প্রবীনদের পরিচর্যা ও সহায়তা ব্যবস্থা শক্তিশালী করার আহ্বান জানিয়েছেন দি সিনিয়র সিটিজেন্স সোসাইটি চট্টগ্রামের সভাপতি, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক, দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক। গতকাল সকালে আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস উদযাপন উপলক্ষে নগরীর চেরাগী পাহাড় মোড়স্থ দৈনিক আজাদী চত্বরে আয়োজিত সমাবেশে সভাপতির বক্তব্যে তিনি এ আহ্বান জানান। দি সিনিয়র সিটিজেন্স সোসাইটি চট্টগ্রাম এই সমাবেশের আয়োজন করে। সমাবেশ শেষে বের হওয়া র্যালি চেরাগী পাহাড় মোড় ঘুরে দৈনিক আজাদী চত্বরে এসে শেষ হয়। প্রবীণ দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য ‘মর্যাদাপূর্ণ বার্ধক্য : বিশ্বব্যাপী প্রবীণ পরিচর্যা ও সহায়তা ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ’।
সভাপতির বক্তব্যে এম এ মালেক বলেন, প্রবীণরা দেশের সম্পদ। ছেলে–মেয়েদের এমনভাবে শিক্ষা দিতে হবে যেন বাবা মাকে বৃদ্ধাশ্রমে না পাঠায়। কেউ যদি পাঠায়, মনে করতে হবে আমরা তাদেরকে প্রকৃত শিক্ষাটা দিতে পারিনি। প্রবীণদের আছে জ্ঞান, বিদ্যা ও বুদ্ধি আর নবীনদের আছে নতুন কিছু শেখার প্রত্যয়। নবীণ–প্রবীণের সমন্বয়ে আমাদেরকে কাজ করতে হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। নবীণ–প্রবীণের সমন্বয়ে যদি আমরা কাজ করি তাহলে পরিবার, সমাজ, দেশ ও পৃথিবী পাল্টে যাবে, এগিয়ে যাবে।
এম এ মালেক বলেন, একটা কাজ যদি এখনো না করে থাকেন, তাহলে কখনো করবেন না। কাজটা হলো–সম্পত্তিটা কখনো কারো নামে লিখে দিবেন না। দলিল লিখলেও ছেলে মেয়েদের জানাবেন না। সেটি লিখে উকিলের কাছে রেখে দিবেন। তাহলে কিন্তু যথেষ্ট আরামে আয়েশে ছেলে, ছেলের বউ সবার সাথে থাকতে পারবেন। কারণ তাদের ভিতরে একটি আশা থাকবে যে, বাবা মরলে সম্পত্তিটা পাবো।
কিছুদিন আগে টেলিভিশনে প্রচারিত একটি বিজ্ঞাপনের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে এম এ মালেক বলেন, ওই বিজ্ঞাপনে ছেলে তার বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে নিয়ে যাচ্ছিল। ঘর থেকে বের হয়ে গাড়িতে উঠবে এমন সময় ছেলের পুত্রসন্তান (অর্থাৎ যাকে নিয়ে যাচ্ছে তার নাতি) তার বাবাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে জিজ্ঞেস করলো। তখন তিনি জবাব দিলেন–তোমার দাদুকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসতে যাচ্ছি। উনি ওখানে থাকবেন, আমরা ওনার খরচ দিবো। ছেলে তখন পাল্টা প্রশ্ন করলো–তাহলে কী বাবা বুড়ো হয়ে গেলে তোমাকেও আমরা ওখানে দিয়ে আসবো? পুত্রের মুখে কথাটি শোনার পর তার হুঁশ হলো। তখন সে আর তার বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে নিয়ে যায়নি। এম এ মালেক বলেন, এটি একটি বিজ্ঞাপন, কিন্তু সমাজে আমাদের অগোছরে এমন হাজারটি ঘটনা ঘটছে, যেখানে ‘নাতি’র উপস্থিতি হয়তো থাকে না।
এম এ মালেক বলেন, আমরা আমাদের ছেলে মেয়েদের ফিউচার গঠনের জন্য ক্লাশ থ্রি–ফোর থেকে দার্জিলিং কিংবা শিলংয়ের স্কুলে পড়ার জন্য পাঠিয়ে দিই, দিচ্ছি। সে তো তখন থেকে আমাদের থেকে আলাদা হয়ে গেলো। ওখান থেকে আবার তাকে আমরা উচ্চ শিক্ষার জন্য ইউরোপ–আমেরিকা পাঠিয়ে দিচ্ছি। এখন সে ইউরোপ–আমেরিকা পছন্দ না করে কি আমাকে বা আপনাকে বেশি পছন্দ করবে?
আগে সন্তানেরা বৃদ্ধ বাবা–মাকে ছেড়ে যেতে পারেনি, কারণ আগে আমরা একটি শক্ত পারিবারিক বন্ধনে আবদ্ধ ছিলাম। এখন কিন্তু সেটি আর নেই। আমরাই কিন্তু তাদেরকে এক সময় দূরে সরিয়ে দিয়েছি। এখন বুড়ো বয়সে বলছি–আমাকে আমার ছেলে দেখে না। দোষ কিন্তু আমাদের। সন্তানের ভবিষ্যত গঠনের চিন্তায় আমরা বিভোর থাকি, ফিউচার গঠনের জন্য মরিয়া হয়ে উঠি। আর এই ফিউচার গঠনের জন্যই আমাদের সব শেষ হয়ে যাচ্ছে, সেটা আমরা দেখছি না।
এম এ মালেক বলেন, একটা বিষয় হচ্ছে– মরার আগে কখনো মরবেন না। আমরা মরার আগে হাজার বার মরে যাই। কেন মরবো? হায়াত–মউত আল্লাহর হাতে। যেদিন মরার সময় সেদিনই মরবো, একদিন আগেও নয়, একদিন পরেও নয়। এটি নির্ধারিত। জীবনটাকে একটা নোটবুকের সাথে তুলনা করে তিনি বলেন, এর প্রথম এবং শেষ পৃষ্ঠা লেখা হয়ে গেছে, মধ্যখানে খালি আছে। সেই খালি জায়গায় যদি আমরা ভালো কিছুতে ভরিয়ে তুলতে পারি তাহলে মানুষ বলবে লোকটা ভালো ছিল। নোটবুকের খালি অংশ যত সমৃদ্ধ হবে, ভালো দিয়ে পরিপূর্ণ করতে পারবো শেষ বিচারের দিন ততই পুরস্কৃত হবো। পরম করুনাময় অসীম দয়ালু আমাদের ভুলত্রুটি নিশ্চয় ক্ষমা করে দেবেন। তিনিই তো সর্বাপেক্ষা ক্ষমাশীল। এম এ মালেক প্রবীণদের হতাশ না হয়ে জীবন নামের নোটবুকের খালি অংশটি ভালোকাজে পরিপূর্ণ করে তোলার আহ্বান জানান। অনুষ্ঠানে সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল হক আনসারী, জয়েন্ট সেক্রেটারী অধ্যাপক দিলীপ কান্তি দাশ, মুক্তিযোদ্ধা আবদুল গনি, জায়েদ আহমদ, অধ্যাপক মো. আলী, সিরাজুল করিম মানিক, মহসিন আলী মহসিন, আ ন ম দুলাল, রতন কুমার বড়ুয়া, স্বপন কুমার পালিত, ডা. দুলাল দাশ, কেপ্টেইন মাহবুবুল আলম, তারেক কামাল, শওকতুল ইসলাম প্রমুখ সিনিয়র সদস্যরা বক্তব্য রাখেন।