দি সিনিয়র সিটিজেন্স সোসাইটি, চট্টগ্রামের অষ্টম বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মুক্তিযোদ্ধা, ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম বীর প্রতীক বলেছেন, প্রবীণদের প্রতি রাষ্ট্রের আরো মনোযোগী হওয়া উচিত। সেই মনোযোগ রাষ্ট্র দিতে পারেনি। রাষ্ট্র যারা দীর্ঘদিন শাসন করেছিল, তারা সেই মনোযোগ দিতে পারেনি। প্রবীণেরা উপেক্ষিত হয়েছে সমাজে। তাদের অপাংক্তের মতো থাকতে হয়েছে। এই দায় আমাদেরকেই নিতে হবে। কারণ এই রাষ্ট্র, এই সমাজ আমরাই তৈরি করেছি।
তিনি বলেন, আমাদের দেশে রিটায়ারমেন্টের পর রাষ্ট্র থেকে তো পরিত্যক্ত হলেনই, অনেকেই নিজের সমাজ–এমনকি পরিবার থেকেও পরিত্যক্ত হয়ে যান। এটা উচিত নয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, এই পরিস্থিতির উত্তরণের জন্য আপনারা সংঘবদ্ধ হয়েছেন, একটি প্লাটফরম তৈরি করেছেন। যেগুলো আমাদের প্রবীণদের জন্য হওয়া উচিত নয়, সেগুলো যাতে না হয় আপনারা সেই আওয়াজ তুলতে পারবেন। সার্বজনীনভাবে সব মানুষকেই ধারণ করতে হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। গতরাতে নগরীর সিনিয়র্স ক্লাবে দি সিনিয়র সিটিজেন্স সোসাইটির ৮ম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি, দৈনিক আজাদী সম্পাদক, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক এম এ মালেক। সংগঠনের জয়েন্ট সেক্রেটারি, বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক দিলীপ কান্তি দাশের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক লায়ন সিরাজুল হক আনসারী। বক্তব্য রাখেন সংগঠনের সহ–সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার এ এম কামাল উদ্দিন চৌধুরী, লায়ন কবির উদ্দিন ভূঁইয়া, সংগঠনের উপদেষ্টা ডা. মাহবুবুল হক চৌধুরী, আজীবন সদস্য লায়ন নুরুল আলম, লায়ন আহসান, মাহবুবুল আলম, বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজল আহমদ, সাংবাদিক মঈনুদ্দীন কাদেরী শওকত, ডা. দুলাল দাশ, লায়ন আবদুস সামাদ খান, লায়ন জাহাঙ্গীর মিঞা, মীর মোজাফ্ফর হোসেন, লায়ন স্বপন কুমার পালিত প্রমুখ।
ফারুক ই আজম বীর প্রতীক বলেন, আমাদের সমাজে ভিলেনরা সব নায়ক হয়েছিল। সে সমস্ত কালো অধ্যায় যাতে আর না দেখি সেই পদক্ষেপ নিতে হবে। আমাদের সন্তানদের–পরবর্তী প্রজন্মকে একটি সুস্থ এবং সবার বাসযোগ্য সমাজ উপহার দিয়ে যেতে হবে।
প্রসঙ্গক্রমে তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকারের কাছে জাপান এক লক্ষ কর্মী চেয়েছে। এরমধ্যে ২৪ হাজার হচ্ছে কেয়ার গিভার। কেয়ার গিভার একটা পেশা হতে পারে এটা আমাদের ধারণাতেই ছিল না। তাদের সমাজে যে সব বৃদ্ধ মানুষ রয়েছে তাদেরকে দেখা শোনার জন্য রাষ্ট্র থেকে কেয়ার গিভার দেয়া হয়। এদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ লাগে, জাপানী ভাষা জানা থাকতে হয়। এটাই আমাদের জন্য একটি প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে, আমরা একটু সমস্যায় পড়েছি। না হয় কালকেই আমরা ২৪ হাজার কর্মী জাপানে পাঠিয়ে দিতে পারতাম।
জাপান তাদের সমাজে যারা ভূমিকা রেখেছে, যারা তাদের উন্নয়নে কাজ করেছে রিটায়ারমেন্টের পর তাদেরকে মৃত্যু পর্যন্ত দেখাশোনার দায়িত্ব রাষ্ট্র নিয়েছে। একটি মানবিক রাষ্ট্র এমনি হওয়া উচিত বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, আমরা নানাভাবে দ্বিখণ্ডিত হতে চাই। আমাদের যত বিভেদ আছে সব মিটিয়ে ফেলতে হবে। সামাজিক মেলবন্ধন তৈরি করতে হবে। উপদেষ্টা পরিষদে দুইজন ছাড়া আর সকলেই প্রবীণ। এই দায়িত্বে আসবো এটা কোনোদিন কল্পনাও ছিল না, স্বপ্নেও ছিল না। জাতির এক ক্রান্তিকালে আমরা দায়িত্ব নিয়েছি। এই দায়িত্বে এসে হিমালয় পর্বত প্রমাণ যে বোঝা আমাদের বহন করতে হচ্ছে তা থেকে পরিত্রাণের জন্য সকল উপদেষ্টাই প্রতিদিন উদগ্রিব। অথচ ওই চেয়ারে যাওয়ার জন্য আমাদের রাজনীতিবিদেরা যেভাবে আন্দোলন করছেন, সংগ্রাম করছেন, আমার মনে হয় তারা ফেরেশতা না হয়ে পারেন না। না হয় এই দায়িত্ব নেয়ার জন্য এতো ত্যাগ তীতিক্ষা তারা করতে পারতেন না।
সভাপতির বক্তব্যে দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক বলেন, বয়স একটি সংখ্যা মাত্র। আমরা অনুভব করি আমাদের অন্তরে, আমি কতটুকু আছি। আমি কি করতে চাই, কতুটুক করতে চাই। তিনি পবিত্র কোরান শরীফের উদ্বৃতি দিয়ে বলেন, মানুষ চাইলে সবই করতে পারে। তবে সেখানে একটু কিন্তু আছে। ওই কিন্তুটা হচ্ছে আমরা সবই করতে পারি, তবে তার জন্য চেষ্টা করতে হবে। আমরা চেষ্টা করবো যাতে আমরা মনের দিক থেকে বুড়িয়ে না যাই।
তিনি বলেন, অনেকেই দেশের কি হবে সেই প্রশ্নটি আমাকে করেন। আমি বলি, দেশের জন্য তো ফারুক ই আজম সাহেবারে আছেন, উপদেষ্টা পরিষদ আছে। আমরা প্রত্যেকেই যদি আমাদের নিজের পরিবারকে স্বচ্ছল এবং সুস্থ রাখার ব্যবস্থা করতে পারি তাহলেই দেশ এগিয়ে যাবে। নিজের পরিবারের পর আমরা আমাদের আত্মীয়–স্বজন, বন্ধু–বান্ধবদের জন্যও কিছু কিছু কাজ করতে পারি। তাতে সমাজ উপকৃত হবে, বাসযোগ্য হবে। পরিবারের পর প্রত্যেক মানুষেরই সমাজের দিকে দৃষ্টি দেয়া উচিত বলে তিনি মন্তব্য করেন।
আমাদের সন্তানদের অনেকেই বৃদ্ধ বাবা–মাকে দেখে না। এটা অনেক কষ্টের। নিজের ‘ফিউচার’ শীর্ষক একটি কলামের উদ্বৃতি দিয়ে তিনি বলেন, একজন অসুখী পিতা নিজের দুঃখের কথা বলতে গিয়ে বলেছিলেন, তার সন্তান আমেরিকায় স্ত্রী সন্তান নিয়ে সুখে দিনাতিপাত করলেও তাকে দেখে না। এম এ মালেক বলেন, তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম তার ছেলের জন্য তিনি কি করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, জমি বিক্রি করে দার্জিলিংয়ে পড়িয়েছেন আট বছর থেকে। তারপর উচ্চ শিক্ষার জন্য আমেরিকায় পাঠিয়েছেন। এম এ মালেক বলেন, ৮ বছরের ছেলেকে যেদিন পিতা মাতার মমতা থেকে বের করে পড়তে পাঠিয়েছিলেন সেদিনই তো আপনি ছেলেকে হারিয়ে ফেলেছেন। আপনি তার ফিউচার দেখেছেন, তার ফিউচার গড়ে দিয়েছেন। এখন তো আপনার সুখী হওয়া উচিত।
তিনি বলেন, পারিবারিক বন্ধন, মমত্ব অনেক বড় জিনিস, এটাকে যথাযথভাবে লালন করতে না পারলে পরিবার ঠিক আর পরিবার থাকে না, পাল্টে যায়। যেমনটি ওই ভদ্রলোকের ক্ষেত্রে পাল্টে গিয়েছিল।
এম এ মালেক, প্রবীণদের সকলকেই নিজেদের বুড়ো না ভেবে জীবনটাকে নিজের মতো উপভোগ্য করে তোলারও আহ্বান জানান।












