প্রবীণরা আমাদের সমাজের অভিজ্ঞতম সদস্য। তাঁদের দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, শ্রম ও ত্যাগের বিনিময়ে আজকের সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ে উঠেছে। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীরের শক্তি কমে যায়, কর্মক্ষমতা হারিয়ে যায়, আর তখনই তাঁদের প্রয়োজন হয় পরিবারের ভালোবাসা, সমাজের সম্মান এবং রাষ্ট্রের সুরক্ষা। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমাদের সমাজে অনেক প্রবীণকেই এই মৌলিক সহায়তাগুলো থেকে বঞ্চিত হতে দেখা যায়। এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন উঠে আমাদের নাগরিক দায়িত্ব কোথায়?
প্রবীণদের অবস্থা ও চ্যালেঞ্জ: বাংলাদেশে ষাটোর্ধ্ব নাগরিকের সংখ্যা বাড়ছে দ্রুত। অনেক প্রবীণ মানুষ আজ অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল, শারীরিকভাবে অসুস্থ এবং মানসিকভাবে নিঃসঙ্গ। তাঁদের অনেকেই সন্তানদের অবহেলা বা নির্যাতনের শিকার হন। আবার কিছু প্রবীণকে নিরুপায় হয়ে আশ্রয় নিতে হয় বৃদ্ধাশ্রমে। এমন অবস্থা শুধু একটি পরিবার বা সরকারের ব্যর্থতা নয়, এটি পুরো সমাজের মূল্যবোধের অবক্ষয়ের ইঙ্গিত বহন করে।
নাগরিকদের দায়িত্ব : প্রতিটি সচেতন নাগরিকের দায়িত্ব হচ্ছে প্রবীণদের সম্মান ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা। প্রবীণ পিতা–মাতার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব প্রথম ও প্রধান। সময় দেওয়া, চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা প্রদান এবং মানসিকভাবে পাশে থাকা এসব কোনো দয়া নয়, এটি সন্তানদের নৈতিক ও সামাজিক কর্তব্য। প্রতিবেশী হিসেবে আমাদেরও দায়িত্ব আছে। পাড়ায় বাস করা কোনো প্রবীণ মানুষ একা বা অসুস্থ থাকলে তাঁর খোঁজ নেওয়া, প্রয়োজন হলে সাহায্য করা এবং সামাজিকভাবে তাঁদের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখা উচিত। বিশেষ করে শহরে, যেখানে পারিবারিক বন্ধন দুর্বল, সেখানে নাগরিক দায়িত্ব আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তরুণ প্রজন্ম চাইলে প্রবীণদের প্রতি সহানুভূতিশীল আচরণ গড়ে তুলতে পারে তাঁদের গল্প শোনা, প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি বিষয়ে সহায়তা করা, বা স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রমে যুক্ত হওয়া এসবের মাধ্যমে সমাজে মানবিকতা ও দায়িত্ববোধ বাড়ানো সম্ভব।
রাষ্ট্রীয় ভূমিকা ও আইনি সুরক্ষা : প্রবীণদের কল্যাণে বাংলাদেশ সরকার ‘প্রবীণ নাগরিক কল্যাণ নীতিমালা ২০১৩’ প্রণয়ন করেছে, যেখানে প্রবীণদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা, ভাতা, আবাসন ও সামাজিক নিরাপত্তার কথা বলা হয়েছে। এছাড়া ‘পিতা–মাতার ভরণ–পোষণ আইন ২০১৩’ অনুযায়ী, সন্তানেরা বাধ্য পিতামাতার দেখাশোনা করতে।
কিন্তু বাস্তবে এই আইনগুলোর প্রয়োগ অনেক ক্ষেত্রেই দুর্বল। অনেক প্রবীণ অভিযোগ করতেও ভয় পান বা জানেন না কীভাবে আইনি সহায়তা নিতে হয়। তাই রাষ্ট্রের উচিত এসব আইন বাস্তবায়নে আরও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া এবং প্রবীণদের জন্য হেল্পলাইন, তথ্যকেন্দ্র ও স্থানীয় পর্যায়ে সহায়তা সেল চালু করা।
সামাজিক উদ্যোগ : সরকারের পাশাপাশি সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোরও ভূমিকা রয়েছে। প্রবীণবান্ধব কার্যক্রম যেমন স্বাস্থ্য ক্যাম্প, বিনামূল্যে ওষুধ বিতরণ, সামাজিক অনুষ্ঠান আয়োজন বা মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা এসব উদ্যোগ সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে। গণমাধ্যমেও প্রবীণদের গুরুত্ব তুলে ধরার মাধ্যমে সচেতনতা বাড়ানো সম্ভব।
উপসংহার : একজন প্রবীণ শুধু বয়সে বড় নন, তিনি একজন অভিজ্ঞ, মূল্যবান নাগরিক। তাঁর সম্মান রক্ষা করা, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং প্রয়োজনের সময় পাশে দাঁড়ানো আমাদের নৈতিক কর্তব্য। নাগরিক, পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্র সবাই মিলে যদি সম্মিলিতভাবে প্রবীণদের পাশে দাঁড়াই, তবে আমরা একটি মানবিক ও সভ্যসমাজ গড়ে তুলতে পারব। মনে রাখতে হবে, আজকের তরুণই আগামী দিনের প্রবীণ, তাই আজ আমরা যে আচরণ করব, ভবিষ্যতে তার প্রতিফল পাব।
লেখক : মহাপরিচালক, চট্টগ্রাম একাডেমি, চট্টগ্রাম।












