কোভিড-১৯ দাপটের সঙ্গে বর্ষপরিক্রমা সম্পন্ন করে, দ্বিতীয় বর্ষে পা দিয়ে আরও শক্তি সঞ্চয় করে চলেছে। কিন্তু মনটা বিষাদে ভরে যায় যখন দেখি বছরের বেশি সময় ধরে চলমান অতিমারি নয়, বরং আমরাই আমাদের প্রতিপক্ষ। মনের ভেতর জমানো অন্ধকার ঘনায়িত হয়ে ঘৃণার আগুন ছড়িয়ে দেয় সমাজজুড়ে। আমরা সমাজের মানুষগুলো এমন হয়ে গেলাম কেন? অন্য ধর্মের বা অন্য মতের মানুষ বিপদ্গ্রস্ত হলে বা আক্রান্ত হলে আমরা ব্যথিত হব না? অন্য ধর্ম বা অন্য মতের কেউ নিহত হলে আমাদের প্রাণ কাঁদবে না? বরং উল্লাস করব? এই কি আমাদের মানবধর্ম? কেউ বলছে প্রতিক্রিয়াশীলদের শেষ করে দাও, কেউ বলছে সংখ্যালঘুদের শেষ করে দাও। এই শেষ করে দেওয়ার শেষ কোথায়? আর ‘শেষ করে দেওয়া’ র নামই কি প্রতিক্রিয়াশীলতা নয়? সবকিছু শেষ করে দেওয়ার জন্য যাদের ব্যবহার করা হয়, সব অপকর্ম কিংবা অপরাধের দায় কি শুধুই তাদের? আমরা অনেকেই দুষ্কৃতিকারীরা আমার দলের বা মতের নয় বলে গা বাঁচিয়ে চলি। দুষ্কৃতিকারীরা বেঘোরে প্রাণ হারালেও তাই আমাদের কিছুই যায় আসে না। কিন্তু ওরা যে এ-মাটিরই সন্তান, বাংলাদেশের নাগরিক। বাংলামায়ের তাই ঠিকই প্রাণ কাঁদে। আমরা দেখি না, দেখতে চাইও না।
মতাদর্শের নামে, ধর্মের নামে এত এত বিভাজন সমাজে, দেশজুড়ে! বিরোধিতা প্রতিনিয়তই সহিংসতায় পৌঁছে যায়। প্রাণহানির বদৌলতে নতুন মাত্রা লাভ করে সহিংসতা, যাকে কেবল ‘নারকীয়’ই বলা যায়। শহর, উপশহর ছাড়িয়ে নারকীয় তাণ্ডব ও আগুনের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে গ্রামবাংলায়। আমরা কি ভেবে দেখেছি, এতসব উন্মত্ততায় আদর্শের স্থান কোথায়? ধর্মই বা কোথায়?
বড় আশা নিয়ে চাতকের মতো বসে আছি। এত জ্ঞানীগুণী বিদগ্ধ পণ্ডিত আছেন আমাদের দেশে! নিশ্চয় তাঁরা সংকট উত্তরণে একটা উপায় বাতলে দেবেন, আলোর পথ দেখাবেন। অনেকতো হল, এবার বন্ধ হোক হানাহানি। আমাদের আত্মজদের বেঁচে থাকার জন্য, বুক ভরে শ্বাস নেওয়ার জন্য, ভায়ে ভায়ে গলা জড়াজড়ি করে আনন্দে মেতে ওঠার জন্য দেশটাকে বাসযোগ্য করা দরকার। সে-কাজ একহাতে করা যাবে না, কেবল একদলের অংশগ্রহণেও হবে না। সবাই মিলে, সকল মত, পথের সকলে মিলে হাতে-হাতে রেখে একযোগে কাজ করতে হবে। কেন কেউ আজও বলছেননা ঘৃণা নয়, ভালোবাসা ছড়িয়ে দাও? কেন, কীসের আশায় আমাদের নামজাদা পণ্ডিতগণও দুই কিংবা তিন ধারায় ভাগ হয়ে আলাদা গন্তব্যের দিকে ছুটে চলেছেন? আগামী প্রজন্মকে একটি বাসযোগ্য বাংলাদেশ দিতে কেন তাঁরা এক মোহনায় মিলতে পারছেন না? কোনটা আমাদের কাছে বড়-ঠুনকো দলীয় স্বার্থ, কিঞ্চিৎ অর্থযোগ, মৌসুমী নামযশ, নাকি আমাদের সন্তানদের নিরাপদ ভবিষ্যৎ?
আমাদের সন্তান বলতে দালানকোঠা থেকে পর্ণ কুটিরে জন্ম নেওয়া ও বেড়ে ওঠা প্রতিটি ছেলেমেয়েকে বোঝাতে চাই। সাতান্ন হাজার বর্গমাইল ভূখণ্ডের সীমানায় জন্ম নেওয়া প্রতিটি শিশু, আগত ও অনাগত সন্তান সকলের জন্য নিরাপদ ভবিষ্যৎ রচনায় কাজ করতে বড় সাধ হয়। কাজ করতে সাধ হয় সমগ্র পৃথিবীর শিশুদের জন্যও, কিন্তু সাধ আর সাধ্যের মেলবন্ধন করা হয়ে ওঠে না। দুধভাত না হোক, মাছভাত না হোক, ডালভাত হলেও যেন তিনবেলা পেটপুরে খেতে পায় আমাদের ছেলেমেয়েরা। আমাদের মতো পাহাড়, নদী, অরণ্যখেকো যেন না হয় ওরা। আমাদের মতো অসহিষ্ণু, প্রতিহিংসাপরায়ণ ও প্রতিক্রিয়াশীল যেন না হয় ওরা। রাম, রহিম, জন আর সিদ্ধার্থদের বন্ধুত্ব যেন অটুট থাকে চিরটাকাল। মাথিন, দুর্গা, মেরী ও আমেনারা যেন নির্ভয়ে ও পরম আনন্দে মেতে ওঠে সৃষ্টিশীলতায়।
আমাদের পরের প্রজন্মকে আমাদের অসত্য, হিংস্র, ক্রুর ও নীচ মনোবৃত্তি ও জীবনধারা থেকে বাঁচাতে হবে। তার জন্য বহুমূল্যের প্রকল্প হাতে নিতে হবেনা, উন্নত দেশ থেকে প্রশিক্ষণও নিয়ে আসতে হবে না। কেবল শপথ নিতে হবে আমাদের; ঘৃণা নয় ভালোবাসা ছড়িয়ে দেওয়ার শপথ, বিভেদ নয় ঐক্যের শপথ। ওদের বোঝাতে হবে সহিংসতা কেবলই দুর্বলের বাহন; ক্ষমতা ও শক্তির সশস্ত্র মহড়া প্রদর্শনে যতই উন্মত্ত হয়ে পড়ি, ততই আমাদের দুর্বলতা প্রকাশ হয়ে পড়ে। মনে মনে শপথ নেওয়া শেষে আমি আপনি যে যার অবস্থান থেকে ভালোবাসা ছড়িয়ে দেওয়ার কাজটা শুরু করে দিতে পারি, আজই। ঘটা করে ফিতা কেটে আনুষ্ঠানিকভাবে শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করারও কোন প্রয়োজন নেই।
দেশে-দেশে কালে-কালে রূপকথার গল্পে ‘ট্রু লাভ’ বলে একটা কথা থাকে, যা গল্পের শেষাংশে পরশপাথরের মতো কাজ করে। ডাইনি’র অভিশাপে শত বছরের জন্য ঘুমিয়ে পড়া রাজকন্যা ও রাজ্যশুদ্ধ মানুষের ঘুম ভাঙে ঐ ‘ট্রু লাভ’- এর স্পর্শ দিয়ে। ছদ্মবেশী বিমাতার হাত থেকে বিষাক্ত আপেল খেয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া তুষারকন্যার (স্নো হোয়াইট) দেহে প্রাণ ফিরে আসে ঐ একই ‘ট্রু লাভ’ এর ছোঁয়া দিয়ে। অপদেবতার অভিশাপ রাজপুত্রকে পিশাচে রূপান্তরিত করে। ‘ট্রু লাভ’ ই আবার তাকে মানবে পরিণত করে। এই ‘ট্রু লাভ’ আসলে প্রকৃত ভালোবাসার স্পর্শ, যা পাথরে ফুল ফোটায়, নিথর দেহে প্রাণ সঞ্চার করে, পিশাচের মনেও প্রেম জাগায়। আমাদের পচন ধরা সমাজকে বদলে দিয়ে সমাজের মানুষদের মধ্যে মায়া-মমতা-সহমর্মিতা সঞ্চার করতে হলে ট্রু লাভের বিকল্প নেই। আমাদের সন্তাদের স্বার্থে সত্যি ভালোবাসার শপথ কি আমরা আজও নেব না?