বিশ্বব্যাপী নারী মুক্তি আন্দোলনের দীর্ঘ পরম্পরার স্বীকৃতি হিসাবে প্রতিবছর ০৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হয়। লক্ষ লক্ষ নারীর আত্মদানে পূত আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল পরিসমাপ্তিতে একটি বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দেরীতে এবং ধীরে হলেও বাংলাদেশ আজ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। এ স্বপ্নের পেছনে আছে দেশের লক্ষ নারীর অমানুষিক শ্রম যারা ক্রমবর্ধমান হারে সম্পৃক্ত হচ্ছে বিভিন্ন বৈচিত্র্যময় পেশায়। অর্থনীতিতে নারী শ্রমিকদের অবদান কিছুটা দৃশ্যমান এবং বাকিটা বেশিরভাগ উপেক্ষা ও অবহেলার কারণে অদৃশ্য। তৈরি পোশাক শিল্পের কথা আমরা জানি। বঞ্চনা, বৈষম্য ও মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে এ পেশায় নারীরা বৈশ্বিক মন্দাতেও অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রেখেছে। কৃষিক্ষেত্রে নারীদের শ্রমিক হিসেবে কোনো স্বীকৃতি নেই। অথচ তারা দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে। গৃহে নারীরা পেশাজীবিদের মতই ঘরের কাজের ফাঁকে ফাঁকে অন্যান্য কাজ যেমন পশুপালন, হাঁস-মুরগী ও কৃষিকাজে অবদান রাখছে। কিন্তু তাদের এ অবদান শ্রম হিসেবে স্বীকৃতি পায় না। বিনা পারিশ্রমিকের এ শ্রমের উপর কিন্তু দাঁড়িয়ে আছে আমাদের সমাজ ও অর্থনীতি। পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি, মৌলবাদ, দুর্নীতি, নারীর প্রতি সহিংসতা, বিচারহীনতার সংস্কৃতি এতগুলোর সমস্যা মোকাবেলা করে নারী নিজ যোগ্যতা এবং সাহসিকতায় এগিয়ে চলেছে, ভূমিকা রাখছে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে। সামগ্রিকভাবে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন এখনো সুদূরপরাহত। পেশাজীবী নারী তার উপার্জনের টাকা শতভাগ খরচ করতে পারে না। আবার এমন নারীও আছে পরিবারের পুরো দায়িত্ব নিয়েও পরিবার, সমাজ কোথাও তাদের শ্রমের স্বীকৃতি মিলে না। কর্মস্থলে যাওয়া-আসার পথে একজন সাহসী টোকাই নারীকে দেখেছি যার স্বামী অসুস্থ বলে পরিবারের পুরো দায়িত্ব তাকে নিতে হয়েছে। সারাদিন ময়লা-আবর্জনা ঘেঁটে সে তার মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করিয়েছে, স্বপ্ন দেখছে মেয়েকে শিক্ষিত করার। তৃতীয় লিঙ্গের ময়ূরী নামে একজনকে জানি যে তার মত অন্যদের তুলনায় অনেক বিনয়ী বলে তাকে প্রতিদিন কিছু টাকা দিতাম। পরিবার ও সমাজ তাকে জায়গা দিচ্ছে না। তার ভাই এবং স্কুল শিক্ষিকা বোন তার মাকে দেখে না। মাকে দেখার দায়িত্ব নিয়েছে সে। অনেক ঘরের কাজের মেয়ে নেশাগ্রস্ত স্বামীকে নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি করিয়ে দিনরাত মানুষের বাসায় কাজ করছে। এমনিভাবে যে হাজারো নারী নীরবে নিভৃতে জীবনের অন্ধকার ঠেলে আলোর দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় সংগ্রামরত তাদের খবর কতটুকুইবা সমাজ রাখে। পরিবেশ বিপন্নতা, কোভিডের মত সংক্রামক ব্যাধিতেও মেয়েদের লড়াই তীব্রতর হয়। উষ্ণায়নের ফলে শুকিয়ে যাওয়া জলাশয়ে পানির সংকট আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে যে সমস্যায় ফেলেছে তার দায়ও বইতে হয় আদিবাসী নারীদের। পানির খোঁজে পাহাড়ের দীর্ঘ বন্ধুর পথে তাদের হেঁটে পানি আনতে হয়। কোভিড মহামারীতে কাজ হারিয়ে অসংখ্য নারী অন্ধকার পথে পা বাড়িয়েছে। আবার সংক্রামক এ রোগের ঝুঁকি নিয়েও কাজ চালিয়ে যেতে হয় গার্মেন্টস কর্মীদের। বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে কম মজুরি দিয়ে সবচেয়ে বেশি মুনাফার অধিকারী হয় আমাদের গার্মেন্টস মালিকরা। নারীরাই হচ্ছে এ মালিকদের লোভের নির্মম শিকার। ধনী দেশগুলোর কাছে উচ্চ মূল্যে পোশাক বিক্রয় করে এরা মুনাফার পাহাড় গড়ছে। কিন্তু এই শিল্পের নারী শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন ছুটি নেই। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তাদের কাজ করতে হয়। ইট ভাঙ্গা, চিংড়ি ঘের, মাটি কাটা, চা বাগান, সিরামিক ও ঔষধ শিল্প সবক্ষেত্রে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছে এ দেশের মেয়েরা। এখানে বিরাজ করছে অমানবিক বৈষম্য ও নিপীড়ন। ট্রেড ইউনিয়ন বা শ্রম আইনের যথার্থ প্রয়োগ এখানে নেই। আইন প্রণীত হয় কিন্তু এই আইন কায়েমী স্বার্থের কারণে বাস্তবায়িত হয়না। ধর্মের নামে, প্রথার নামে, রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গির কারণে নারীরা মানবাধিকার থেকে সম্পূর্ণ বিচ্যুত ও সম অধিকারে বিষয়টি নিয়ত লঙ্ঘিত হচ্ছে। এই কারণেই প্রায়ই প্রতিদিন ধর্ষিতা হচ্ছে নারী, খুন হচ্ছে প্রতিবাদ করতে গিয়ে। প্রতিদিন খবরের কাগজে কোনো না কোনো নারীর আত্মহত্যা, খুন বা নিগ্রহের খবর আমরা পাচ্ছি। সদ্য বিবাহিত নারী বা কয়েক সন্তানের জননী দীর্ঘ দাম্পত্য জীবন পেরিয়েও পণের কারণে অকাল মৃত্যুর শিকার হচ্ছে। তাদের পরিবার এই ধরনের অনেক নির্যাতনের কথা গোপন রাখছে। নির্যাতিতা নারী লোক লজ্জা অথবা পরিবারের চাপে অধিকাংশ ক্ষেত্রে চুপ করে থাকে। এখনো কোনো কোনো পরিবারে মেয়ে শিশু জন্মগ্রহণ করলে এক ধরনের ক্রোধ, বিতৃষ্ণার শিকার হয় জন্মদাতা নারী। বাল্য বিবাহ সবার অলক্ষ্যে নিয়মিত ঘটে যাচ্ছে। কারণ সমাজ নারীকে এখনো হয় পণ্য নয়তো অক্ষম বোঝা বলে মনে করে। মেয়েকে পূর্ণাঙ্গ মানুষ ভাবার শিক্ষা ও চেতনার অভাবের কারণে এসমস্ত ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে। ব্যক্তি জীবন, সমাজ বা কর্মক্ষেত্রে যোগ্যতার বলে নারী যেন নিজের ভাগ্য জয় করতে পারে সে অধিকার ও সুযোগের জন্য নানাভাবে নারীরা আন্দোলন করে যাচ্ছে। এ আন্দোলন সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার লক্ষ্যে পরিচালিত হচ্ছে। তথ্য প্রযুক্তির বিপ্লব ও বিশ্বায়নের যুগে দারিদ্র্য সীমার নিচে থাকা মানুষের সংখ্যা কমলেও কমলো না শ্রমজীবী মেয়েদের সংখ্যা। নারীদের শ্রমের মূল্যায়ন ও পুরুষের সমান মজুরি এখনো অধরা। অর্থনীতি এগিয়ে চলে, জাতীয় আয় ও প্রবৃদ্ধির হার বাড়ে কিন্তু মেয়েদের বেলায় এসব কিছুই মূল্যহীন। মেয়েদের সত্যিকার সমস্যা ও অভিযোগগুলির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও সমাজে নানা প্রশ্ন উঠে। মেয়েদের জন্য লড়াই করতে যাওয়া পুরুষের সংখ্যা যেমন কম নয় আবার মেয়েদেরকে মেয়েদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার উদাহরণও কম নয়। এভাবেই মেয়েদের আন্দোলনকে নানাভাবে দুর্বল করা হয়। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বা উন্নয়ন ব্যাপক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের কতটুকু ভূমিকা রাখছে সেটা ভাববার বিষয়। নারী-পুরুষের বৈষম্য দূরীকরণে ভূমিকা রাখে না এমন প্রবৃদ্ধির স্থায়ীত্ব নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তৈরি পোশাক শিল্পের দক্ষ, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নারী কর্মীর অভাব রয়েছে। মাধ্যমিক শিক্ষায় মেয়েদের প্রবেশের হার সরকারি তথ্য অনুযায়ী ৬৬ শতাংশ ধরা হলেও ঝরে পড়ার হার প্রায় ৬৮ শতাংশ। ১৮ বছরের আগে বিয়ে হয়ে যায় ৬০ শতাংশ মেয়ের। নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে সামাজিক, রাজনৈতিক আন্দোলনকে বেগবান করতে না পারলে দেশের উন্নয়নের গতি মুখ থুবড়ে পড়বে। কারণ যে কোনো ধরণের পশ্চাৎপদতা কোনো সমাজকে এগিয়ে নিতে পারেনা আর সেই সমাজের উন্নয়নও টেকসই হতে পারে না। একটি সমাজের উন্নয়নের পূর্বশত হল সামাজিক অবগুণ্ঠনের কবল থেকে, আর্থিক বৈষম্য থেকে, ধর্মান্ধতার সহিংসতা থেকে নারীর সার্বিক মুক্তি। পশ্চাদপদতার পরম্পরা থেকে নারী মুক্তির এ সংগ্রাম চলছে পৃথিবীর সর্বত্র। মেয়েরা জীবনের পাঠশালা থেকে শিক্ষা নিতে শিখেছে। সেই শিক্ষায় মেয়েরা আজ খেলার মাঠ, বিজ্ঞানাগার, গবেষণাগার, মহাশূন্যে পরিভ্রমণসহ নানা দুঃসাহসিক কাজে পুরোনো বাঁধা ডিঙিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও গত কয়েক বছর ধরে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন ক্ষেত্রে মেয়েরা এগিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বজুড়ে মেয়েদের মাথায় একের পর এক চড়ছে বিজয়ের গৌরব মুকুট। শুধুমাত্র ২০১৮ সালেই নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন কানাডার ডোনা স্ট্রিকল্যান্ড, রসায়নে আমেরিকার ফ্রান্সেস আর্নস্ত, সাহিত্যে পোল্যান্ডের ওলগা তোকারচুক। অধিকার রক্ষার লড়াইয়েও মেয়েরা অনেক বেশি দুঃসাহসী হয়ে উঠেছে। পাকিস্তানের মতো রক্ষণশীল দেশ থেকে উঠে এসেছে অসম সাহসী, শান্তিতে নোবেল বিজয়ী প্রতিবাদী নারী মালালা ইউসুফ জাই। তারপরও এসময়ে প্রশ্ন জাগে আমাদের দেশে সামগ্রিকভাবে মেয়েরা কোথায়, কেমন আছে? প্রদীপের আলোয় আসা এসব উজ্জ্বল মুখের পিছনে অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে হাজারো মেয়ের মুখ। তাই বলতে হয়- ‘অসংখ্য বন্ধন মাঝে মহানন্দময় লভিব মুক্তির স্বাদ নির্মল শূন্যের প্রেমে/ আত্মবিড়ম্বনার দারুণ লজ্জা নিঃশেষে যাক থেমে।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক, কোষাধ্যক্ষ, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, চট্টগ্রাম।