প্রসঙ্গ : চট্টগ্রাম বন্দর

জসীম চৌধুরী সবুজ | সোমবার , ২৭ অক্টোবর, ২০২৫ at ১০:৩৫ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম বন্দরের ট্যারিফ একলাফে ৪৫ শতাংশ বৃদ্ধি করায় ফুঁসে উঠেছে বন্দর ব্যবহারকারী তথা স্টেক হোল্ডারগন। বন্দরের তিনটি টার্মিনাল বিদেশীদের হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধেও জনমত প্রবল হচ্ছে। বিভিন্ন মহলে কথা হচ্ছে, অন্তর্র্বর্তী সরকার কেন এত অতিউৎসাহী হয়ে কাজগুলো করতে যাচ্ছে। তাদের সামনে রয়েছে অগ্নিপরীক্ষা। তিনশ আসনে একই দিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মত মহাযজ্ঞ নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করার চ্যালেঞ্জ সরকারের সামনে। সেই চিন্তা বাদ দিয়ে যে কাজ নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের করার কথা, যে কাজ জাতীয় সংসদে অনুমোদন নিয়ে করার কথা সেসব কাজে কেন অন্তর্র্বর্তী সরকার অতি উৎসাহী হয়ে উঠল।

চট্টগ্রাম বন্দর দেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি। দেশের আমদানি রফতানি বানিজ্যের ৮৫ শতাংশ এই বন্দর দিয়ে হয় বলেই বলা হয়, ‘চট্টগ্রাম বন্দর বাঁচলে দেশ বাঁচবে’। এই বন্দর নিয়ে দেশি বিদেশি ষড়যন্ত্র ছিল এবং তা অব্যাহত আছে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বন্দরের মোহনায় টার্মিনাল করার জন্য স্টিভিডোরিং সার্ভিসেস অব আমেরিকা (এসএসএ) নামে একটি ভূঁইফোড় কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়ার সব আয়োজন প্রায় সম্পন্ন করেছিল। গণআন্দোলনের মুখে সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। সেদিন যদি চট্টগ্রামবাসীসহ সারাদেশ প্রতিবাদে উত্তাল না হত তাহলে আজ এই বন্দর নব্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কলোনি হিসেবে পরিনত হত। আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা ও স্বার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়ত।

বর্তমান অন্তর্র্বর্তী সরকার এর আগে পতেঙ্গা টার্মিনাল সৌদি কোম্পানির হাতে তুলে দিয়েছে। এই টার্মিনাল পুরোটাই বন্দরের নিজস্ব অর্থে নির্মিত। এখন বন্দরের নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল (এনসিটি), লালদিয়ার চর টার্মিনাল এবং নারায়নগঞ্জের পানগাঁও আইসিডি ( অভ্যন্তরীণ কন্টেইনার টার্মিনাল) পরিচালনার দায়িত্ব বিদেশি অপারেটরের হাতে আগামী ডিসেম্বরে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে তা বাস্তবায়নের তোড়জোড় শুরু করেছে। এ জন্য কোনো আন্তর্জাতিক টেন্ডার আহবান করা হয়নি। এসব টার্মিনাল বন্দরের নিজস্ব অর্থে তৈরি। ইক্যুপমেন্ট সংগ্রহ করা হয়েছে বন্দরের তহবিলে। পরিচালনার দায়িত্ব যাদের হাতে তুলে দেওয়ার তোড়জোড় চলছে তারা কোথায় কীভাবে কত পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করবে তা পরিষ্কার করা হয়নি।

প্রাথমিক যে তথ্য তাতে বোঝা যায় তারা শুধু পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে নিয়ে যাবে মধ্যস্বত্বভোগী হিসেবে। সরকারের নৌ সচিব জানিয়েছেন, এনসিটি এবং পানগাঁও আইসিডি লিজ দেওয়া হবে ২৫ বছরের জন্য। লালদিয়ার চর টার্মিনাল দেওয়া হবে ৩০ বছরের জন্য। ২৫ বছরের জন্য দায়িত্ব পেলে যে গেড়ে বসবে তা না বোঝার কোনো কারণ নেই।

এ প্রসঙ্গে সাইফ পাওয়ারটেক নামক একটি প্রতিষ্ঠান কীভাবে কোন প্রক্রিয়ায় চট্টগ্রাম বন্দরে এসে গেড়ে বসেছিল তার কথা বলা যায়। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে ২০০৫ সালে বন্দর কর্তৃপক্ষ জাপানের সুমিতোমো কর্পোরেশন থেকে নতুন চারটি কি গ্যানট্রি ক্রেন সংগ্রহ করে। এই সাপ্লায়ারের লোকাল এজেন্ট ছিল সাইফ পাওয়ার টেক। তখন বাজার মূল্যের দ্বিগুণ দামে ১৫১ কোটি টাকায় কেনা এসব গ্যানট্রি ক্রেন চালাতে গিয়ে দেখা দেয় নানা বিপত্তি। যান্ত্রিক ক্রুটিতে এসব ক্রেন অচল হয়ে পড়ে বারবার। বন্দরের মেকানিক্যাল ডিপার্টমেন্ট তা মেরামত করতে পারে না। বারবার সাপ্লায়ার্স এজেন্টকে ডাকতে হয়। ক্রেন পরিচালনার জন্য বন্দরের ২৫ অপারেটরকে জাপান থেকে ট্রেনিং দিয়ে আনা হয়। কিন্তু তারা ঠিকমত চালাতে পারছে না এমন কথা বলে তড়িঘড়ি বিদেশি অপারেটর নিয়োগের প্রস্তাব দেওয়া হয়। তখন বন্দরের একটি অসাধু চক্র সিঙ্গেল সোর্স কোটেশনের মাধ্যমে সাপ্লায়ার্স এজেন্ট সাইফ পাওয়ার টেককে বিনা টেন্ডারে টার্মিনাল পরিচালনার কাজ দেওয়ার উদ্যোগ নেয়। মন্ত্রণালয় পিপিআর অনুযায়ী টেন্ডার আহবানের সুপারিশ করলে বন্দরের প্রকৌশল ও কারিগরি বিভাগ এমনভাবে দরপত্র সিডিউল তৈরি করে যাতে সাইফ পাওয়ারটেক ছাড়া আর কেউ অংশ নিতে না পারে। দেখা গেল একটিমাত্র টেন্ডারই জমা পড়ে সাইফ পাওয়ারটেকের। সিডিউলে অনুমিত দর ছিল প্রতি বক্স কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের জন্য ৩৮৫ টাকা। কিন্তু সাইফকে কাজ দেওয়া হয় ৪৭০ টাকায়। আবার টার্গেট পূরণ করতে পারলে পাবে অতিরিক্ত ৭০৫ টাকা করে। অর্থাৎ প্রতি বক্স কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ে দেওয়া হয় ১,১৭৫ টাকা। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজস্ব অপারেটর দিয়ে কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করলে তখন গড় ব্যয় হত ৫ থেকে ৭ টাকা। (সূত্র: দেশ বিক্রি হয় যেভাবেজসীম চৌধুরী সবুজ)

কোনো বিনিয়োগ ছাড়াই পরিচালনার দায়িত্ব পেয়ে যায় সাইফ। এরপর বন্দরের কাজে তাদের একক আধিপত্য। ২০০৮ সালে ওয়ান ইলেভেন সরকারের সময় নতুন করে টার্মিনাল অপারেটর নিয়োগের টেন্ডার আহবান করা হলে এছাক ব্রাদার্স নামে একটি প্রতিষ্ঠান সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে কাজ পায়। সাইফ আউট হয়ে যায়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এছাক ব্রাদার্সের কার্যাদেশ বাতিল করে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন দরদাতা সাইফ পাওয়ারটেককে কার্যাদেশ দিয়ে বন্দরে পুনঃ প্রতিষ্ঠা করে।

অন্তর্র্বর্তী সরকারের আমলেও সৌদী আরব, দুবাই এবং সিঙ্গাপুরের প্রতিষ্ঠানকে বিনা টেন্ডারে অতিরিক্ত দরে কাজ দেওয়া হচ্ছে। তাদের আবদারে হ্যান্ডলিং চার্জসহ অন্যান্য চার্জ বাড়ানো হল যাতে বিদেশি অপারেটররা বেশি লাভ নিয়ে যেতে পারে। এ নিয়ে পোর্ট ইউজার্স ফোরাম ইতিমধ্যে নানাভাবে তাদের অসন্তোষ এবং উদ্বেগের কথা তুলে ধরেছে।

চট্টগ্রাম বন্দর দেশে একমাত্র প্রতিষ্ঠান যেটিতে কখনো কোনো সরকারি বিনিয়োগ ছিল না। সেই দেড়শ বছর আগে পর্তুগীজদের কাছে ঘাট ইজারা দিয়ে আয় শুরু। তারপর নিজের আয়ে নিজেরা তৈরি করে পল্টুন, জেটি ইত্যাদি। এভাবে কালের পরিক্রমায় বন্দর কাঠামো পরিনত হতে হতে আজকের সমৃদ্ধ অবয়ব লাভ করে। স্বাধীন বাংলাদেশে নানা সময়ে এই বন্দরকে নিয়ে নানাভাবে ষড়যন্ত্র হয়েছে, এখনো হচ্ছে। মহলটি চায় চট্টগ্রাম বন্দরকে পরনির্ভর ও ঋণগ্রস্ত করে এটিকে পঙ্গু ও দেউলিয়া করে দিতে।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় আসে সে সময় চট্টগ্রাম বন্দরে সাত হাজার কোটি টাকার ফিক্সড ডিপোজিট ছিল, যা বেড়ে পরবর্তীতে নয় হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। এই টাকা থেকে প্রায় আট হাজার কোটি টাকা সরকারি তহবিলে নিয়ে যাওয়া হয়। চট্টগ্রাম বন্দরকে তহবিল শুন্য করে এখন বন্দরের উপর হাজার হাজার কোটি টাকার ঋনের বোঝা চাপানো হচ্ছে।

বিগত সরকার কক্সবাজারের মাতারবাড়িতে ১২ শমেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করছে জাপানের আর্থিক সহায়তায়। কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড ( সিপিজিসিবিএল) এর নিয়ন্ত্রণাধীন এই প্রকল্পে প্রতিদিন ১০ হাজার টন কয়লা পোড়ানো হবে। এর যোগান দিতে বিদেশ থেকে মাসে ৩ লাখ টনের বেশি কয়লা আমদানি করতে অন্তত পাঁচটি মাদার ভ্যাসেল হ্যান্ডলিং করতে হয়। কয়লা আমদানির পথ সহজ করতে বঙ্গোপসাগর থেকে বিদ্যুৎ কেন্দ্র পর্যন্ত ১৪.৩ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি চ্যানেল তৈরি করতে হয় যেখানে ১৬ মিটার গভীরতার জাহাজ ভিড়তে পারবে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রে অর্থ সহায়তাকারী জাইকার পরামর্শে এই চ্যানেলটিকে এখন গভীর সমুদ্র বন্দর নাম দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। তহবিল শুন্য করে দেওয়ার পর বন্দর যা আয় করছে তা এখন এই গভীর সমূদ্র বন্দর নির্মাণ কাজে ব্যয় করতে হচ্ছে। ১৭ হাজার ৭৭৮ কোটি টাকার এই প্রকল্পে জাইকা ঋণ দিচ্ছে ১২ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা। পুরো ঋণটাই চাপানো হয়েছে বন্দরের ঘাড়ে। গ্রেস পিরিয়ড শোধ হওয়ায় চট্টগ্রাম বন্দরকে এখন সেই ঋণের কিস্তি শোধ করতে হচ্ছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র একটি মেগা প্রকল্প, যেখানে সব ঋণের দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু মাতারবাড়ি চ্যানেল (গভীর সমুদ্র বন্দর) একটি মেগা প্রকল্প হলেও এটি নির্মাণের বোঝা চট্টগ্রাম বন্দরের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে বন্দরকে ঋণগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হচ্ছে। আবার বে টার্মিনাল নির্মাণের যে মেগা প্রকল্পের কাজ চলছে সেটিতে বিশ্বব্যাংক বা অন্যান্য দাতা সংস্থা যে ঋণ দেবে তার দায়ভারও চাপানো হচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দরের ঘাড়ে। যেভাবে চলছে এভাবে চললে একটা সময়ে চট্টগ্রাম বন্দর দেউলিয়া হয়ে যাবে। একটা স্বনির্ভর প্রতিষ্ঠানকে এভাবে দেউলিয়া করার ষড়যন্ত্র শুরু হয় অনেক আগে। পায়রা বন্দর সরকারের আরেকটি মেগা প্রকল্প। সেই প্রকল্প বাস্তবায়নের টাকাও নিয়ে যাওয়া হচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর তহবিল থেকে। পায়রা বন্দরে বছরে তিন চারটি জাহাজ ভিড়ানো হয়। এজন্য প্রতিবছর কয়েক হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে চ্যানেল ড্রেজিং কাজে। সে টাকাও নিয়ে যাওয়া হচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে।

অন্তর্র্বর্তী সরকার এসব বিষয়ে নজর দিতে পারত। কিন্তু তা না করে ট্যারিফ বাড়িয়ে পরিস্থিতি সামালের চেষ্টা চালাচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দরের ট্যারিফ অস্বাভাবিক হারে বাড়ালেও মংলা এবং পায়রা বন্দরে তা বাড়ানো হয়নি। আগে জাপান থেকে সকল রিকন্ডিশন্ড গাড়ি চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে আমদানি হত। চট্টগ্রাম বন্দরে পোর্ট রেন্ট, পেনাল রেন্ট বারবার বাড়িয়ে মংলা বন্দরে গাড়ির জন্য রেন্ট ফ্রি করার নজিরও রয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরকে অকার্যকর করার এ ধরনের বহু প্রচেষ্টা গত সরকারের সময়ে যেমন হয়েছে এই অন্তর্র্বর্তী সরকারও একই পথে চলছে কিনা সেটিই এখন বড় প্রশ্ন।

লেখক: সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসুরা আল-বাকারাহ : নিয়মিত তেলাওয়াতে সুগম হয় জান্নাতের পথ
পরবর্তী নিবন্ধএসএসসি-এইচএসসি ফলাফল বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ ও একান্ত ভাবনা