আজ আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস। জাতিসংঘ বার্ধক্যকে মানবজীবনের প্রধানতম চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করে এ সমস্যা সম্পর্কে ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ১৯৯১ সাল থেকে প্রতি বছর ১ অক্টোবর বিশ্বব্যাপী এ দিবস পালন করে আসছে। এবারে দিবসের প্রতিপাদ্য হলো ‘মর্যাদাপূর্ণ বার্ধক্য : বিশ্বব্যাপী প্রবীণ পরিচর্যা ও সহায়তা ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ’। বিশ্বজুড়ে প্রবীণদের মানবাধিকার সুরক্ষার জন্য তাঁদের পরিচর্যা, সংহতি ও সহায়তা ব্যবস্থা জোরদার করাই আলোচ্য থিমের মূল উদ্দেশ্য। আমরা জানি, বিশ্বে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে। ২০৫০ সালের মধ্যে বয়স্ক জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বিশ্বে দ্বিগুণ হবে যা প্রায় ২.১ বিলিয়নে পৌঁছাবে বলে অনুমান করা হয়। প্রবীণ জনসংখ্যাকে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য বড় ঝুঁকি হিসেবে বিবেচনা করেছে ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরাম। প্রবীণ জনসংখ্যা ভবিষ্যৎ পৃথিবীর জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হিসেবে আসছে। ২০০২ সালে ১৫৯টি দেশের উপস্থিতিতে মাদ্রিদে প্রবীণ জনসংখ্যা বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বিশ্ব অর্থনীতির জন্য ৪৫টি ঝুঁকি চিহ্নিত করা হয়, যার পঞ্চম টি বয়স্ক জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বৃদ্ধি। সমপ্রতি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশে বয়স্ক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার শিশু বৃদ্ধির হারের চেয়ে অনেক বেশী। ফলে, মোট প্রবীণ জনসংখ্যা শিশু জনসংখ্যা ছাড়িয়ে যাবে। সুতরাং, এটিই প্রতীয়মান হয় যে, ভবিষ্যতে বাংলাদেশে প্রবীণরাই জনসংখ্যার একটি বড় অংশ হবে।
দেশে প্রবীণদের সংখ্যা বর্তমানে মোট জনসংখ্যার ৮ শতাংশ। জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২–এর প্রাথমিক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, দেশে ৬০ বছর বয়সি মানুষের সংখ্যা ১ কোটি ৫৩ লাখ ২৬ হাজার ৭১৯ জন। ২০১১ সালের জনশুমারিতে এ হার ছিল ৭.৪৭ শতাংশ। জাতিসংঘের জনসংখ্যা উন্নয়ন তহবিলের প্রাক্কলন বলছে, ২০২৫–২০২৬ সালে প্রবীণের সংখ্যা হবে ২ কোটি। ২০৫০ সালে এই সংখ্যা হবে সাড়ে ৪ কোটি, যা তখনকার জনসংখ্যার ২১ শতাংশ হবে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রবীণদের নানা সমস্যা আর চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়। প্রতিটি ক্ষেত্রে তারা বঞ্চনা আর অবহেলার শিকার। অযত্ন আর একাকিত্বে তাদের হতে হয় জর্জরিত। সমাজ, রাষ্ট্র এবং পরিবারের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রবীণরা আজ চরম বৈষম্যের শিকার হন।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতি, স্বাস্থ্যসচেতনতা, পুষ্টির উন্নয়ন, স্বাস্থ্যসেবার সহজলভ্যতার কারণে বিশ্বজুড়ে মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। সঙ্গে বেড়েছে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা। কিন্তু এর সঙ্গে বেড়েছে প্রবীণদের সুস্থ রাখার চ্যালেঞ্জ। বর্তমানে দেশে যেসব প্রবীণ রয়েছেন, তাঁদের প্রয়োজন বাড়তি যত্ন। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চুল পাকে। ত্বকে পড়ে বলিরেখা। দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণশক্তি কমে যায়। কমে পেশিশক্তিও। ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হন অনেকে। অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাস, শরীরচর্চার অভাব, অনিয়মিত ওষুধ সেবনসহ নানা কারণে বয়স্ক ব্যক্তিদের ডায়াবেটিস ওঠানামা করে। তাঁদের সিস্টোলিক হাইপারটেনশন বেশি দেখা যায়। এর প্রভাবে হৃদ্রোগ, স্ট্রোক ইত্যাদি হতে পারে। অনেকে স্ট্রোক–পরবর্তী জটিলতায় দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী থাকেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রবীণ বয়সে যে বিষয়টির অভাব সবচেয়ে বেশি অনুভূত হয় তা হলো সঙ্গ দেওয়া বা সময় দেওয়া। প্রতিদিনের ব্যস্ততার কারণে অনেকেই ঠিকঠাক মতো পরিবারের প্রবীণ সদস্যের খোঁজ নিতে পারেন না বা সময় দেওয়া হয় না। এটি তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। একাকিত্ব প্রবীণদের বিষণ্ন করে তুলতে পারে, যা পরে তাদের স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বয়স হতে থাকলে অভিজ্ঞতার ঝুলিতে অনেক গল্প জমা হয় যা তারা বলতে চান। কিন্তু এই গল্প শোনার সময় আমাদের হাতে থাকে না। তাই প্রবীণদের সঙ্গ দিতে হবে। অন্যদিকে, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মেজাজেরও পরিবর্তন হতে থাকে। কেউ কেউ অতিরিক্ত খিটখিটে হয়ে যান, আবার কেউ কথাবার্তা কমিয়ে ফেলেন, কারো আবার আচরণে ছেলেমানুষী ভাব চলে আসে। যে পরিবর্তনই আসুক না কেন, পরিবারের গুরুজন হিসেবে তাকে ভালো রাখার, তার পাশে থাকার দায়িত্ব আমাদের। অতএব, প্রবীণদের প্রতি নমনীয় হতে হবে, তাদের প্রতি সহনশীল আচরণ করতে হবে।
বর্তমানে সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে প্রবীণরা আজ অরক্ষিত, অবহেলিত, বঞ্চিত, অসহায়, অভাবী এবং বিচ্ছিন্ন। তাদের যথাযথ মূল্যায়ন করা হয় না। জীবনসায়াহ্নে এসে প্রবীণরা যেন কোনো করুণা বা অবহেলার শিকার অথবা উপেক্ষিত না হন সে বিষয়ে দৃষ্টি রাখতে হবে।