাদ্য দ্রব্যের অপচয় না হয় সে বিষয়ে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে তাহলেই হয়ত দেশে খাদ্যনিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করা অনেকটাই সহজ হবে। প্রকৃতপক্ষে খাদ্যনিরাপত্তার বিষয়টি কোনো দেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ এই খাদ্যনিরাপত্তাই যেকোনো দেশের দুর্ভিক্ষকে আটকিয়ে দিতে পারে। তাই আসুন সরকারের পাশাপাশি আমরাও খাদ্যনিরাপত্তা বিষয়ে সতর্ক এবং কৌশলী হই।
লেখক- কলেজ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধফেলে আসা দিনের কথা
পরবর্তী নিবন্ধউদারপ্রাণ অধ্যক্ষ মোহাম্মদ হোসেন খান