‘রাজধানীতে তেলাপোকা মারার স্প্রে’র বিষক্রিয়ায় শায়েন মোবারত জাহিন ও শাহিল মোবারত জায়ান নামে দুই ভাইয়ের মৃত্যু হয়েছে’ এই খবরটা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরে ঘুরে যখনই চোখের সামনে এসেছে, থমকে দাঁড়িয়েছে দৃষ্টি বাচ্চাদুটোর ছবিতে। কারো উপর কোনো রাগ হচ্ছিল না! দোষারোপ করার মনোবৃত্তিও আর নেই! কী হবে এসব করে, জাহিন আর জায়ানকে তো আর ফিরিয়ে আনা যাবে না। আমি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছিলাম ওদের মা–বাবাও যাতে মরে গিয়ে বেঁচে যায়! কিন্তু না, তা হয়নি, সেরে উঠেছেন দুজন জীবন্মৃত হয়ে আজন্ম বেঁচে থাকার জন্য—
সাবধানতা! আমার মনে হয় না কোনো সাবধানতাই এখানে কাজে আসতো। মূল সমস্যা বিষাক্ত ওষুধ, যা কিনা বড় বড় মিল কারখানায় ব্যবহৃত হয়, ঘরের জন্য তো তা নয়ই নয়। তাহলে প্রতিষ্ঠানটি ব্যবহার করলো কিভাবে! আমরা ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়া যে কোনো ওষুধ–ইনজেকশন ফার্মেসি থেকে কিনতে পারি, এমনকি যে কোনো এ্যান্টিবায়টিকও। ঠিক তেমনি এ ধরনের বিষ ক্রয়–বিক্রয়ের ক্ষেত্রেও মনে হয় না কোন বাধা আছে! প্রতিষ্ঠানের মালিক স্বপ্নেও হয়তো ভাবতে পারেননি যে, এমন ঘটনা ঘটতে পারে! যা হবার হোক কাস্টোমারের হবে, আমাদের কী! এই মনোবৃত্তিতেই হয়তো চালাচ্ছিল ব্যবসা। ব্যবসার কথা ভেবেছে, মানুষের ক্ষতির কথা ভাবেনি। লোভ আমাদের অমানুষে পরিণত করছে দিনদিন। আমরা উন্নত বিশ্বের সাথে তালে তাল মিলিয়ে এগিয়ে তো চলেছি, কিন্তু ওদের মত নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে নয়। আর এ কারণেই এদেশে মানুষের জীবনের মূল্য অতি তুচ্ছ!
নতুন ঘর, পছন্দের সবটা দিয়ে রুমগুলো সাজিয়েছে। বাচ্চাদের স্বাস্থ্যকর পরিবেশ দেয়ার জন্য ঘরকে তেলাপোকামুক্ত করতে গিয়ে আজকে কচি দুটো প্রাণ এভাবে চলে গেল। প্রতিষ্ঠানটির অজ্ঞতা, অসততা, লোভ, অবহেলাই এর মূল কারণ বলে আমার মনে হয়।
সচেতনতা, সহমর্মিতা, মানবিকতা এগুলো এখন শুধু শব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, বাস্তবে এর ছায়াও দেখতে পাওয়া যায় না। সবাই শুধু টাকার পেছনে ছুটছে, যার যতটুকু আছে তাতে কেউ তৃপ্ত নয়। টাকার জন্য যে কোনো ধরনের অপরাধ করতে তারা পিছপা হয় না। এটা যেন একটা ছোঁয়াচে ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে, কিভাবে অল্প সময়ে অনেক টাকার মালিক হওয়া যায়! বিবেক, বোধ, বুদ্ধি, শিক্ষা, মানবিকতা– সব কিছুকে বিসর্জন দিতে দ্বিধা বোধ করে না এরা। আমরা নিজেদের চিন্তা চেতনা নৈতিকতা শাণিত না করেই উন্নত দেশগুলোর সাথে তাল মিলিয়ে বিভিন্ন নতুন অভ্যাসে নিজেকে অভ্যস্ত করে তোলার প্রয়াসে ব্যস্ত। নতুন একটা ব্যবসা খুলতে এখানে না লাগে কোনো অভিজ্ঞতা, লাগেনা কোন প্রশিক্ষণ। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র! সে তো ঘুষ দিয়েই জোগাড় করা যায়। যে কোনো প্রতিষ্ঠান কাজ শুরু করার আগে অনুমতি পত্র, সম্ভাব্যতা যাচাই বাছাই, নিরাপত্তা ক্ষতিয়ে দেখা ইত্যাদির আদৌ কোন ব্যবস্থা আছে কিনা কে জানে!
বেশিরভাগ সময়ে নিয়মাবলী লিপিবদ্ধ অবস্থায় ড্রয়ারেই থেকে যায়, বাস্তবে তার প্রয়োগ আর দেখা যায় না।
অনেক কিছুতেই আমরা আজ অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। এদেশে আমরা যে যার ইচ্ছেমত যা ইচ্ছা তাই করতে পারি, খুলে বসতে পারি যে কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। হেল্পার কোনো ট্রেনিং ছাড়া যাত্রীবোঝাই আন্তঃনগর বাসের ড্রাইভিং সিটে বসে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে অনায়াসে এক শহর থেকে অন্য শহরে যেতে পারে, ডাক্তারী না পড়ে নামের আগে ডাঃ লাগিয়ে তার সাথে এ বি সি ডি‘র দু‘তিনটে অক্ষর নামের শেষে ডিগ্রি হিসেবে লাগিয়ে চেম্বার খুলে বছরের পর বছর চিকিৎসা সেবা দিতে পারে, সার্জন না হয়েও অপারেশন থিয়েটারে আমাদের দেহের উপর দিয়ে নির্দ্বিধায় ছুড়িকাঁচি চালাতে পারে, ল্যাবগুলো পরীক্ষা না করেই সব ধরনের টেস্ট রিপোর্ট প্রদান করতে পারে, ভেজাল খাবার, নকল প্রসাধনী, বিষমেশানো ফল, ছাগলের মাংসের পরিবর্তে কুকুর শিয়ালের মাংস খাওয়ানো ইত্যাদি ইত্যাদি সব পারি। আর সবচাইতে ভালো যেটা পারি,তা হলো উৎকোচ প্রদানের মাধ্যমে অঘটনগুলো সুনিপুণভাবে ধামাচাপা দেয়া —
সোজা বাংলায় এই ঘুষ দেয়া নেয়া যতদিন বন্ধ না হবে, ততদিন নিত্যনতুন অঘটন ঘটতেই থাকবে। জায়ান জাহিনের বাবার মুখে শুনেছি পেস্টকন্ট্রোল প্রতিষ্ঠানটির লোক জানিয়েছিল ৩–৪ ঘন্টা পর ঘরে ঢোকা যাবে, কিন্তু ওরা সবাই ৯–১০ ঘন্টা পর ঢুকেছিল ঘরে। তারপরও দুটো তরতাজা প্রাণ ঝরে গেলো বিষাক্ত গ্যাসের ছোঁয়ায়!
মানুষ যদি বিষও খায়, সময়মত তাকে হাসপাতালে নেয়া হলে স্টমাক ওয়াশ করে তাকে বেশীরভাগ সময় বাঁচানো যায়। আর ঠিক কতটা বিষাক্ত ওষুধ ব্যাবহার করলে নিঃশ্বাসের সাথে সে বিষ দেহে প্রবেশ করা মাত্র তরতাজা দুটো প্রাণ এভাবে ঝরে যেতে পারে! আমার ধারণা যারা বেঁচে আছে, তারাও শারীরিক দিক থেকে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, কিছুদিন পরে হয়তো তা বোঝা যাবে।
প্রায় ছ‘বছর আগে আমার বাসায় উঁইপোকা ধংসযজ্ঞে মেতে উঠেছিল, ভয় পেয়ে একরকম নিরুপায় হয়েই পেস্টকন্ট্রোল
করাতে হয়েছিল। সবাইকে বাড়ির বাইরে বের করলেও আমি লোকগুলোর সাথে ছিলাম। তখন দেখেছি ওদের অদক্ষ হাতের দায়সারা কাজ। ওষুধের গন্ধটা এতটাই তীব্র ছিল যে ওরা বলা সত্ত্বেও আমি দরজা জানালা বন্ধ করতে পারিনি। এরপরও প্রায় চার–পাঁচদিন ঘর থেকে ওই গন্ধ যায়নি। যা ধরতাম, তাতেই সেই গন্ধ ছিল, আর ওই গন্ধে পেট ফুলে যাচ্ছিল। সেই থেকে পেস্ট কন্ট্রোলের আর ধারেকাছে যাইনি। নতুন কিছু পেলে আমরা তা ব্যবহার করার চেষ্টা করি তা যদি সাধ্যের মধ্যে হয়। কিন্তু ব্যবহার করার আগে আমরা জিনিসটা সম্পর্কে ভালোভাবে স্টাডি করি না, যা আমাদের জন্য বিপদ ডেকে আনে।
যাইহোক খারাপের মধ্যেও ভালো খবর হলে, পরবর্তীতে গ্রেপ্তার হয়েছে প্রতিষ্ঠানের এম ডি এবং চেয়ারম্যান, আশাকরি সঠিক বিচার হবে। পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন তারা গাড়িতে গাড়িতে, কোনো বাড়িতে নয়।
এতবড় একটা অঘটন ঘটাবার পর তাদের উচিত ছিল জায়ান জাহিনের পরিবারের পাশে গিয়ে দাঁড়ানো। এধরনের ব্যবসা শুরু করার প্রথমেই এরা বিবেক বিক্রি করে দেয় অসততার কাছে। বিবেক নেই, তাই বিবেকের তাড়না এদের তাড়িত করে না। তাই যদি থাকতো, তাহলে তাদের পাওয়া যেত জায়ান জাহিনের বাবার পাশে।
আমাদের দেশের বিচার কার্যের দীর্ঘসূত্রতার ফলে সঠিক বিচারের মাধ্যমে অপরাধী সাজা পেলেও তা অপরাধ জগতের অন্যান্য বাসিন্দাদের মাঝে তেমন প্রভাব বিস্তার করতে পারেনা। যে কোনো অপরাধের দ্রুত বিচার হলে অপরাধ জগতে তা নাড়া দেয়। আমাদের দেশে বিচার হতে হতে বেশ কয়েকবছর লেগে যায়, আর অপরাধ না কমার এটাও একটা অন্যতম বড় কারন। আমরা আশা করবো এই বিচারটা যেন দ্রুত সম্পন্ন হয়, আর সরকার এই ধরনের যে কোন নতুন প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন দেয়ার আগে যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে এর ভালো–মন্দ উভয়দিক যাচাই বাছাই করে তবেই অনুমতি দিবেন, যাতে জায়ান আর জাহিনের বাবার মত আর কোনো বাবাকে এভাবে তার সন্তান হারাতে না হয়।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গল্পকার