বাংলাদেশ আমলে ৫১ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম হজ্ব করতে আর্থিক প্রতিকূলতা প্রকট হয়ে উঠে। দেশের কোটা ১ লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জন। ৪/৫ বার করে সময় বাড়িয়েও হজ্বের কোটা প্রায় ৪৪ হাজার অপূর্ণ রয়ে গেছে। এর মূলে হজ্বের ব্যয় অত্যধিক বৃদ্ধি পাওয়া। তার সাথে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশ বিমান ও সৌদি হজ্ব কর্তৃপক্ষ। দেশে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে হজ্ব কার্যক্রম হলেও কাফেলা এজেন্সীর ভূমিকা প্রবল। যেহেতু বেসরকারীভাবেই হজ্বে গমন করতে মানুষের আগ্রহ। যেমন চলতি বছর সরকারীভাবে চূড়ান্ত নিবন্ধন করেছেন মাত্র ৪ হাজার ২ শত ৫৪ জন। অপরদিকে বেসরকারী তথা কাফেলা এজেন্সীর নিয়ন্ত্রণে হজ্বে যেতে চূড়ান্ত নিবন্ধন করেছেন ৭৮ হাজার ৮ শত ৭৫ জন। শতে দু’য়েক জন বাদে কাফেলা এজেন্সী মূলত ব্যবসা। তাদের নিজেদের পারিবারিক খরচ, অফিস ভাড়া, স্টাফ বেতন নিয়ে বিশাল ব্যয়। তাদের ব্যয় ঠিক রেখেই হজ্ব ওমরাহকারীর সেবা দেন। বাংলাদেশ বিমানের বৃহত্তর স্বার্থে হজ্ব করতে থার্ড ক্যারিয়ারকে অনুমতি দেয়া হচ্ছে না। যাওয়া–আসায় একদিকে ফ্লাইট খালি থাকে বিধায় ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে অস্বাভাবিক বেশি। যা কোন মতেই গ্রহণযোগ্য নয়। বাংলাদেশ বিমানে ১ লাখ ৯৪ হাজার ৮ শত টাকা ভাড়া নির্ধারণ খুবই অস্বাভাবিক; হজ্বযাত্রীগণের প্রতি অবিচার বললে বাড়িয়ে বলা হবে না। জানি না বিমান লোকসানের টাকাটা হজ্বযাত্রীগণের কাছ থেকে পুষিয়ে নিতে চাচ্ছে কিনা!
অপরদিকে সৌদি আরবে হজ্ব নিয়ন্ত্রিত হয় হজ্ব ও ওমরাহ মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে। করোনা মহামারীর আগে মোয়াল্লেমরা এবং বাস কোম্পানী অনেকটা হজ্বকে নিয়ন্ত্রণ করত বলা যেতে পারে। করোনার পর থেকে হজ্বকে হজ্ব ও ওমরাহ মন্ত্রণালয় অনেকটা সরাসরি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। মোয়াল্লেম প্রথা থাকলেও তাদের কার্যক্রম অনেকটা গৌণ। হজ্ব ও ওমরাহ মন্ত্রণালয় হজ্বযাত্রীগণের মান নির্ণয়ে দৃষ্টি দিতে গিয়ে ৫ দিনব্যাপী হজ্ব কার্যক্রমের ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়।
দেশে ধর্ম মন্ত্রণালয় এবং কাফেলা এজেন্সী হজ্বের প্যাকেজ ঘোষণা করলেও বাস্তব ক্ষেত্রে বেসরকারীভাবে শত ভাগ ঠিক থাকবে না। চট্টগ্রাম অঞ্চলে শতের কম বেশি এজেন্সী রয়েছে। হজ্বযাত্রী স্বল্পতায় তারাও প্রতিকূলতায় পড়ছে। চট্টগ্রাম অঞ্চলে হজ্বের প্যাকেজ বি ক্যাটাগরি ৬ লাখ টাকার কম বেশি, এ ক্যাটাগরি ৭ লাখ টাকার কম বেশি নেয়া হচ্ছে। তাও আবার হজ্বের কোরবানী তথা দমে শুকরিয়া বাদ দিয়ে।
পবিত্র কুরআন মাজীদে ও হাদীস শরীফে হজ্বের পাশাপাশি ওমরাহ এর কথাও বলা আছে। হজ্ব ও ওমরাহকারীগণ মহান আল্লাহ পাকের দাওয়াতী মেহমান। বাস্তবতা নিরিখে ১৪ শত বছরের ব্যবধানে দীর্ঘ ১৩ শত বছর ওমরাহ পালন হত খুবই স্বল্প সংখ্যক, তাও হেজাজের পবিত্র মক্কা কেন্দ্রীক। যেখানে হজ্ব পালন করা শারীরিকভাবে কষ্টসাধ্য ও সময় সাপেক্ষ ছিল, সেখানে ওমরাহ এর কথা আসে না। পবিত্র মক্কা ও পবিত্র মদিনায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে যাতায়াত সহজতর আরামদায়ক হওয়ায় মানুষের মাঝে ওমরাহ পালনের প্রতি আগ্রহ বেড়ে যায়। অপরদিকে ওমরাহ পালন করতে তেমন আইন কানুন নেই বললেই চলে। ওমরাহ সারা বছরের জন্য উন্মুক্ত। হজ্ব ৫ দিনব্যাপী নির্ধারিত সময়ে।
করোনা মহামারীর আগে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ন্যূনতম ৩ লাখ টাকা দিয়েও হজ্ব করা গেছে। ২০২০ সালে করোনা মহামারীর ভিতর ১ হাজার জনের স্থলে ৯৩৭ জন সৌদি সরকারের অর্থায়নে হজ্ব করেন। ২০২১ সালে ৬০ হাজার জনের স্থলে দুই ক্যাটাগরিতে ৫৮ হাজার ৫ শত ১৫ জন হজ্ব করেন সৌদি আরবের অভ্যন্তর থেকে। ২০২২ সালে দেশী–বিদেশী মিলে ১০ লাখ নর–নারী হজ্ব করেন। ২০২২ সালে এসে সৌদি হজ্ব ও ওমরাহ মন্ত্রণালয় হজ্বকে সরাসরি নিয়ন্ত্রণে নিতে গিয়ে হজ্বের ব্যয় দ্বিগুণের অধিক বেড়ে যায়। ফলে গত বছর ২০২৩ সালে বাংলাদেশের কোটায় ৪–৫ হাজার হজ্বযাত্রীর স্বল্পতা ছিল। চলতি ২০২৪ সালে বাংলাদেশের কোটার প্রায় ৪৪ হাজার জন খালি যাচ্ছে। এর মূলে হজ্বযাত্রীগণের মাঝে আর্থিক প্রতিকূলতা। ফলে মানুষের মাঝে ওমরাহ করার দিকে মন পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে, তার মূলে ব্যয় কম। ন্যূনতম ব্যয় ১ লাখ থেকে সোয়া লাখ টাকায় ১৫ দিনের প্যাকেজে ওমরাহ করা যায় হজ্বের সময় বাদে বছরের যে কোন সময়। এতে আরও সুবিধা হল কিছু কিছু থার্ড ক্যারিয়ার সে দেশের ট্রানজিট হয়ে স্বল্প মূল্যে ওমরাহ এর প্যাকেজ দিচ্ছে। কাফেলা এজেন্সীরাও তাদের ব্যবসা ঠিক রাখতে ওমরাহ এর দিকেও ঝুঁকে গেছে। তারা ইউটিউব, ফেইজবুকের মাধ্যমে প্রচারণা বাড়িয়ে দিয়েছে।
পেছনে দৃষ্টি দিলে জানা যায়, পাকিস্তানের ২৩ বছর আমলে এবং বাংলাদেশ আমলের ৫১ বছরে হজ্বযাত্রীর চাপে ছিল সরকারী যথাযথ কর্তৃপক্ষ। অর্থাৎ পাকিস্তান আমলে পানির জাহাজে ডেক শ্রেণীতে এবং বাংলাদেশ আমলের প্রথম দিকে বিমানে হজ্বযাত্রীর সংখ্যা অত্যধিক থাকায় লটারীর মাধ্যমে নির্ধারণ করতে হত। আফসোসের বিষয়, গত বছর হজ্বের কোটা খালি গেল ৪–৫ হাজার জনের। চলতি বছর ২০২৪ সালে প্রায় ৪৪ হাজার জনের কোটা খালি যাচ্ছে, যা বিশ্বের বুকে আমাদের জন্য লজ্জাকর ব্যাপার।
বাংলাদেশ বিমান ওমরাহ এর ক্ষেত্রে যাওয়া–আসা ভাড়া নিচ্ছে ৯০ হাজার কম বেশি। কিন্তু হজ্বের ক্ষেত্রে ১ লাখ ৯৪ হাজার টাকা নেয়ার ক্ষেত্রে যৌক্তিকতা দেখাচ্ছে যাওয়া–আসার ক্ষেত্রে একদিকে ফ্লাইট খালি রাখতে হচ্ছে।
চট্টগ্রামের একাধিক হজ্ব এজেন্সী প্রধান দুঃখ করে বলেন, বিমান হজ্বযাত্রীর প্রতি আন্তরিক হলে খালি ফ্লাইটে ১ মাসের জন্য সৌদি আরব থেকে লাখ লাখ প্রবাসীদেরকে কিছুটা কম মূল্যে দেশে আসা–যাওয়ার সুযোগ করে দিতে পারে। এই আয়কে হজ্বযাত্রীর বিমান ভাড়ার সাথে সমন্বয় করে বিমান ভাড়া তিন ভাগের এক ভাগ বা অর্ধেকে কমিয়ে আনা যাবে। বিমান হজ্বযাত্রীর প্রতি উদারতার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে মাসখানেকের জন্য সৌদি আরব থেকে প্রবাসীদের প্যাকেজ দেওয়ার এখনও সময় রয়ে গেছে। এই ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
হজ্বের ক্ষেত্রে এ রকম বিশাল অংকের কোটা খালি যাওয়া মুসলিম বিশ্বসহ বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তির উপর আঘাত বললে বাড়িয়ে বলা হবে না। সরকার দেশে অনেক খাতে ভর্তুকি দিয়ে টিকে রেখেছে, তৎমধ্যে বাংলাদেশ বিমান অন্যতম। দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে বাংলাদেশ বিমানের ভাড়া হজ্বযাত্রীদের ক্ষেত্রে অযৌক্তিক ও অগ্রহণযোগ্য।
হজ্ব পালন দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ বিষয়ে ধর্ম মন্ত্রী ও ধর্ম সচিবের উচিত হবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠক করে হজ্বের বিষয়ে দিক নির্দেশনা নেয়া। এইভাবে অস্বাভাবিক হজ্বের ব্যয় বৃদ্ধি এবং কোটার তিন ভাগের এক ভাগ তথা প্রায় ৪৪ হাজার খালি যাওয়া আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের তথা সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে, হবে।
আবারও উল্লেখ করতেছি, হজ্ব ফ্লাইটের সাথে দেশীয় প্রবাসীদেরকে মাসখানেকের জন্য দেশে আনা নেয়ার বিষয়ে যুক্ত করা হোক, বিমান ভাড়া কমিয়ে আনা হোক।
উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল সৌদি আরবে পাঠানো হোক, তারাও যেন হজ্বের ব্যয় কমিয়ে দেয়। মোয়াল্লেম থেকে হজ্ব ও ওমরাহ মন্ত্রণালয় সরাসরি নিয়ন্ত্রণে নেয়ার কারণে ৫ দিনব্যাপী হজ্ব কার্যক্রমে অব্যবস্থাপনা পরিলক্ষিত হয়েছে। মিনা তাঁবুতে আসন পাওয়া, খাবার গ্রহণ, ৫ দিন ব্যাপী হজ্বযাত্রী পরিবহনে অব্যবস্থাপনা, বিশৃংখলা হজ্বযাত্রীগণের মুখে মুখে।
বাংলাদেশ ইন্দোনেশিয়া, ভারত, পাকিস্তানকে সাথে নিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারে।
সর্বোপরি দেশে হজ্বযাত্রীর বিমান ভাড়া কমানো হোক, সৌদি আরবে হজ্বের ব্যয় কমাতে শৃংখলা ঠিক রাখতে প্রচেষ্টা চালানো হোক।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট।