খাবারকে সাজিয়ে পরিবেশন করা, (Garnish বা আভরণ), লোহা, পিতল, রূপা, সোনা ও হীরাকে বিশেষ ভাবে পরিধানের আকার দেয়া (Ornament বা ভূষণ), পোশাককে. বিভিন্ন আঙ্গিকে সাজিয়ে ফ্যাশন–দুরস্ত করা (Costume Design বা পোশাকের ডিজাইন), ঘর–বাড়ি, মানুষের ব্যবহার্য সব বস্তু – সামগ্রীর অলংকরণ বা Decoration সভ্যতার অনুসঙ্গী।
উল্লিখিত সবই এখন শিক্ষার বিষয়। অর্থনীতি আর বিজ্ঞান চর্চা সমাজ বদলায়, সাথে বদলায় বিনোদনের উপায়। খেলাধুলাও এখন শিখতে হয়। এ ও এখন অর্থ উপার্জনের উপায়। খাবার–দাবার রান্নার প্রণালী এখন শিক্ষার বিষয়। একে সাজিয়ে পরিবেশন করাও এখন বিদ্যার অংশ। গাছের ছাল ও বাকল ফেলে পোশাকের ব্যবহার শিল্প শুধু নান্দনিক অর্থে নয়, বাণিজ্যিক অর্থেও শিল্প। পোশাককে কেন্দ্র করে, ফ্যাশন ও স্টাইল শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ছাড়া, এসব অর্জন সম্ভব ছিলো? আগুনের ব্যবহার না জানলে, হরেক রকমের খাবার প্রস্তুত করা সম্ভব হতো? রন্ধন বিদ্যা পেতাম? ছুরি, চাকু না থাকলে garbishing সম্ভব হতো? সুঁচ, সুতা না থাকলে কাপড় বোনা যায়? করা যেতো ফ্যাশন? কোন ব্যক্তি হতে পারতেন, পোশাক নির্ভর স্টাইলিশ?
ভৌগোলিক প্রভাব ভেদে পোশাকের রকমফের পেতাম, বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি না থাকলে?
আমরা দেহ ঢাকবার জন্য শুধু গায়ে পোশাক চড়াইনি, আমাদের সম্পর্ক ও আচরণ নিয়ন্ত্রণের জন্যও পোশাক তৈরি করেছি। সমাজের নর্ম, মূল্যবোধ, আইন–কানুন, রীতি–নীতি, আদর্শ, ধর্ম তো পোশাকই। একে প্রসাধনও বলা যায়। আর এ জন্যই এখনকার সমাজকে Cosmetic Society বা প্রসাধনের সমাজ বলে উল্লেখ করা হয়।
শ্রেণী আর স্তরে বিভক্ত সমাজে সবাই কাপড় পরিধান করেন। রাজার আর প্রজার পোশাক এক নয়। এক নয়, খাবার–দাবার। আবার পেশার কারণে পোশাকের বৈচিত্র্যও দেখা যায়। ব্লু জিন্স বা ডেনিম একসময়ে শ্রমিকের পোশাক ছিলো। কার্গো প্যান্ট বিশেষ কর্মজীবীর জন্য বানানো হতো। এখন সবার পরিধেয় পোশাকে পরিণত হয়েছে। তবে রুচির ভিন্নতার কারণে ফ্যাশন চর্চার বিস্তার ঘটেছে। ফ্যাশন এমনই এক জগত তৈরি করেছে যেখানে, সুন্দরী প্রতিযোগিতাও মূলত পোশাক নির্ভর এক প্রতিযোগিতা।
ভাষায় কথা বলতে পারার মতো সামর্থ্য অর্জন করার পরে, আসে লেখ্যরূপ। শব্দের পরে শব্দ সাজিয়ে আসে কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ। আসে আঙ্গিক ও নন্দন চর্চা। সাহিত্য হয়ে ওঠে শিল্প।
ঠিক তেমনি, আর্কিটেকচার হয়ে ওঠে নান্দনিক। সব পরিবর্তনগুলো সমাজ আর অর্থনীতি পরিবর্তনের সহগামী। আবার এই পরিবর্তন যেহেতু প্রযুক্তি নির্ভর একে জীবন ব্যবস্থার অংশ করে নিতে হয়। আর এর প্রয়োগ নির্ভর করে একে চালানোর শিক্ষা থেকে।
ঠিক তেমনি রন্ধনবিদ্যা, অলংকরণ ইত্যাদিও শিল্প ও নন্দনতত্ত্বের অংশ হয়ে যায়। সভ্যতা এখন scarcity বা অপর্যাপ্ততার স্তরে নেই। মানুষ শুধু বাড়ি বানায় না, একে নান্দনিক করে তোলে। মানুষ শুধু পোশাক পরিধান করেনা, একে আকর্ষণীয় করে তোলে। আর এর সব কিছুই প্রযুক্তি নির্ভর। প্রযুক্তি এখন মানুষের রুচিকেও নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেছে। প্রযুক্তির সামর্থ্য, পোশাকের ডিজাইনের সামর্থ্যকে নির্ধারণ করে দিচ্ছে। এসব কিছুই শিখতে হয়। শিক্ষা এখন শুধুমাত্র সাধারণ শিক্ষা নয়, বরং বলা যায় বিশেষায়িত শিক্ষা।
মানুষ একাধারে অর্থনৈতিক জীব, রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিকও বটে। তবে এই বৈশিষ্ট্য অর্জনের পেছনে নিয়ন্ত্রক হলো শিক্ষা। অর্থনীতি ও বাণিজ্য যে সমাজ ও রাজনীতির বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে তা ভারতবর্ষের ও পাশ্চাত্যের দূর ও নিকট অতীতের ইতিহাস দেখলেই বোঝা যাবে।
ইউরোপ, বিশেষ করে ইংল্যান্ড সারা পৃথিবীর শিল্প বিপ্লবের কেন্দ্রবিন্দু হতে পেরেছিলো বাণিজ্যের কারণে। প্রযুক্তি হিসেব স্টীম ইঞ্জিনের আবিষ্কার হলেও প্রয়োজন ছিলো পুঁজির। আর প্রয়োজন ছিলো সামন্ত ব্যবস্থার নিগড়ে আটকে থাকা ভূমিদাসদের, ভূমির সাথে বাঁধা জীবন থেকে মুক্ত করা। কিন্তু এতোসব কিছুই হতনা যদিনা, পুঁজির মালিক মার্চেন্ট শ্রেণীর উদ্ভব হতো। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সমুদ্রে জাহাজ লুণ্ঠনের মাধ্যমে, পররাজ্য গ্রাস ও উপনিবেশ স্থাপনের মাধ্যমে পুঁজির আদি সঞ্চয় করে যার বিনিয়োগের মাধ্যমে ইংল্যান্ডে সামন্ত অর্থনীতি ভেঙে পুঁজিবাদ বা শিল্প নির্ভর সমাজের উদ্ভব ঘটে। ইংল্যান্ড, ভারতবর্ষসহ অন্যান্য উপনিবেশেও পণ্য স্থানান্তর ও ইংল্যান্ডের পণ্যের উপনিবেশকে বাজার হিসেবে ব্যবহার করে তার সামাজিক পরিবর্তন ও উন্নয়নকে বহাল রাখে। ইংল্যান্ডে রাজতন্ত্র ভেঙে নিয়মতান্ত্রিক গণতন্ত্র উদ্ভবের পেছনের কারণ, ইংরেজদের ব্যবসায়ী হয়ে ওঠা। তবে শিক্ষা, বিশেষ করে প্রযুক্তি ও বাণিজ্য নির্ভর শিক্ষা খুব বেশি প্রয়োজন ছিলো। প্রথমত প্রযুক্তি নির্ভর নয়া কারখানা চালোনোর জ্ঞান ও পণ্য উৎপাদন ও বিপণনে বাণিজ্য নির্ভর জ্ঞানের। এছাড়া পুঁজির সংগঠনে তখন আস্তে আস্তে জয়েন্ট স্টক এক্সচেঞ্জ গড়ে উঠলো।শেয়ার বাজার ছাড়া বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠা একেবারেই অসম্ভব হয়ে গেলো। ফলে এগুলোর প্রতিষ্ঠা শুধু নয়, প্রয়োজন হলো এ বিষয়ে জ্ঞানার্জনের। বাণিজ্য নির্ভর শিক্ষা, মূলত শিল্প সমাজের মৌলিক ভিত্তি হয়ে গেলো।
শিল্প সমাজের উদ্ভবের আগে বলা হয়ে থাকে যে উৎপাদন হতো ভোগের জন্য, বিনিময় সেখানে প্রধান ছিলোনা। কিন্তু পুঁজিবাদী বা শিল্প সমাজে উৎপাদন হয় মূলত বিনিময়ের জন্য। আর এতে অর্থনীতি হয়ে উঠে সমাজে জটিলতম পর্যায়ে। অর্থ ব্যবস্থাপনার এক আধুনিক প্রতিষ্ঠান হলো ব্যাংক, মানুষের সামাজিক নিরাপত্তার উপায় হিসেবে সমাজে এলো ইনস্যুরেন্স কোম্পানী। এগুলো পরিচালনার জন্য ব্যাংকিং জ্ঞান অপরিহার্য হয়ে উঠলো। তবে এর সাথে সামাজিক বিজ্ঞানের জ্ঞানও অপরিহার্য হয়ে উঠলো। প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপাঞ্চল রয়েছে এথনিক মাইনোরিটিদের আবাস ।ওঁদের কোন ব্যাংক নেই, নেই ইনস্যুরেন্স কোম্পানী। ওঁরা কিভাবে স্টক এক্সচেঞ্জ না থাকা সত্ত্বেও অর্থনীতি সচল রাখে? বিষয়গুলোর উত্তর খুঁজতে সামাজিক বিজ্ঞানের দ্বারস্থ হতে হয়। উদাহরণ দিয়েই বলি, আধুনিক শিল্প সমাজে কোন ব্যক্তি মারা গেলে পুরো সমাজ তার পরিবার বা স্ত্রী ও সন্তানদের দায়িত্ব নেয়না। মানুষের এই অর্থনৈতিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য সমাজে ইনস্যুরেন্স কোম্পানীর উদ্ভব হয়েছে। কিন্তু এথনিক মাইনোরিটির সমাজে কেউ মারা গেলে পুরো সমাজ তাঁর পরিবারের দায়িত্ব নেয়, ফলে এমন সমাজে নিরাপত্তার অভাবহীনতা এথনিক মাইনোরিটির সমাজে ইনস্যুরেন্স কোম্পানীর উদ্ভব ঘটায়নি। যেহেতু দ্রব্য –সামগ্রীর উৎপাদন হয় প্রধানত ভোগের জন্য, সে কারণে সেখানে মানি মার্কেট বা স্টক এক্সচেঞ্জ বা ব্যাংকের প্রয়োজন হয়নি। ব্যাংক ছাড়াই তাদের অর্থনীতি চালু ছিলো। ফলে বাণিজ্যের এক সামান্য সাধারণ জ্ঞান দিয়েই তারা চলতে পারতো।
তবে আজকের সমাজে প্রযুক্তি, আর ব্যবসা ও বাণিজ্যের পুরোটাই পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। যেমন, বাজার অর্থনীতির জন্য রাজনৈতিক ব্যবস্থায় গণতন্ত্রের প্রয়োজন ছিলো। রাজতন্ত্রে বাজার অর্থনীতি চালু হতে পারেনা। ফলে একজন ব্যবসায়ীকে ইংল্যান্ডে বাজার অর্থনীতি বা পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য গণতন্ত্রের জন্য রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হয়েছে। এর পরেই শুরু হয় বাণিজ্যের প্রতিষ্ঠানাদির একে একে আবির্ভাব।ফলে অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, প্রযুক্তিবিদ্যা ইত্যাদি পাঠের গুরুত্ব বেশ বেড়ে যায়। বাণিজ্য বিদ্যা তাই একক কোন বিষয় নয়, যা নিজ থেকেই বিকাশের রাস্তা খুঁজে পেয়েছে। বরং সমাজ আর অর্থব্যবস্থার পরিবর্তনের সাথে ব্যবসার যোগ রয়েছে।
সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবার বলেছেন, ইউরোপে পুঁজিবাদ এসেছে এমনসব দেশে যেখানে প্রোটেস্ট্যান্ট এথিক্স বা মূল্যবোধ মানুষকে প্রভাবিত করেছে। কারণ প্রোটেস্ট্যান্ট এথিক্স এ পুঁজিবাদী সমাজ গঠনের মূল্যবোধ ছিলো যা মানুষকে তাঁর আচরণ পরিবর্তন করে এবং এর ফলে পুঁজির সংগ্রহ ও বিনিয়োগ বাড়ে। এতে পুঁজিবাদ শক্ত ভিত পেয়ে যায়। এইযে মানুষের সমাজের ও অর্থনীতির পরিবর্তনের সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা তা বাণিজ্য ও পণ্য উৎপাদন ও বিনিময় নির্ভর সমাজে উত্তরণ ঘটায়। বাণিজ্যের বিকাশের ইতিহাসে দেখা যায়, বাণিজ্য পুরোপুরি সমাজ– কাঠামো নির্দেশিত বিষয়।
প্রযুক্তি বা উৎপাদনের উপায়ের উন্নয়ন ও পরিবর্তন সমাজ পরিবর্তনের অন্যতম শর্ত। আমরা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের দোরগোড়ায়। ব্যবসা এখন পুরোদমে প্রযুক্তি নির্ভর। পেপারলেস সমাজের দিকে ধাবমান আমরা সবাই। প্রযুক্তির সবশাখা বাদ দিয়ে শুধু যদি ইলেকট্রিসিটির কথাই বলি, এর ব্যবহার যদি দিন দুয়েক এর জন্যও ভুলে যাই, আমাদের পুরো সভ্যতা কি ভেঙে পড়বেনা? আমরা যদি কম্পিটারের ব্যবহার ভুলে যাই, বাণিজ্য নির্ভর সমাজের কি অবস্থা হবে?
এই দিক বিবেচনা করে বাণিজ্যিক শিক্ষাকে প্রযুক্তি নির্ভর করে পাঠ্যসূচি তৈরি করা খুব প্রয়োজন। আর এ বিষয়ে এগিয়ে আসেন তৈরি পোশাক শিল্পের সাথে জড়িত ব্যবসায়ীদের উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান বিজিএমইএ ও বিশেষ করে সাবেক প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট জনাব নাসির উদ্দিন চৌধুরী (বিজিএমইএ)। ইতোমধ্যে এই প্রতিষ্ঠানের এক বছর অতিক্রান্ত হতে চললো। ২১শে জানুয়ারি উদযাপিত হবে প্রধান প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী। ছয়টি ডিপার্টমেন্ট ও তিনটি ফ্যাকাল্টি নিয়ে যাত্রা শুরু হলেও মাত্র এক বছরের ব্যবধানে MBA in Apparel Merchandising বিভাগ ও চালু করা হয়েছে। চট্টগ্রাম বি জি এম ই এ ইউনিভার্সিটি অফ ফ্যাশন এন্ড টেকনোলজি আসছে বছরের শুরুতেই বাণিজ্যের স্নাতকোত্তর পাঠদানের অভিপ্রায় আছে। মনে রাখা দরকার Business and commercial activities is the life blood social activities বা ব্যবসা ও বাণিজ্যের কার্যক্রম সমাজের অন্যান্য কাজকর্মের জীবনীশক্তি। আর জাতির এই জীবনীশক্তিকে চাঙ্গা করবার বিজিএমইএ’র এই উদ্যোগ সফল হোক, সবারই এই প্রত্যাশা।
লেখক : উপাচার্য
চট্টগ্রাম বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অফ ফ্যাশন এন্ড টেকনোলজি, চট্টগ্রাম