নগরীর যান চলাচলে স্থবিরতা স্থায়ী আসন নিতে শুরু করেছে। মোড়ে মোড়ে ভয়াবহ রকমের যানজটে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। যান চলাচলে গতিশীলতা আনতে কোটি কোটি টাকা খরচ করে বিকল্প হাইওয়ে গড়ে তোলাসহ সড়ক প্রশস্তকরণ করা হয়েছে। নির্মাণ করা হয়েছে ফ্লাইওভার। বেপরোয়া ব্যাটারি রিক্সার নিয়ন্ত্রণহীন চলাচল, রাস্তা এবং ফুটপাত দখল, যেখানে- সেখানে পার্কিংসহ নানাবিধ অবৈধ কর্মকাণ্ডের ফলে সব আয়োজনই মাঠে মারা যাচ্ছে। বিপুল অর্থব্যয়ে প্রশস্ত করা রাস্তার বেশির ভাগই অবৈধ দখলে চলে গেছে। একই সাথে ফুটপাতের বেহাল দশাও নগরীর যান-চলাচলের ক্ষেত্রে বড় ধরনের সংকট তৈরি করেছে।
নগরীর প্রধান সড়ক একটিই। বিমানবন্দর থেকে বহদ্দারহাট পর্যন্ত এশিয়ান হাইওয়ে হিসেবে পরিচিত সড়ক ধরেই মূলত শহরের অধিকাংশ যান চলাচল করে। শহরের যানবাহনের বিপুল চাপ এই রাস্তার উপর দিনভর অব্যাহত থাকে। এরসাথে চট্টগ্রাম বন্দর এবং বিমান বন্দরগামী গাড়ির বাড়তি চাপও এই রাস্তাকে সামাল দিতে হয়। এই সড়কে যান চলাচল কোনো কারণে বন্ধ বা ব্যাহত হলে তার ধকল পুরো নগরীতে পড়তে শুরু করে।
এই সড়কটির উপর চাপ কমানো এবং বিকল্প একটি বিকল্প হাইওয়ে গড়ে তোলার লক্ষ্যে নগরীর বহদ্দারহাট থেকে কাপাসগোলা হয়ে সিরাজউদ্দৌলা রোড এবং আন্দরকিল্লা থেকে লালদীঘির পাড় হয়ে নিউ মার্কেট, নিউ মার্কেট থেকে সদরঘাট দিয়ে বারিক বিল্ডিং মোড়ে কিংবা নিউ মার্কেট থেকে স্টেশন রোড থেকে টাইগারপাস পর্যন্ত চলাচলের বিকল্প হাইওয়ে গড়ে তোলা হয়। এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে সিরাজউদ্দৌলা রোড সমপ্রসারণ করা হয়। এতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ত্রিশ কোটি টাকা। বহদ্দারহাট থেকে কাপাসগোলা রোড সমপ্রসারণ করা হয়। এই প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে প্রায় চল্লিশ কোটি টাকা। আন্দরকিল্লার জেনারেল হাসপাতালের সামনে থেকে লালদীঘির উত্তর পাড় পর্যন্ত মাত্র দুইশ’ মিটার রাস্তা পাঁচ কোটি টাকা খরচ করে সম্প্রসারণ করা হয়।
কেবল একটি বিকল্প হাইওয়েই নয়। সিডিএ নগরীর প্রায় প্রতিটি এলাকায় সড়ক প্রশস্থকরণে কোটি কোটি টাকা খরচ করে। বিশেষ করে অলংকার মোড় থেকে দেওয়ানহাট পর্যন্ত প্রায় পাঁচ কিলোমিটার সড়ক অনেকটা পরিত্যক্ত হয়ে উঠেছিল। সিডিএ প্রায় একশ’ কোটি টাকা খরচ করে সড়কটি চার লেনে উন্নীত করে। আশা করা হয়েছিল যে সড়কটি যান চলাচলের ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। যা জাকির হোসেন রোডের উপর চাপ কমানোর ক্ষেত্রে সহায়তা করবে। সিডিএ নগরীর কদমতলী থেকে পাঠানটুলি পর্যন্ত রাস্তাটিকেও চার লেনে উন্নীত করে। চল্লিশ কোটি টাকা খরচ করে এই রাস্তাটির পাশাপাশি কমার্স কলেজমুখী রোডটিকেও সমপ্রসারিত করা হয়। সিডিএ ষোলশহর দুই নম্বর গেট থেকে বায়েজিদ বোস্তামী সড়কটিকেও সমপ্রসারিত করে। ষোলশহর দুই নম্বর গেট থেকে মিমি সুপার মার্কেট পর্যন্ত রাস্তাটিকে প্রশস্থ করা হয়। প্রশস্থ করা হয় সাগরিকা রোড। অঙিজেন কুয়াইশ সড়ক। নগরীর গুরুত্বপূর্ণ এমন কোনো রাস্তা নেই যেখানে সিডিএ সমপ্রসারণ কাজ করেনি।
কিন্তু কোটি কোটি টাকা খরচ করে রাস্তা প্রশস্থকরণের মূল উদ্দেশ্যই অনেকটা ভেস্তে গেছে। সকাল থেকে গভীর রাত অব্দি রাস্তাগুলোর বেশির ভাগ জায়গা অবৈধ দখলে থাকে। কোথাও কোথাও দুই লাইন করেও গাড়ি পার্কিং করে রাখা হয়। কোথাও ভ্যানের সাথে ভ্যান দাঁড়িয়ে এমন বেহাল অবস্থা তৈরি করে যে এক লেনের গাড়ি চলাচলও অসম্ভব হয়ে উঠে। কোথাও কাভার্ড ভ্যান, কোথাও ট্রাক টার্মিনাল, কোথাওবা বাসের সারি দাঁড়িয়ে থাকে। আবার রিঙাট্যাঙির অবৈধ স্ট্যান্ডগুলোও সড়কের বড় অংশ দখল করে থাকে। আন্দরকিল্লা, জিইসি মোড়, শেখ মুজিব রোড, মনসুরাবাদ, পাহাড়তলী, কদমতলী, স্টেশন রোডসহ বিভিন্ন এলাকায় সড়কের উপর নানাভাবে অত্যাচার চলার কারণে রাস্তা প্রশস্থকরণের উদ্দেশ্য ভেস্তে গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো মন্তব্য করেছে যে, যথাযথ পদক্ষেপের অভাবে রাস্তা প্রশস্থকরণের সুফল থেকে নগরবাসী বঞ্চিত হচ্ছে। ঘন্টার পর ঘন্টা যানজট লেগে থাকে নগরীর প্রধান প্রধান সড়কগুলোতে। সিডিএর শীর্ষ একজন কর্মকর্তা দৈনিক আজাদীকে বলেন, আমরা নগরীর যান চলাচল স্বাভাবিক এবং গতিশীল করতে কোটি কোটি টাকা খরচ করেছি। রাস্তা নির্মাণ করেছি। এখন সেই রাস্তায় যান চলাচল স্বাভাবিক রাখার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশন এবং পুলিশের। অথচ এই দুইটি সংস্থা রাস্তাগুলোকে অবৈধ দখলমুক্ত রাখতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে।
সিটি কর্পোরেশনের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এটি আসলে পুলিশের দায়িত্ব। পুলিশ যদি সক্রিয় হয় তাহলে সবগুলো রাস্তা অবৈধ দখলের কবল থেকে রক্ষা পায়। যান চলাচলে শৃঙ্খলা আনা গেলেই সড়কের বেহাল অবস্থা বহুলাংশে নিয়ন্ত্রিত হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
ট্রাফিক পুলিশ নিজেদের দায়িত্ব আংশিক থাকার কথা স্বীকার করে বলেছেন বিষয়টি সিটি কর্পোরেশনের। হকার উচ্ছেদ পুলিশের কাজ নয়। সিটি কর্পোরেশনই বিভিন্ন সড়ক ও ফুটপাতে হকার বসিয়ে রাস্তার উপর অনাহুত চাপের সৃষ্টি করে। পুলিশ প্রতিদিনই শত শত মামলা করে রাস্তায় শৃঙ্খলা তৈরিতে নিরলসভাবে কাজ করছে বলেও তিনি দাবি করেন।
অবৈধ একটি সূত্র অবৈধ ব্যাটারি রিক্সার বেপরোয়া চলাচলের নেতিবাচক প্রভাবের কথা উল্লেখ করে বলেন, আগে এসব রিক্সা গলির ভেতরে চোরাগুপ্তাভাবে চলাচল করতো। এখন প্রকাশ্যে রাজপথে। এসব বেআইনি রিক্সার জন্য যান চলাচল মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। প্রসঙ্গক্রমে তিনি নগরীর এশিয়ান হাইওয়েতে রিক্সা চলাচল নিষিদ্ধ করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, শুধুমাত্র রিক্সা তুলে দিলেই এই সড়কে যান চলাচলে অনেক বেশি গতিশীলতা তৈরি হবে।