প্রযুক্তি দুনিয়ায় বইয়ের নতুন অনুষঙ্গ বুকটক

শেখ বিবি কাউছার | মঙ্গলবার , ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ at ১০:২৯ পূর্বাহ্ণ

সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করেন না এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর। শিশু, যুবক, বৃদ্ধ সকলেই আজ সোশ্যাল মিডিয়ায় সরব। কত শত পোস্টের ভিড়ে আমাদের ডান হাতের তর্জনী আঙ্গুলটি যেন হয়ে উঠছে আলাদীনের সেই চেরাগের মতোন। যেন তর্জনী আঙ্গুলের ইশারাই সব কিছু আজ আমাদের হাতের মুঠোই। কী নেই এখানে খাবার, পোশাকআশাক, ঘুরাঘুরি, আড্ডা আরও কত কী! কিন্তু এত কিছুর ভিড়ে আস্তে আস্তে বই পড়ার অভ্যাসটা কি আমরা হারিয়ে ফেলছি? একথা সত্য যে, যেকোনো সমাজ থেকে আমরা বেশি পড়াবিমুখ। অধিকাংশ সময় এর কারণ হিসেবে আমরা প্রযুক্তির উপর দোষ চাপায়। সমপ্রতি এক গবেষণায় উঠে এসেছে, বর্তমান প্রজন্মের অনেক শিক্ষার্থী কলেজে উঠে বই পড়া নিয়ে অনীহা প্রকাশ করেন। তাছাড়া পুরো পাঠ্য বইও তারা শেষ করতে আগ্রহী নয়।

জেন জি’দের এই ধারণা নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন রোজ হরোভিচ। সমপ্রতি তিনি এই বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ৩৩ জন অধ্যাপকের সঙ্গে কথা বলেন। প্রবন্ধটির লেখক রোজ হরোভিচ জানান, অধ্যাপকরা বর্তমান প্রজন্মকে নিয়ে এই ধারণাই দিয়েছেন। অধ্যাপকরা জানিয়েছেন, শিক্ষার্থীদের মধ্যে সাহিত্যের প্রতি মনোযোগী হওয়ার ক্ষেত্রে প্রজন্মগত পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এর পেছনে অন্যতম কারণ হতে পারে ইন্টারনেটের আধুনিকায়ন। স্মার্টফোন ও সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাবের কারণে সেকেন্ডারি ও হাই স্কুলগুলোতে পুরো বই পড়ার প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ কমে যাচ্ছে। অধ্যাপকদের মন্তব্য তুলে ধরে প্রবন্ধে লেখক রোজ হরোভিচ আরও জানান, বই পড়ার প্রতি আগ্রহ কমে যাওয়ার আরও একটি কারণ হতে পারে শিক্ষার্থীদের মধ্যে অতিরিক্ত চাপ ও প্রযুক্তির আসক্তি। তারা সবসময় উদ্বিগ্ন থাকেন। তারা ব্যক্তিগত উন্নয়নের চেয়ে ভবিষ্যৎ গড়ার কাজকে প্রাসঙ্গিক মনে করেন।

কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি অধ্যাপক জেমস শ্যাপিরো জানান, বর্তমান প্রজন্মের কাছে সাহিত্যকর্ম তুলে ধরা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে স্নাতকের ছাত্রছাত্রীরা সাহিত্য বুঝতে সংগ্রাম করছে। তবে তাদের মধ্যে পাঠের দক্ষতা অনেক বেশি এবং তাদের জ্ঞানও কম নয়। মূল সমস্যা হলো, শিক্ষার্থীদের সময় এবং মনোযোগের ওপর অনেক চাপ থাকায় সাহিত্যকর্মে পুরোপুরি নিমজ্জিত হতে পারে না।

গবেষণায় দেখা যায়, ১৯৭১ সালে আর্থিকভাবে সচ্ছল হওয়ার লক্ষ্য দেখা যায় ৩৭ শতাংশ ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে। বাকি ৭৩ শতাংশ শিক্ষার্থীরা জীবনের অর্থপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি বিকাশের জন্যই কলেজে পড়াশোনা করতে চান। ২০১৫ সালে এসে এই পরিসংখ্যান প্রায় উল্টেই যায়। ৮২ শতাংশ শিক্ষার্থী বলছেন, আর্থিকভাবে সচ্ছল হওয়া গুরুত্বপূর্ণ। আর ৪৭ শতাংশ শিক্ষার্থীর লক্ষ্য জীবনের অর্থপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ। জেন জি’দের কাছে বই পড়া সময়ের অপচয়বিষয়টি নিয়ে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসিক্সের অধ্যাপক জোসেফ হাউলিও মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘সমপ্রতি সময়ে মানবিক পাঠ্যক্রমের ওপর গুরুত্ব কমছে। কারণ শিক্ষক ও অভিভাবকরা মূলত প্রিপ্রফেশনাল কোর্সগুলোর ওপর জোর দিচ্ছেন। তাই উপন্যাস পড়ে ঘণ্টা পার করে দেওয়াকে তারা অযৌক্তিক মনে করেন।’

যখনই কোনো নতুন প্রযুক্তির আবির্ভাব ঘটে তখনই মানুষের আগ্রহ বাড়তে থাকে সেই প্রযুক্তির প্রতি। কোনো কোনো প্রযুক্তি মানুষের মনোযোগ ধরে রাখতে পারছে দিনের পর দিন আর কোনো কোনো প্রযুক্তি হারিয়ে যাচ্ছে নিমিষেই। বর্তমানে বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মনোযোগ ধরে রাখতে পারছে যে যোগাযোগ মাধ্যম সেটি হলো টিকটক। টিকটক আজকের দিনে মনোযোগ ধরে রাখার সর্বশেষ একটি প্রতিচ্ছবি। করোনা ভাইরাস সংকটের সময় টিকটকের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। এটি মুহূর্তের মধ্যে লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে পৌঁছানোর ক্ষমতা রাখে। তরুণ ও টিনএজারদের চাহিদার সাথে সামাঞ্জস্য রেখে বিভিন্ন ধরনের নিত্য নতুন ট্রেন্ড তুলে ধরতে প্ল্যাটফর্মটি অদ্বিতীয়। এই অ্যাপটি তরুণদের বিনোদনমূলক ভিডিও পরিবেশনে বেশি গুরুত্ব দেয়।

বিশেষজ্ঞগণ এর প্রধান কারণ হিসেবে দেখছেন এই অ্যাপে সংগীত ব্যবহারের অপার সুযোগ, ফিল্টার, চলচ্চিত্রের ক্ষুদ্র ক্ষদ্র অংশ বা ক্লিপ এবং সমসাময়িক অনেক অ্যাপের তুলনায় শক্তিশালী অ্যালগরিদম। এই বিষয়গুলোর সংযোগই টিকটকের সফলতার চাবিকাঠি ও মনোযোগ ধরে রাখার গোপন রহস্যও বলা যায়। এটি খুব সহজ একটি অ্যাপ আর তাই তরুণদের কাছে এর এত কদর ও গ্রহণযোগ্যতা।

বাংলাদেশের তরুণদের কাছেও টিকটক অত্যন্ত জনপ্রিয়। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা মনে করেন এখানে অভাব রয়েছে ‘কোয়ালিটি কনটেন্ট’ এর। তারা টিকটকের মাধ্যমে নাচ, গান, কৌতুকই বেশি করে। এটির অনেক নেতিবাচক দিক থাকলেও আশার কথা হলো তরুণদের মাঝে বই পড়ার অভ্যাস ফিরিয়ে আনতে টিকটক নিয়ে এসেছে ‘হ্যাশট্যাগ বুকটক’। বুকটকের প্রধান আকর্ষণই হলো, বইপ্রেমীদের একসঙ্গে যুক্ত করা। টিকটক একটি মজার ও সৃষ্টিশীল মাধ্যম হওয়ায় চাইলেই গানের সঙ্গে ছবি সংযুক্ত করে, কোনো কিছু পুনরায় ব্যবহার, নকল বা অনুকরণ করে বইয়ের ভিডিও বানানো সম্ভব। টিনএজারদের মধ্যে বই পড়ার অভ্যাস ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে কাজ করছে টিকটকের ‘হ্যাশট্যাগ বুকটক’ হ্যাশট্যাগের বুকটকের আওতায় বইয়ের ছবির সঙ্গে মিল রেখে ছোট ছোট ভিডিও ক্লিপ, ছবিকে টিকটকের জনপ্রিয় সাউন্ডট্র্যাকের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়। সাধারণত এসব ভিডিও এক মিনিটের চেয়ে বেশি দীর্ঘ হয় না। মূলত বুকটক হলো একটি বইপাগল গোষ্ঠী, যারা বই পড়ে অনুভূতি অনলাইনে অন্যদের সাথে শেয়ার করে। প্রযুক্তির দুনিয়ায় বই পড়া আর কোনো ব্যক্তিগত বিষয় নয়, হয়ে গেছে গোষ্ঠীগত বিষয়। বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে, শত শত পোস্টের ভিড়ে পাঠকের মনোযোগ ধরে রাখতে কিংবা পাঠকের মনোযোগ পেতে লেখকদের রীতিমত প্রতিযোগিতায় নামতে হচ্ছে। এসব কথা চিন্তা করেই বর্তমানে লেখকদের মধ্যে বেশি বেশি অনুচ্ছেদমূলক (প্যারাগ্রাফিং), ছোট ছোট বাক্য লেখার প্রবণতা বাড়ছে। তাই এই সময় এসে বুকটক হতে পারে টিনএজার ও তরুণদের পাঠাভ্যাস ফিরিয়ে আনার একটি মাধ্যম। ইতিমধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বই প্রেমীদের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এই প্ল্ল্যাটফর্মটি। তারা টিনএজারদের বই পড়তে উৎসাহিত করছেন সাথে নিজেরা কী বা কোন বই পড়ছেন তা জানাচ্ছেন বুকটকের মাধ্যমে। বুকটক টিনেজারদের জন্য একটি ডিজিটাল স্পেসতৈরি করে দিচ্ছে, যেখানে তারা বন্ধুত্বপূর্ণ ও তরুণদের জন্য উপযোগী পরিবেশে নিজেদের মতামতঅনুভূতি শেয়ার করতে পারবে। সেই সাথে তারা বর্তমান প্রজন্মকে বই পড়ায় উৎসাহিত করবে। প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে আমাদের তরুণরাই এইভাবে বই পড়াকে বাঁচিয়ে রাখবে। আজকে যে প্রজন্ম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভক্ত তাদের মাঝেই লুকিয়ে আছে আগামী দিনের পাঠক। আমরা লেখক ও পাঠকরা আশাবাদী টিকটকের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব কাটিয়ে তুলবে বুকটক। এটি অন্তত টিনএজারদের বই পড়ার অভ্যাসকে চাঙ্গা করে তুলতে সহায়তা করবে সাথে একুশে বইমেলায় বুকটকও হতে পারে নতুন অনুষঙ্গ।

লেখক: প্রভাষক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, নোয়াপাড়া ডিগ্রি কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএকুশ আমাদের চেতনার শেকড়
পরবর্তী নিবন্ধশামসুন্নাহার রহমান পরাণ : সাধারণ মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু