প্রবীণ বলতে আমরা বুঝি নারী–পুরুষ যাদের বয়স ৬০ ও তদূর্ধ্ব। প্রবীণদের প্রতি অবহেলাকে বিবেচনা করে উত্তরনের জন্য সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৯৯০ সাল থেকে জাতিসংঘ ১ অক্টোবর বিশ্ব প্রবীণ দিবস পালন করে থাকে। বাংলাদেশেও বিভিন্ন আনুষ্ঠানকতার মধ্যে তা পালন করা হয়। ২০১৪ সালে দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল লিভিং নোওয়ান বিহাইন্ড। শরীরে যতক্ষন শক্তি থাকে সে কখনো মনে করে না সে একদিন প্রবীণ হবে। কিন্তু প্রকৃতির টানে আমরা একদিন প্রবীণ হবই। এটা জীবন পরিক্রমা। এটা সব প্রানীদের এমনকি বৃক্ষদের মধ্যে ও আছে। ভারতের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বিজ্ঞানী এ.পি.জে আবদুল কালাম বলেছেন “আজ হয়তো তুমি শক্তিশালী কিন্তু সময় তোমার চেয়েও বেশি শক্তিশালী কারণ কালস্রোতে তুমি একদিন শক্তি হারা–রোগে কাতর একজন প্রবীণ।” তাই কোন অবস্থাতেই প্রবীদের অবহেলা করা মোটেই সমীচীন নয়। সুতরাং তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসা উচিত। তাদের মনের বা শারীরিক ভাবে কষ্ট না দেওয়া উচিত। প্রবীণ মানে সেকেলে, অথর্ব, অক্ষম এবং সংসারের বোঝা নয় বরং তারাই আজকের এই সুন্দর সমাজ গড়ার কারিগর। একটা পারিবারের গার্ডিয়ান হিসাবে বটবৃক্ষের মতো। তাদের প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতা সদা প্রাসঙ্গিক অথচ কোন কোন পরিবারের চরম অবহেলার পাত্র। তাদের প্রতি উদাসীনতা তাদের মনকে ভীষণ ভাবে আহত করে। বর্তমান সময়ে প্রবীণদের মধ্যে একাকিত্বের সমস্যা প্রবল ভাবে দেখা দিয়েছে। অনেক পরিবার আছে তাদের ছেলেমেয়েরা কেহই তাদের কাছে নেই। এটা ভাগ্যের নিমর্মম পরিহাস অগত্যা বৃদ্ধাশ্রমে কারো কারো স্থান হয়। এটা বেশি হয় পারিবারিক ও আর্থিক কারনে শ্বশুর শাশুড়ীকে কিছুতেই সহ্য করতে চায়না। শিল্পী নচিকেতার শুরে বলতে চাই “ছেলে আমার মস্ত মানুষ–মস্ত অফিসার, মস্ত ফ্ল্যাটে যায় না দেখা এপার ওপার। নানারকম জিনীষ আসবাব–দামী দামী – সব চেয়ে কম দামী একমাত্র আমি। ছেলে আমার প্রতি অগাধ সম্ভ্রম– আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম।” সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে প্রবীণরা আজ অরক্ষিত, অসহায়, বিচ্ছিন্ন ও দুর্ব্যবহারের জর্জরিত। মোগল সম্রাট আওরঙ্গজের ১৭০৭ খ্রিষ্ঠাব্দে ৮৯ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তারপুত্র কামবক্সকে লেখা এক চিঠিতে বলেছিলেন। ‘আজ আমি বৃদ্ধ, জরাজীর্ন, দুর্বল, বিগত জীবনে, আমার কত লোকবল এশ্বর্য, প্রাচুর্যইনা ছিল। আজ আমার জীবনের উজ্জ্বল দিনগুলো চলেগেছে। আছে শুধু আস্থি চর্ম আর কষ্কাল। আজ আমি একা, অসহায়, বিমূঢ়, উপার্জনে অক্ষম দুর্বল স্বাস্থ্য একজন প্রবীণ ব্যক্তি। প্রবীণরা কর্মস্থলে, হাসপাতালে, বাজারে, পেনশন তোলার সময় বিনোদনস্থলে সর্বত্রই অনাহুত, উপেক্ষিত। কিন্তু অনেক উন্নত–অনুন্নত দেশে এমনকি পাশের দেশেও সামাজিক ও সরকারীভাবে তারা সিনিয়র সিটিজেন হিসাবে স্বীকৃত। যেটা আমাদের দেশে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে নাই। প্রবীণদের বোঝা না ভেবে পারিবারের সম্পদ ভাবা উচিত। রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবারে রয়েছে তাদের অমূল্য অবদান। তাদের প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতা ও কর্মসহায়তা সব সময়ের জন্য প্রাসঙ্গিক। তার পরেও দেশে দেশে সমাজে প্রবীণদের প্রতি রয়েছে এক ধরনের অবহেলা। আমাদের দেশে অর্থিক ও সামাজিক কারণে বর্তমানে দিন দিন বিভাজন বেড়ে চলেছে। যৌথ পরিবার ভেঙ্গে একক তৈরী হয়েছে। এতে আমাদের কাঙ্ক্ষিত সমাজ ব্যবস্থা কিছুটা ভেঙ্গে পড়েচে। এটা গুনগত না সমাজিক পরিবর্তন সেটা ভাববার বিষয়। প্রবীণদের অভিজ্ঞতা লব্ধ জ্ঞান এবং নবীদের সৃষ্টিশীল বিজ্ঞান মনষ্ক দক্ষতা মূলক জ্ঞানের নতুন প্রজন্ম এ বিশ্বকে নবযুগের ধারায় এগিয়ে নিয়ে যাবে। এটাই আমাদের প্রত্যাশা। আমরা একীভূত শিক্ষার কথা বলি। তবে কাউকে পিছনে ফেলে বা বোঝা মনে করে নয়। কাজেই প্রবীণদের বোঝা মনে না করে তাদের অভিজ্ঞতা লব্ধ জ্ঞানকে কাজে লাগানো যায় কিনা ভেবে দেখা উচিত। ২০২৩ সালে যারা প্রবীণদের পর্যায়ে পড়েছে তারা অনেকেই আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ভাবধারায় এত দূর এসে পৌছেছেন। চলার পথে লক্ষ্যনীয় যে বর্তমান প্রজম্মের কিছু কিছু লোক বড়দের সম্মান করতে দ্বিধাবোধ করে।
আমাদের দেশে এখনও সিনিয়র সিটিজেনরা সিনিয়র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। আলোকিত সমাজ, সভ্যতা ও সংস্কৃতি লাভ করতে চাই প্রবীণদের অভিজ্ঞতা সঞ্চিত পরামর্শ এবং নবীনদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে। উল্লেখ্য বাংলাদেশে সরকার ৬০ বছর ও তদূর্ধ্ব নাগারীকদের সিনিয়র সিটিজেন ঘোষণা করে মর্যাদার আসনে রেখেছেন। তবে সিনিয়র সিটিজেনদের প্রকৃত পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হয়নি। প্রবীণদের জীবন মান উন্নয়নের লক্ষ্যে নিম্নলিখিত কিছু সুপারিশগুলো বিবেচনার জন্য সান্নিবেশিত করা হলো। ১. সিনিয়র সিটিজেন সদস্যদের পরিচয়পত্র প্রদান যাতে সিনিয়র সিটিজেন হিসাবে সুযোগ সুবিধা পায়। ২. সব প্রবীণদের মৌলিক স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের পূর্ণ বাস্তুবায়ন। ৩. নিরাপদ বার্ধক্য অর্জ্জন, প্রবীণ বয়সে দারিদ্র দূরীকরণ ও জাতিসংঘ নীতিমালা বাস্তুবায়ন। ৪. প্রবীণরা যেন অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অধিকারে বৈষম্যের শিকার না হয়। ৫. প্রবীণদের প্রাইভেট সেক্টর। সিভিল সোসাইটি ও সরকারে সব মহলের অংশীদারিত্ব থাকে। “ওগো প্রবীণ, চলো এবার সকল কাজের শেষে/নবীন হাসি হেসে চরম খেলার বেশে।”
লেখক : প্রাক্তন চীফ অ্যানাসথেসিও লজিস্ট, বাংলাদেশে রেলওয়ে হাসপাতাল, চট্টগ্রাম