প্রভুভক্ত জেমি

জোনাকী দত্ত | বুধবার , ৩ নভেম্বর, ২০২১ at ১১:০৮ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামের চকবাজার এলাকায় বসবাস করেন সজীব। তার পোষা দুটি প্রাণী আছে। একটা কুকুর (জেমি) আর একটা বিড়াল (মিনি)। জেমি খুব প্রভুভক্ত। এলাকার সবার সাথে তার ভালো সমপর্ক। সেখানে একটি পরিবারে থাকে শিক্ষিকা মিনু ও তার ছেলে অর্ণব। অর্ণবের সাথে জেমির বন্ধুত্ব আছে। অর্ণব যখন স্কুলে যায় জেমি তখন রাস্তা পর্যন্ত দিয়ে আসে। মিনু শিক্ষিকা যখন বলে, জেমি আর এসো না এবার ফিরে যাও। জেমি তখন মাথা নিচু করে ধীরে ধীরে চলে যায়। আবার যখন স্কুল থেকে আসে তখন জেমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে। অর্ণব মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, জেমি চল আমাদের সাথে।জেমি তখন লেজ নাড়িয়ে খুশিতে সম্মতি জানায়। পাড়ার সবাইকে জেমি চিনে। যে কেউ পাড়া থেকে বের হলে জেমি এগিয়ে দিয়ে আসে। কোন মেহমান আসলে তাকে সমাদর করে নিয়ে আসে। পাড়ায় কেউ মোটরসাইকেল নিয়ে আসলে জেমি খুশিতে চারদিকে রাউন্ড দিতে থাকে। এভাবে সজীবের জেমি পাড়ায় পরিচিত হয়ে ওঠে। জেমি সজীবকে খুব ভালোবাসতো। সবসময় তার গা ঘেঁষে থাকতো। সজীবদের যৌথ পরিবার। ব্যবসার খাতিরে সজীবকে তার পরিবার নিয়ে রাঙামাটি চলে যেতে হয়। সাথে নিয়ে যায় পোষা বিড়াল মিনিকে।তার ভাইয়ের কাছে রেখে যায় আদরের জেমিকে। জেমি অশ্রুসজল নয়নে বিদায় জানায় তার প্রভুকে। এভাবে কেটে যায় দিন, মাস, বছর।
মাঝে মাঝে সজীব চট্টগ্রামে বেড়াতে আসে। তখন জেমির কি যে আনন্দ।সজীবকে একটুও চোখের আড়াল হতে দেয় না অপলক দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে থাকে। যেন বোঝাতে চায়, প্রভু তুমি এসেছ খুব ভালো লাগছে। কতদিন তোমাকে দেখিনি। তুমি ভালো আছো তো? কিন্তু জেমি তো মুখে কিছু বলতে পারে না। জেমির এই দৃষ্টি দেখে সজীবের মায়া হয়। সে বুঝে তার ভাষা। তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। জেমি খুশিতে লেজ নাড়ে। মানুষ আর পশুর এই যে আবেগ, ভালোবাসা এ যেন যুগ যুগান্তরের চিত্র।
পশুর প্রতি মানুষের ভালোবাসা থাকতেই পারে। কিন্তু একটা পশু নিঃস্বার্থ ভাবে যে মানুষকে ভালোবাসতে পারে জেমি তার জ্বলন্ত উদাহরণ। সজীব যখন চলে যায় তখন জেমি ছলছল চোখে চেয়ে থাকে। তাকে রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসে। যতক্ষণ সে গাড়িতে না ওঠে ততক্ষণ রাসতায় দাঁড়িয়ে থাকে। সজীব গাড়িতে ওঠে জেমিকে হাত নাড়ায়। জেমি প্রতি উত্তরে লেজ নাড়িয়ে বিদায় জানায়। তারপর ধীরে ধীরে পাড়ায় ফিরে আসে। সেদিন আর কারো সাথে ভাব করে না। কিছু খায় না। নীরবে চুপ করে থাকে।
কিছু দিন পরের ঘটনা। চকবাজারে সজীবদের পাড়ায় ঘটে গেল এক দুর্ঘটনা। একদিন রাতে পাড়ার একটি দোকানে সন্ত্রাসীরা আক্রমণ করে। পাড়ার একটি ছেলে গিয়ে সে ঝামেলা মিটাতে চায়। অনেক তর্ক বিতর্ক হয়। এসব দেখে জেমি আর স্থির থাকতে পারে না। পাড়ার বিপদ। সে কিভাবে চুপ করে বসে থাকবে। তাই সে হঠাৎ গিয়ে ঘেউ ঘেউ শুরু করল। এদিকে সন্ত্রাসীরা দোকানে ভাঙচুর থেকে শুরু করে মারামারির পর্যায়ে চলে গেল। জেমি তাদের দু’একজনকে কামড়ে দিল। তাদের মধ্য থেকে কয়েক জন জেমিকে মাথায় আঘাত করল। জেমি সে আঘাত সহ্য করে শুধু ঘেউ ঘেউ করে প্রতিবাদ জানাল। তখন পাড়ার অনেক মানুষ জড়ো হলো সেখানে। কিছু ছেলে জেমিকে অনেক টানাটানি করল নিয়ে যেতে। কিন্তু জেমি অটল হয়ে সেখানে রয়ে গেল। ঘটনাটা কিছুটা মিটল। জেমি যে মাথায় আঘাত পেল সেটা কেউ টের পেল না।
রাতে জেমি ছটফট করতে লাগলো ব্যথার যন্ত্রণায়। কাউকে কিছু বোঝাতে পারছে না। ঘেউ ঘেউ করে সারা রাত কাটিয়ে দিল। মানুষ ভাবলো হয়তো পাড়ায় আর কোন বিপদ যাতে না ঘটে সেজন্য জেমি রাত জেগে শব্দ করে চলেছে। কেউ বুঝল না এই পশুর বেদনা।পরদিন সকালে শুরু হলো জেমির পাগলামি। সে পাড়ার দুটি ছেলেকে কামড়ে দিল। এদিক ওদিক ছুটতে লাগলো। কেউ তাকে বাধা দিতে পারছে না। সবাই অবাক হল। যে জেমি তাদের এত ভালোবাসত সে আজ তাদেরকে চিনতেই পারছে না। ঐদিন শিক্ষিকা মিনু যখন স্কুলে আসল তখন তার বাবা ফোন করে জানাল যে, জেমি পাগলামি করছে। তুই স্কুল থেকে সাবধানে আসিস। কারণ জেমি মানুষ আসার পথে ঘোরাঘুরি করছে। কেউ তাকে বাঁধতে ও পারছে না। শিক্ষিকা মিনু তার বাবাকে ফোন করে জানাল যে সে সাবধানে আসবে। কিন্তু অর্ণবকে স্কুল থেকে কিভাবে আনবে। তখন তার বাবা বলল, তুই চিন্তা করিস না, আমি দেখে শুনে নিয়ে আসব। তুই তাড়াতাড়ি চলে আসিস। শিক্ষিকা মিনু স্কুলে সবাইকে এই ঘটনা বলল। অন্যান্য শিক্ষিকারা অবাক হয়ে গেল। হায়রে মানুষের বিপদে এখন মানুষ এগিয়ে আসে না। সেখানে একটি পশু নিঃস্বার্থভাবে সাহায্য করে গেল। প্রত্যেকটা সন্ত্রাসীকে যদি এভাবে পশুরা শায়েস্তা করত তাহলে বোধ হয় দেশ থেকে সন্ত্রাস অনেকটা কমে যেত। মিনু এখন ভাবছে কিভাবে বাসায় যাওয়া যায়। জেমি ভালো হয়ে যাবে তো। জেমি ছিল অর্ণবের খেলার সাথী। তাছাড়া পাড়ার প্রত্যেকটা মানুষকে সে ভালোবাসত। জেমির ভয়ে পাড়ায় কোন চোর পর্যন্ত আসত না। পাড়ার সব পরিবার নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারত। জেমি সর্বদা তাদের পাহারা দিত। অবশেষে পাড়ার একজন বয়স্ক শিক্ষক অনেক বুঝিয়ে সুজিয়ে জেমিকে বশে আনল। জেমি তাকে ও খুব শ্রদ্ধা করত। কেউ জেমিকে শিকল পরাতে পারে নি। শেষে উনি জেমির গলায় শিকল পরাল। জেমিকে বেঁধে রাখা হল। যে জেমি কোনদিন বন্দি ছিল না। স্বাধীন ভাবে যে সারা জায়গায় ছুটাছুটি করত। মানুষের পাশে পাশে থাকত। সে জেমি আজ বন্দি। সে খুব চঞ্চল হয়ে গেল। কারো কথা আজ তার মনে পড়ছে না। এমনকি তার প্রভুর কথা ও না। কেউ তার চিকিৎসা করায় নি।কারণ কেউ তো জানে না সে মাথায় আঘাত পেয়েছে। সবাই মনে করছে হয়ত জেমি এমনি পাগল হয়ে গেছে। কিছু দিন বেঁধে রাখলে ঠিক হয়ে যাবে। জেমিকে কেউ কিছু খাওয়াতে ও পারল না। সকলের প্রিয় জেমি আজ বন্দি। ছোট ছেলে মেয়েরা ভয়ে তার কাছে যায় না। যারা সারাক্ষন তাকে আদরে ভরে রাখত। তার সাথে খেলা করত। জেমি সারারাত ঘেউ ঘেউ করে অনেক ছুটাছুটি করেছে। কিন্তু শিকলের জন্য বেশি দূর যেতে পারছে না। এভাবে সে সারারাত কাটিয়ে দিল।
পরদিন সকালে কেউ তার আর ঘেউ ঘেউ শব্দ শুনতে পেল না। সবাই ভাবল হয়ত সে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। এবার ধীরে ধীরে ভালো হয়ে যাবে। জেমি শান্তভাবে শুয়ে আছে। কেউ কেউ ভয়ে ভয়ে কাছে যাচ্ছে না। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা যাওয়ার পর সবাই টের পেল জেমি মারা গেছে। তাদের প্রিয় জেমি আর বেঁচে নেই। মাথায় আঘাতের ফলে তার মৃত্যু হয়েছে। মানুষের জন্য জেমি জীবন দিয়ে গেল। পাড়ার সবার চোখে জল টলমল করতে লাগলো। সবাই হায় হায় করতে লাগলো। জমিটা এভাবে মারা গেল। কেউ তার জন্য কিছু করতে পারল না। শেষে তার দেহটা পুঁতে দেওয়া হল। রাঙামাটিতে সজীব যখন চলে যাচ্ছিল তখন তার সাথে জেমির একটা ছবি তোলা হয়েছিল। পাড়ার ছোট ছেলে মেয়েরা সেই ছবি থেকে জেমির ছবি আলাদা করে নিয়ে জেমি যে জায়গায় থাকত সেখানে রেখে সেই ছবিতে ফুল দিয়ে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাল। বড়রা সেটা দেখে ভাবল, জেমির জন্য আমরা কিছুই করলাম না অথচ সে আমাদের নিঃস্বার্থভাবে উপকার করে গেল। এই জেমিকে আমরা কোন দিন ভুলতে পারব না। এই প্রভু ভক্ত জেমি আমাদের চিরদিন স্মরণে থাকবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমনের ভেতর মন থাকে না
পরবর্তী নিবন্ধকর্ণফুলী