প্রভাব পড়তে পারে দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ ।। সুইফট থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছে রুশ ব্যাংক

আজাদী প্রতিবেদন | মঙ্গলবার , ১ মার্চ, ২০২২ at ৬:০৪ পূর্বাহ্ণ

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে বড় ধরনের হুমকির মুখে পড়তে যাচ্ছে দেশের আমদানি রপ্তানি বাণিজ্য। রাশিয়ার সাথে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক লেনদেনের পুরোটাই পশ্চিমা দেশ নিয়ন্ত্রিত সুইফট (সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফাইন্যান্সিয়াল টেলিকম্যুনিকেশন) দ্বারা পরিচালিত হয়। রাশিয়ার উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা সুইফট থেকে রাশিয়ার ব্যাংকগুলোকে বিচ্ছিন্ন করার উদ্যোগ নেয়ায় বাংলাদেশ বড় সংকটে পড়ার আশংকা দেখা দিয়েছে। এই ব্যাপারে নতুন করে বিকল্প উৎস বা পন্থা খুঁজে বের করতে বাংলাদেশকে এখনি কাজ শুরু করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশের সাথে ইউরোপ এবং ইউক্রেনের ব্যবসা বাণিজ্য বহুদিনের। হাজার হাজার কোটি ডলারের পণ্যসামগ্রী রাশিয়া থেকে আমদানি করা হয়। আবার তৈরি পোশাকসহ বিপুল পরিমাণ অর্থের পণ্য রপ্তানিও করা হয়। রাশিয়া-বাংলাদেশ আমদানি রপ্তানি বাণিজ্যের লেনদেন সরাসরি রাশিয়ার কোনো ব্যাংকের মাধ্যমে হয় না। ইউরোপের বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে এসব লেনদেন হয়ে থাকে। বিশেষ করে সুইফটের মাধ্যমে এই অর্থ আদান প্রদান হয়ে থাকে। রাশিয়ার সাথে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রমের বেশিরভাগই সুইজ ব্যাংকের মাধ্যমে সম্পন্ন হয় বলেও একাধিক আমদানিকারক জানিয়েছেন। কিন্তু ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রেক্ষিতে পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার উপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করার ঘোষনা দিয়েছে। ইতোমধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আমেরিকা এবং পশ্চিমা মিত্র দেশগুলো ঐক্যমতে পৌঁছে রাশিয়ার বেশ কয়েকটি ব্যাংককে সুইফটের কার্যক্রম থেকে বিচ্ছিন্ন করার পক্ষে মতামত দিয়েছে। বিশ্বের আর্থিক লেনদেনের জন্য সর্বাধিক নিরাপদ নেটওয়ার্ক হিসেবে স্বীকৃত সুইফট থেকে রাশিয়ার ব্যাংকগুলোকে বিচ্ছিন্ন করা হলে বাংলাদেশের আমদানি এবং রপ্তানি বাণিজ্যের লেনদেন পুরোপুরি মুখ থুবড়ে পড়বে বলেও সংশ্লিষ্টরা মন্তব্য করেছেন।
তারা বলেছেন, বাংলাদেশ রাশিয়ার সঙ্গে আর্থিক লেনদেন পুরোটাই সুইফটের মাধ্যমে করে থাকে। রাশিয়ায় সুইফট বন্ধ হলে বাংলাদেশের কোনো ব্যাংক রাশিয়ার ব্যাংকগুলোর সঙ্গে আর্থিক লেনদেন করতে পারবে না। আবার রাশিয়ার ব্যাংকগুলোর করা পেমেন্টও বাংলাদেশ নিতে পারবে না।
সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা বলেছেন, দেশের গমের চাহিদার এক তৃতীয়াংশের যোগান আসে রাশিয়া এবং ইউক্রেন থেকে। ভুট্টার চাহিদার ২০ শতাংশের যোগান দেয় ওই দুটি দেশ। বাংলাদেশের তৈরি পোষাকের নতুন একটি বাজার তৈরি হয়েছে রাশিয়ায়।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর উদ্বৃতি দিয়ে সূত্র বলেছে, গত অর্থবছরে রাশিয়ায় ৬৬ কোটি ৫৩ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এর বেশির ভাগই তৈরি পোষাক। অপরদিকে আমদানি হয়েছে ৪৬ কোটি ৬৭ লাখ ডলারের পণ্য। এর বেশির ভাগই গম ও ভুট্টা। এছাড়া মেগাপ্রকল্প রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কার্যক্রম সম্পন্ন করছে রাশিয়ার রোসাটোম কোম্পানি। এই প্রকল্পের এক লাখ কোটি ডলারেরও বেশি অর্থ ব্যাংকিং চ্যানেলে আসছে। সুইফট থেকে রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করা হলে এসব ক্ষেত্রে বড় ধরনের সংকট তৈরি হবে বলে আশংকা প্রকাশ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা গতকাল দৈনিক আজাদীর সাথে আলাপকালে জানান, সুইফট থেকে রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করার জোর চেষ্টা চলছে। বিশেষ করে রাশিয়া যাতে যুদ্ধকালীন সময়ে আর্থিক সংকটে পড়ে সেজন্য পশ্চিমা দেশগুলো এই কৌশল গ্রহণ করেছে। রাশিয়ার আমদানি রপ্তানি বাণিজ্যের প্রায় পুরোটাই সুইফট নির্ভর। এখন সুইফট থেকে রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করা হলে পরিস্থিতি খুবই নাজুক হয়ে উঠবে।
সুইফটের কার্যক্রম এবং পরিধি সম্পর্কে বলতে গিয়ে ওই কর্মকর্তা বলেন, সুইফটের কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৭৩ সালে। এটির প্রধান কার্যালয় বেলজিয়ামে। বিশ্বের ১১ হাজার ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে লেনদেনের বিষয়ে ম্যাসেজ আদান প্রদানের মাধ্যমে সুইফট কাজ করে। বিশ্বের অধিকাংশ ব্যাংকই নিজেদের মধ্যকার ম্যাসেজ আদান প্রদানে সুইফট নেটওয়ার্কের মাধ্যমে কাজ করে।
সুইফট নেটওয়ার্ক দিয়ে সরাসরি অর্থ প্রেরণ করা না গেলেও এটা অনলাইনে পেমেন্ট অর্ডার প্রেরণ করে। একটি ব্যাংক তাদের সুইফট নেটওয়ার্কে সংযুক্ত অন্য একটি ব্যাংককে অর্থ পরিশোধের ম্যাসেজ পাঠালে ওই ব্যাংকে ম্যাসেজের অর্ডার অনুযায়ী অর্থ লেনদেন করে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয়ান ব্যাংকসমূহের উদ্যোগে তৈরি করা হয় সুইফট। বিশ্বের প্রায় দুই হাজার ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে সুইফটের মালিক। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ এবং ব্যাংক অব ইংল্যান্ডসহ বিশ্বের বড় বড় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে মিলে বেলজিয়ামের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ন্যাশনাল ব্যাংক অব বেলজিয়াম সুইফটের কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করে। সুইফটের নিয়ন্ত্রণ পশ্চিমাদের হাতে থাকায় রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপ অনেক বেশি সহজ হয়ে উঠেছে।
চট্টগ্রাম চেম্বার প্রেসিডেন্ট মাহবুবুল আলম দৈনিক আজাদীকে বলেন, সুইফট নিয়ে বড় সংকটে পড়েছে দেশের ব্যবসায়ীরা। রাশিয়া থেকে পণ্য আনা নেয়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। আর্থিক লেনদেনের অনিশ্চয়তার মাঝে কবে নাগাদ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে তাও অনিশ্চিত। আর সুইফট থেকে রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করা হলে বাংলাদেশের ব্যবসা বাণিজ্য বড় ধরনের সংকটে পড়বে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাঙালির সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের সূচনা হয়
পরবর্তী নিবন্ধশিক্ষা উপমন্ত্রীর শোক