প্রযুক্তি নির্ভর জীবন

অঞ্জনা রায় চৌধুরী | শনিবার , ১২ জুলাই, ২০২৫ at ৭:০৫ পূর্বাহ্ণ

সেদিন গরম যখন চরমে, বারে বারে বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছিলো। দীর্ঘ সময় ধরে জেনারেটর চলতে চলতে তাও বন্ধ হয়ে গেলো। অসহ্য গরমে কোন কাজে মন দেয়া অসম্ভব ছিলো। এমতাবস্থায় মন এক অজানা আশংকায় ভাবনার গভীরে ডুব দিলো। পরিস্থিতি বিবেচনায় মনে প্রশ্ন জাগলো, আর যদি কখনো বিদ্যুৎ না আসে! যদি বৈদ্যুতিক এই সভ্যতা থেকে আমরা ছিটকে পড়ি, কী হবে! নগর জীবনে বসবাস যোগ্যতা থাকবে কি? নাহ্‌ বিদ্যুৎ না থাকলে লিফট, পানি, পয়:নিষ্কাশন ব্যবস্থা কোনটাই তো চলবে না। আধুনিকতার এই বেড়াজাল কেটে আমরা সেই গ্রামীণ জীবন ধারায় আবার অভ্যস্ত হতে পারব তো! দেশবিদেশ তথা পুরো বিশ্ব থেকে তো বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবো! দেশিয় ও আন্তর্জাতিক পলিটিঙের কী হবে! বিদেশের কোন বিমান আমাদের আকাশ সীমা অতিক্রম করবে কি? যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম নিশ্চয় জলপথ হবে, আর যোগাযোগের প্রধান ও অন্যতম মাধ্যম হবে “চিঠি”। আহা! চিঠি! কখনো কখনো এক মাসেরও পরে পাওয়া চিঠি শতেকবার পড়েও পড়তে ইচ্ছে করতো বারে বারে। ছোটবেলা থেকেই চিঠি লিখতে ও পড়তে আমার বিশেষ ভালো লাগতো। আমি যখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে তখন আমার এক পাড়াতো দাদু’র (প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক) সাথে আমার প্রথম ইংরেজিতে চিঠি লিখা শুরু হয়। দাদুই প্রথম লিখে উনার মেয়ে’কে (আমার সহপাঠী) দিয়ে চিঠি পাঠালেন। চমৎকার হাতের লিখায় চিঠিটা আমাকে বেশ অনুপ্রাণিত করেছে। প্রতি উত্তর লিখলাম। এভাবে চললো বেশ ক’বছর। উনার বদান্যতায় শিখেছি অনেক কিছু। এরপরে বহু নামী, গুণী মানুষদের সাথেও আমার পত্রালাপ চলে। আশির দশকে নজরুল গবেষক মফিজুল ইসলাম একদিন আমার শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ব্যবহারিক পরীক্ষা নিতে এসে আমার সাথে তাঁর একটা আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠে, ফলশ্রুতিতে দীর্ঘ কয়েক বছর আমাদের পত্রালাপ চলে। ক্রমে আমারি অলসতায় সেই ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়ে। আজো আমার মন তাঁর খবর জানতে চায়, জানি না উনি এখন অন্যভুবনের বাসিন্দা কি না। আমার জানামতে তখন তাঁর বয়েস ছিলো ৬৫ বছর। আমার একটা বড় বাঙ ছিলো, যেখানে অনেক শুভার্থীদের লিখা চিঠিগুলো ছিলো। যাযাবরের জীবন বেছে নেয়ায় সে সকল দুর্লভ সম্পদ আমার হাতছাড়া হয়ে গেলো। ওসব চিঠি’র জন্যে আজো আমার মন কেমন করে। প্রচণ্ড গরমে ঘেমে নেয়ে উঠেছি, গামছায় মুখ মুছে আবারো ভাবনায় ডুব দিলাম। সেদিন আমার সদ্য গ্র্যাজুয়েট হওয়া বিটেক ইঞ্জিনিয়ার ছেলে আমাকে প্রশ্ন করলো, মা, তোমাদের ছোটবেলায় তোমাদের বাড়িতে এসি ছিলো? আমি সহাস্যে তাকে জানালাম, আমরা প্রাকৃতিক এসি’তে বেড়ে উঠেছি বাবা। ও আমার উত্তর বুঝতে পেরে আমাকে বললো, তোমরা কত ভাগ্যবান ছিলে, তাই না? আমি বললাম, ঠিক তাই। সূর্যোদয়ের সাথেই আমাদের দিন শুরু হ’তো। প্রাকৃতিক নিয়মেই দিনশেষে সান্ধ্যকালীন প্রার্থনা করে সহসা পড়াশোনা শেষ করে ৮টা থেকে ৮.৩০ মিনিটের মধ্যেই রাতের খাবার শেষ। অতঃপর দারুণ একটা ঘুম। আজকাল মনেই করতে পারি না, কবে পুরো একরাত ঘুমিয়েছি। অকারণ মাথা ভর্তি দুশ্চিন্তা ভর করেছে। বিশ্বের পরাশক্তি সম্পন্ন দেশগুলো কখন কোন্‌ দেশকে নাজুক পরিস্থিতিতে ফেলছে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা এখন কোন্‌ পর্যায়ে, অন্যান্য দেশের সাথে আমাদের আন্তঃদেশীয় সম্পর্ক কেমন ইত্যাদি ইত্যাদি। এসবের কোন মানে হয়! কী সুন্দর ছিলো আমাদের ছোটবেলার বিদ্যুৎবিহীন সময়টা! আজকের মতোন অনেক সুবিধে ছিলো না তখন, তবে অসুবিধেও কিছু হয়নি। জীবন প্রযুক্তি নির্ভর ছিলো না। জীবন ছিলো প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর। সম্পর্কগুলো ছিলো সুগভীর। হঠাৎ বৈদ্যুতিক পাখাটা ঘুরে উঠলো। এক ঝটকায় সরে গেলো ঘরে থাকা গরম হাওয়া। আহা! কী প্রশান্তি!

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅনলাইন ব্যবসার গতি বাড়ানো জরুরি
পরবর্তী নিবন্ধনিঃশব্দ কবিতার শব্দ