প্রযুক্তির যুগে দ্বীনি চেতনা: মুসলমানের দায়িত্ব

মুফতি জামাল উদ্দিন | শুক্রবার , ২৬ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ৯:৩৩ পূর্বাহ্ণ

আজ মানবসভ্যতা এমন এক প্রযুক্তিনির্ভর পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে, যেখানে দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র শিক্ষা, অর্থনীতি, যোগাযোগ, স্বাস্থ্যসেবা, বিনোদন, এমনকি ধর্মীয় অনুসরণ পর্যন্ত্ত ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের ওপর নির্ভরশীল। আধুনিক প্রযুক্তি মানুষের জীবনকে যেমন সহজ করেছে, তেমনি নতুন নতুন নৈতিক সংকট ও আধ্যাত্মিক চ্যালেঞ্জও সৃষ্টি করেছে।

এই বাস্তবতায় একজন মুসলমানের করণীয় হলো প্রযুক্তিকে আল্লাহর অনুগ্রহ হিসেবে গ্রহণ করা, তবে এর ব্যবহারে দ্বীনি নীতিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া।

. তথ্যপ্রযুক্তি মানুষের জীবনে কী পরিবর্তন এনেছে:

তথ্যপ্রযুক্তি মানুষের জীবনকে অত্যন্ত দ্রুত, সহজ ও সীমাহীন করেছে। আজ পৃথিবীর এক প্রান্তে বসে আরেক প্রান্তের জ্ঞান মুহূর্তেই অর্জন করা যায়। দরসেনিযামী থেকে তাফসীর, ফিকহ, হাদীস যেকোনো বিষয় সেকেন্ডের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায়। ইতিবাচক পরিবর্তনগুলো হলোজ্ঞানার্জন সহজ হয়েছে, দাওয়াহের ক্ষেত্র বিস্তৃত হয়েছে, ধর্মীয় বক্তৃতা সহজলভ্য হয়েছে, বৈধ জীবিকা অর্জনের পথ বেড়েছে।

নেতিবাচক দিকের মধ্যে আছেসময়ের অপচয়, নৈতিক অবক্ষয়, গুনাহের উপকরণ সহজলভ্যতা, ভুল আকীদা ও ভ্রান্ত মতাদর্শের প্রসার, অজ্ঞ মানুষের হাতে ধর্মীয় ভুল ব্যাখ্যা ছড়ানো

কুরআন বলে: ‘মানুষ তার গ্রহণ করা বস্তুর দিকে লক্ষ্য করুক।’ (আবাসা: ২৪)

মুফাসসিররা বলেন, এই আয়াত শুধু খাদ্যের ব্যাপারে নয়, বরং মানুষ যে তথ্য গ্রহণ করছে তাও পবিত্র ও নিভর্রযোগ্য হওয়া উচিত।

. ইন্টারনেট ব্যবহারে হালালহারাম নীতি: ইন্টারনেট একটি নিরপেক্ষ মাধ্যম। কিন্তু এর ব্যবহারকারী তার নৈতিক অবস্থানকে নির্ধারণ করে। ইসলামে ‘ইস্তিখদাম’ বা ব্যবহারের ভিত্তিতে জিনিসের হুকুম নির্ধারিত হয়। তাই হালাল ব্যবহার: কুরআনহাদীস অধ্যয়ন, অনলাইন দাওয়াহ, বৈধ ব্যবসাবাণিজ্য শিক্ষাগবেষণা, প্রয়োজনীয় যোগাযোগ। হারাম ব্যবহার: অশ্লীলতা দেখা বা প্রচার গীবত, চোগলী, বিদ্বেষ ছড়ানো, ভ্রান্ত আকীদা প্রচার, সুদ ও জুয়ার লেনদেন, কারো চরিত্র হনন

হাদীসে বর্ণিত আছে, ‘নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া নেই, অন্যকে ক্ষতি করা নেই।’ (ইবন মাজাহ)- ইন্টারনেট ব্যবহারও এমন হতে হবে যেখানে নিজেও বাঁচি, অন্যকেও নিরাপদ রাখি।

. সোশ্যাল মিডিয়ায় ইসলামী আদব

বর্তমান যুগে মানুষের সামাজিক জীবন এখন অনেকটাই facebook, Youtube, TikTok, Whatapp এগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তাই সেখানে ইসলামী আদব বজায় রাখা অতীব জরুরি। সোশ্যাল মিডিয়ার আদবসমূহ: . সত্য যাচাই না করে পোস্ট না করা। ২. সম্মানহানি, কটূক্তি, বিদ্বেষ ছড়ানো থেকে বিরত থাকা। ৩. অশ্লীল ছবি, ভিডিও, সাউন্ড সম্পূর্ণ বর্জন করা। ৪. ধর্ম নিয়ে তর্কবিতর্কে না জড়ানো। ৫. চাইলে উপকারী ও ইতিবাচক জ্ঞান ছড়ানো। ৬. সময় নষ্ট না করে সীমিত সময়ে ব্যবহার করা। কুরআনে বলা হয়েছে– ‘হে ঈমানদাররা! তোমরা সঠিক ও সৌজন্যমূলক কথা বলো।’ (আহযাব: ৭০) সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি পোস্টও আল্লাহর দরবারে গুনাহ কিংবা সওয়াব হতে পারে।

. তরুণদের সাইবারফিতনা থেকে বাঁচানোর উপায়:

তরুণরা প্রযুক্তিতে দক্ষ হলেও নৈতিকভাবে অভিজ্ঞ নয়; এই সুযোগেই শয়তানের বিভিন্ন ফাঁদ অশ্লীলতা, গেমিং আসক্তি, অনলাইন প্রেম, ভ্রান্ত মতবাদ তাদের গ্রাস করে।

যেসব পদক্ষেপ জরুরি:

পরিবারে প্রযুক্তি ব্যবহারের শিক্ষা (DigitalEthics) শেখানো, ডিভাইসে নিরাপত্তা ফিল্টার ও প্যারেন্টাল কন্ট্রোল, মসজিদমাদরাসা ভিত্তিক সচেতনতা ক্লাস, তরুণদের কুরআনহাদীসের সঙ্গে যুক্ত রাখা, নেক সঙ্গ, নেক বন্ধু ও নেক পরিবেশ তৈরি করা, রাত্রিবেলায় ইন্টারনেট ব্যবহার কমানো, ব্যক্তিগত লক্ষ্য, সময় ব্যবস্থাপনা শেখানো।

রাসুল (সা.)বলেছেন: ‘যা তোমার জন্য উপকারী তাতে মনোনিবেশ করো এবং আল্লাহর সাহায্য চাও।’ (মুসলিম)

. প্রযুক্তির মাধ্যমে দাওয়াহের বিশাল সুযোগ:

এ যুগে দাওয়াত এখন আর মঞ্চসমাবেশে সীমাবদ্ধ নেই। একটি ভালো পোস্ট, একটি ভিডিও, একটি ওয়াজ ক্লিপ মিনিটের মধ্যে লাখো মানুষের কাছে পৌঁছে যেতে পারে। ইসলামের সঠিক শিক্ষা যখন সুন্দর ভাষায়, নির্ভরযোগ্য দলিলসহ, আধুনিকভাবে উপস্থাপন করা হয় তখন তা তরুণদের মনকে আলোকিত করে।

উপকারী দাওয়াহের কয়েকটি মানদণ্ড: দলিলভিত্তিক আলোচনা, নরম ভাষা, বিভ্রান্তিকর দলউপদলীয় বিতর্ক এড়ানো, দ্বীনের মূল শিক্ষা প্রচার, নৈতিকতার উন্নয়নকে অগ্রাধিকার।

আমাদের করণীয়: প্রযুক্তিকে দ্বীনের সেবায় ব্যবহার করা, হারাম থেকে বাঁচা, অনলাইন জীবনে ইসলামী আদব বজায় রাখা, তরুণ প্রজন্মকে সাইবার ফিতনা থেকে রক্ষা করা, সত্য, ধর্ম, নৈতিকতা এই তিনটিকে কেন্দ্র করে ডিজিটাল জগতকে সাজানো, যে জাতি প্রযুক্তিকে ইমানের আলো দিয়ে পরিচালনা করতে পারে সেই জাতিই ভবিষ্যতে নেতৃত্ব দেবে।

লেখক: আরবি প্রভাষক, চরণদ্বীপ রজভীয়া ইসলামিয়া ফাজিল (ডিগ্রী) মাদ্রাসা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধলোক দেখানো ইবাদত আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়
পরবর্তী নিবন্ধমাইকেল মধুসূদন দত্ত ও মেঘনাদবধ কাব্য