অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাবের পাশাপাশি করোনা মহামারী দীর্ঘদিনের অনেক অর্জন ঘিরেও নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। কভিডের কারণে বিপর্যস্ত স্বাস্থ্য খাত। বিঘ্নিত স্বাস্থ্যসেবা যা গর্ভবতী ও প্রসূতি মায়েদের জন্য সৃষ্টি করেছে নতুন ঝুঁকি। গত কয়েক বছরে মাতৃমৃত্যু ও শিশু মৃত্যু রোধে বাংলাদেশ যে সাফল্য অর্জন করছিল, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বাল্যবিবাহ ও কিশোরীদের গর্ভধারণ বৃদ্ধিতে তা অনেকটা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে অনুমেয়। এ অবস্থায় জাতীয় স্বাস্থ্যনীতিতে শিশু ও মাতৃমৃত্যু হ্রাসের যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল, সেখানেও চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে। সার্বিক অবস্থা আমলে নিয়ে লক্ষ্য অর্জনে সেবা নিশ্চিতের পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের ব্যবস্থা ও প্রশিক্ষিত ধাত্রীর সংখ্যা বৃদ্ধিতে গুরুত্বারোপ জরুরি। আশার কথা, প্রশিক্ষিত ধাত্রীর মাধ্যমে সন্তান জন্মদানের হার আগের তুলনায় বেড়েছে বেশ কয়েক গুণ। তবে চলমান মহামারীতে প্রসবপূর্ব ও পরবর্তী সেবা বিঘ্নিত হওয়ায় মা ও শিশুর ঝুঁকির মাত্রাও বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রসবকালে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ ও খিচুনি প্রসূতি মায়ের মৃত্যুর অন্যতম কারণ। অথচ এর মধ্যে কোনোটাই প্রসূতির মৃত্যু অনিবার্য করে তোলার জন্য জটিল সমস্যা নয়। কারণ রক্তক্ষরণ ও খিচুনি বন্ধ করার ওষুধ আছে, যা দুর্মূল্য ও দুর্লভ নয়। তবে সমস্যাটা হচ্ছে, আমাদের দেশের সরকারি সব স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রক্তক্ষরণ ও খিচুনি বন্ধের ওষুধের সরবরাহ থাকে না। বিষয়টি অপ্রত্যাশিত। এ অবস্থায় দেশের সরকারি-বেসরকারি সব স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের মাতৃস্বাস্থ্য বিভাগের সেবার মান উন্নত করার বিকল্প নেই। করোনা উপস্থিতির মধ্যেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে প্রসবসেবা প্রদানকারী কেন্দ্রগুলোর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ধাত্রীদের সার্বক্ষণিক পরিস্থিতি এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও চিকিৎসা সামগ্রী নিশ্চিত করা জরুরি। নজর দিতে হবে স্বাস্থ্যখাতে দায়িত্ব পালনে অবহেলা ও দুর্নীতি বন্ধের দিকেও। মাতৃমৃত্যু রোধে এমডিজি অর্জনে সক্ষম দেশগুলোর ক্ষেত্রে দেখা গেছে, যেসব দেশে প্রসবকালীন দক্ষ সেবার ব্যবস্থাপনা রয়েছে, সেসব দেশে মাতৃমৃত্যু অনেক কমে গেছে। বাংলাদেশ এক্ষেত্রে অগ্রগতি দেখালেও প্রসবকালীন দক্ষ সেবার অভাব রয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে জন্মের পরও গর্ভে থাকাকালীন শিশু মৃত্যুর হার কমিয়ে আনতে ভারত যেমন নিউ বর্ন অ্যাকশন প্ল্যান নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য তারা গর্ভকালীন মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা, রাষ্ট্রীয় ভর্তুকিযুক্ত আর্থিক সহায়তা কর্মসূচি জননী শিশু সুরক্ষা কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। ওই কর্মসূচির অধীনে গর্ভবতী নারী সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বিনামূল্যে যাতায়াত সুবিধার পাশাপাশি সন্তান প্রসবও নিখরচায় সিজার সুবিধাপ্রাপ্ত হন। এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা সামনে রেখে জনস্বাস্থ্য কর্মীদের সঙ্গে জনগণের সংযোগ বৃদ্ধি করতে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে দেশটি। যেখানে প্রসবপূর্ব চেকআপের পাশাপাশি স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞদের দিয়ে গর্ভকালীন ঝুঁকির মাত্রা নিরূপণ করা হয়। শ্রীলংকা প্রশিক্ষিত ধাত্রীদের সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি কয়েকটি ধাপে মা ও শিশুদের সেবা দিয়ে থাকে। মিডওয়াইফদের প্রতি একজন গর্ভবতী নারীকে সন্তান জন্মদানের আগে ন্যূনতম চারবার পরীক্ষা করার নির্দেশ রয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর বয়স পাঁচ বছর না হওয়া পর্যন্ত স্বাস্থ্যবিষয়ক বিভিন্ন সেবা দেন তারা, যা সফলভাবে দেশটির মাতৃ ও শিশু মৃত্যুর হার কমাতে সাহায্য করছে। আমাদের দেশে এখনো ৮৫ শতাংশ প্রসব বাড়িতে অদক্ষ ধাইমা অথবা নিকটাত্মীয়ের দ্বারা হয়ে থাকে। মাত্র ১৫ শতাংশ প্রসব হয় বিভিন্ন হাসপাতাল বা ক্লিনিকে। তাছাড়া গ্রামাঞ্চলে ৯০ শতাংশ নারীর প্রসব হয় এখনো সনাতনী ধাইমা অথবা আত্মীয় স্বজনের সাহায্যে। দেশের পার্বত্য অঞ্চলের অবস্থা আরো ভয়াবহ। এসব জায়গায় স্বাস্থ্য কেন্দ্র অনেক দূরে। সেখানেও সর্বক্ষণ ডাক্তার থাকেন না। তাই এসব এলাকার ৯০ শতাংশ শিশু ধাত্রীদের হাতে ঘরেই জন্ম নেয়। এসব এলাকার মাতৃ ও শিশু মৃত্যুর হার অন্যান্য জেলার তুলনায় অনেক বেশি। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় আমাদের অন্যতম সাফল্য হচ্ছে শিশুমৃত্যুর হার কমিয়ে আনা। এ লক্ষ্যমাত্রা সামনে রেখে শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাসে বিশ্বের যে দেশগুলো বড় ধরনের অগ্রগতি অর্জন করেছে, তার মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ। নব্বইয়ের দশকে যেখানে প্রতি হাজারে অর্ধেকেরও বেশি প্রসূতি মায়ের মৃত্যু ঘটত, সেখানে ২০১৩ সালে তা প্রায় ৭০ শতাংশ কমে নেমে আসে। কভিড পরিস্থিতির সীমাবদ্ধতাকে গুরুত্ব দিয়েই বিজ্ঞানসম্মত প্রসূতি সেবাদানের পাশাপাশি মানুষকে সচেতন করে তুলতে হবে। নারীদের মধ্যে শিক্ষা সুবিধা বাড়াতে হবে। চিকিৎসা সেবা সবার দ্বারে দ্বারে পৌঁছে দিতে হবে, সেবা বাড়াতে ইউনিয়ন থেকে জেলা সদর পর্যন্ত সরকারে বিদ্যমান কর্মসূচির পরিপালন নিশ্চিত করতে হবে। রোধ করতে হবে বাল্য বিবাহ। এক্ষেত্রে প্রাধান্য দিতে হবে গ্রাম, উপকূলীয় ও পার্বত্য অঞ্চলকে। সর্বোপরি প্রশিক্ষিত ধাত্রী ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব নিশ্চিতের মাধ্যমে মৃত্যুহার হ্রাস সম্ভব হবে।