২০১৮ সালের ৩১ অক্টোবর রাতে বাকলিয়ার তুলাতলী আলী মার্কেটের (লিজা বিল্ডিং) ৫ম তলায় একটি ভাড়া ঘর থেকে গার্মেন্টস কর্মী রোকসানা বেগমের গলাকাটা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহতের স্বামী জয়নাল সেদিন থেকেই পলাতক ছিলেন। খুন করার দেড় বছর পর তিনি ধরা পড়েন। বাকলিয়া থানা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার সময় জয়নাল কুমিল্লা সদরস্থ কান্দিরপাড় এলাকায় চায়ের দোকানে চাকরি করতেন। তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে তাকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়েছিল বলে জানিয়েছেন বাকলিয়া থানার ওসি নেজাম।
অপরদিকে, ঢাকা থেকে বেড়াতে আসা প্রাইভেটকার চালক আইয়ুব আলীকে খুনের সঙ্গে জড়িত পাঁচ ছিনতাইকারীকে গত ৭ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার করে ডবলমুরিং থানা পুলিশ। বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত নগরীর বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। ডবলমুরিং থানার ওসি সদীপ কুমার দাশ বলেন, ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজের কারণেই আসামিদের শনাক্ত করা সম্ভব হয়। এ দুটি ঘটনা শুধু নয়, এবার অপরাধী শনাক্ত ও মামলার তদন্তে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারে মনোযোগী হচ্ছে পুলিশ। একসময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এসব কাজে পাবলিক সোর্স ব্যবহার করতেন। কিন্তু প্রযুক্তির ব্যবহারে সফলতা আসায় ধীরে-ধীরে কমে আসছে পাবলিক সোর্স ব্যবহার। মাঠ পর্যায়ে কর্মরত পুলিশ কর্মকর্তারা এখন আর সোর্স ব্যবহারে আগ্রহী নন। এর কারণ হিসেবে তারা বলছেন, অনেক ক্ষেত্রে পাবলিক সোর্সের দেয়া তথ্যে মামলার তদন্ত ও আসামি শনাক্তে বিলম্ব হয়। এছাড়া ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের কারণে সোর্সের মাধ্যমে হয়রানির ঘটনাও ঘটে।
কেউ কেউ অবশ্য পাবলিক সোর্স ব্যবহার না করার পেছনে বিশ্বাসঘাতকতাকেও দায়ী করছেন। ফলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও অপরাধ নিয়ন্ত্রণে নতুন নতুন আধুনিক ডিভাইস সংযোজনের মাধ্যমে তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন। বিষয়টির সঙ্গে সহমত পোষণ করেছেন সিএমপি কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর। নিজের কর্মপরিকল্পনা সম্পর্কে জানাতে গিয়ে প্রযুক্তির মাধ্যমে তদন্তের মান উন্নয়নের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন তিনি। সিএমপি কমিশনারের কর্মপরিকল্পনায় উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরায় থানা মনিটরিং। থানাকে দালালমুক্ত করার বিষয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে সিএমপিতে কর্মরতদের পেশাদারিত্বের বাইরে কোনো কর্মকাণ্ডে না জড়ানোর আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, পুলিশের সেবার মূল কেন্দ্র হচ্ছে থানা। সেগুলোকে আমরা নিবিড় মনিটরিংয়ের আওতায় আনব। ডিজিটালাইজেশন করা হবে। সব না পারলেও কিছু অংশ ডিজিটালাইজ করব। থানার নিয়মিত কর্মকাণ্ড, তদন্ত, দরখাস্ত, জিডি-এসব মনিটরিংয়ের আওতায় নিয়ে আসা হবে।
তিনি বলেন, প্রতিটি থানায় গুরুত্বপূর্ণ অংশে চারটি ক্যামেরা থাকবে। আমার অফিস থেকে থানায় কে আসল, কে গেল সেটা মনিটরিং করা হবে। এছাড়া পুলিশের পেট্রোলিংকে আরও বেগবান করার জন্য যা যা দরকার, সেটা করার চেষ্টা করব। আমরা ট্রাফিক ডিভিশনকেও ডিজিটালাইজেশনের আওতায় আনব।
নগরীর নিরাপত্তা রক্ষায় সংযুক্ত সিসিটিভি ক্যামেরাগুলোর বেহাল দশা প্রসঙ্গে সিএমপি কমিশনার বলেন, প্রায়োরিটি বেসিস সরকারি এবং বেসরকারি সাহায্য নিয়ে আমরা নগরীকে সিসিটিভির আওতায় আনবো। তিনি আরো বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সেফ সিটি কনসেপ্ট রয়েছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশেও রয়েছে। এলাকাভিত্তিক এটি চালু রয়েছে। সীমিত জনবল নিয়ে হলেও সিএমপিতেও আমরা এটি শুরু করতে চাই।
এদিকে, প্রযুক্তি ব্যবহারে পিছিয়ে নেই অপরাধীরাও। বিশেষ করে জঙ্গিবাদের সঙ্গে যুক্ত এমন অনেকেই প্রযুক্তির ব্যবহারে পারদর্শী। নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের জন্য তারা বিভিন্ন অ্যাপস ব্যবহার করছে। এসব অ্যাপের কোনোটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা জেনে গেলে তাৎক্ষণিকভাবে নতুন অ্যাপস তৈরি করা হচ্ছে। এভাবে নিজেদের মধ্যে ফের যোগাযোগ স্থাপন করছে তারা। বিষয়টি ভাবিয়ে তুলছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের। এসব ভাবনা দূর করতেই অপরাধ নিয়ন্ত্রণে বাড়ছে প্রযুক্তির ব্যবহার।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো খুন-ছিনতাইসহ সব ধরনের অপরাধের রহস্য উদঘাটন ও অপরাধী গ্রেপ্তারে প্রযুক্তি ব্যবহার করে সফলতা পাচ্ছে। এ কারণে উন্নত দেশের আদলে দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার প্রতিটি বিভাগেই সংযোজন করা হচ্ছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। তবে এসব প্রযুক্তি জনগণকে সেবা দেওয়ার পাশাপাশি তাদের অভ্যন্তরীণ কাজেও গতি আনছে। এখন কোথাও কোনো অপরাধ ঘটামাত্রই আগে শুরু হয় ওই এলাকায় ব্যবহৃত মুঠোফোনের ওপর নজরদারি। সেই মুঠোফোন মালিকদের থেকে বাছাই করা সন্দেহভাজনদের পরিচয় সম্পর্কে তথ্য নিয়ে খোলা হয় তদন্তের খাতা। কেউ হত্যার শিকার হলে তার মুঠোফোন নম্বর আগেই চলে যায় পুলিশের কাছে। শুরু হয় বিচার-বিশ্লেষণ। এক যুগ ধরে এভাবে কয়েক হাজার মামলার সুরাহা করেছে পুলিশ। মোবাইল ফরেনসিকের সব প্রযুক্তি এখন পিবিআইয়ের হাতে রয়েছে। একটি মুঠোফোন বা ডিজিটাল ডিভাইস থেকে মুছে ফেলা তথ্যও তারা বের করতে পারেন। বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে আলামত সংগ্রহ ও বিশ্লেষণে পুলিশ আগের চেয়ে অনেক বেশি সক্ষম।
তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, অপরাধ ঘটামাত্রই এখন এলাকায় কোনো সিসিটিভি ক্যামেরা আছে কি না, তার খোঁজ করেন পুলিশের কর্মকর্তারা। ফুটেজ বিশ্লেষণ করে অপরাধীদের শনাক্ত করার চেষ্টা হয়। আর কোথাও ক্যামেরা না থাকলেও প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী সন্দেহভাজন ব্যক্তির চেহারা এঁকে ফেলার প্রযুক্তি রয়েছে পুলিশের কাছে। এখন জনগণের সঙ্গে পুলিশের সরাসরি সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে জরুরি হেল্পলাইন ৯৯৯ সহ বিশেষ কিছু অ্যাপের মাধ্যমে। এগুলোর মাধ্যমে তথ্য পেয়ে সংশ্লিষ্ট অপরাধীদের ধরতে সুবিধা পাচ্ছে পুলিশ। তদন্ত নির্ভুল করতে উন্নত দেশগুলো থেকে নিত্যনতুন প্রযুক্তি আনা হচ্ছে। প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন সংস্থার সদস্যদের নিয়মিত বিদেশ থেকে ট্রেনিং করিয়ে আনা হচ্ছে। ইতিমধ্যেই পুলিশ বাহিনীতে সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন সেন্টার, ফরেনসিক ডিএনএ ল্যাবরেটরি ও সাইবার ক্রাইম ট্রেনিং সেন্টার নামে তিনটি প্রতিষ্ঠান আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করেছে। ফলে প্রযুক্তিগত পরিবর্তন এসেছে বাংলাদেশ পুলিশে।