প্রবাহ

নোয়াখালীর ঐতিহ্য বজরা মসজিদ

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ at ৬:৩৬ পূর্বাহ্ণ

নোয়াখালীতে সরকারী বেসরকারী যে কেউ গমন করলে বজরা মসজিদ দেখতে মন থেকে তাড়িত হবে স্বাভাবিক। নোয়াখালীর কয়েকটি ঐতিহ্যশীল স্থাপনার মধ্যে এই মসজিদ অন্যতম। প্রায় ১২/১৩ বছর আগে সকালবেলা স্বল্প সময়ের জন্য এই মসজিদে আসা হয়েছিল। ক’দিন আগে ২ দিনের প্রোগ্রামে নোয়াখালী মাইজদী গমন করলে মাগরিবের নামাজ পড়ার লক্ষ্যে এই মসজিদে আসা হয়। সোনাইমুড়ী উপজেলায় এই মসজিদের অবস্থান। যা মাইজদীকুমিল্লা মহাসড়ক থেকে মাত্র ২/৩ শ মিটার ব্যবধানে। দেশে মোঘল আমলের অনেক মসজিদ রয়েছে। কিন্তু ৩ গম্বুজের এই বজরা মসজিদটি জনগণের কাছে অন্যতম আকর্ষণীয়।

দিল্লি সম্রাট মুহাম্মদ শাহ এর আমলে আমান উল্লাহ খান ও সানা উল্লাহ খান নামে দুই ভ্রাতা নোয়াখালী এই অঞ্চলের জমিদারি লাভ করেন। তারা যেমনি ছিলেন ন্যায়পরায়ণ তেমনি ছিলেন ধার্মিক। ফলে ১৭৪১ সালে এই মসজিদ নির্মাণ করেন। যার দৈর্ঘ্য ৫৪ ফুট প্রস্থ ১৭ ফুট। ২০ ফুট উচ্চতায় তিন গম্বুজ বিশিষ্ট। মসজিদটি মজবুত করার জন্য জমিদার ভ্রাতা মাটি খনন করে ২০ ফুট গভীর হতে ৫ ফুট পুরো করে ভিত তৈরি করেন বলে জানা যায়।

দিল্লি থেকে আনা রাজমিস্ত্রির অক্লান্ত পরিশ্রমে প্রায় ২৫/২৬ বছর সময় লাগে নির্মাণ কাজ শেষ করতে। মসজিদের সম্মুখে প্রায় ৩০ একরের বিশাল এরিয়া নিয়ে দিঘী খনন করা হয়। দিঘীর পশ্চিমপাড়ে তথা আজানখানার সামনে প্রকান্ড ঘাট দেয়।

সাবেক মহকুমা বর্তমান তিন জেলা নিয়ে বৃহত্তর নোয়াখালী। তথা নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুর। তৎমধ্যে ফেনীর পূর্বাঞ্চল বাদে নোয়াখালী অনেকটা নিচু জায়গা। ১৯৫০ এর শেষ দিকে এসে স্থল যোগাযোগের লক্ষে রাস্তা ঘাট নির্মাণ শুরু হয়। তার আগে নোয়াখালী নৌকা সাম্পান নির্ভরশীল ছিল। বজরা সেকালের এক প্রকার নৌযান। সচ্ছল তথা ধনীরা সেকালে বজরা ব্যবহার করত নদীপথে যাতায়াতে। কয়েকদিন অবস্থান করা যায় মত যাবতীয় ব্যবস্থা থাকত এই ছাউনিযুক্ত বজরাতে। নোয়াখালী, ভোলা, বরিশাল অঞ্চলে একালের নিজস্ব কার জিপের বিপরীতে সেকালের নিজস্ব বজরা ব্যবহৃত হত। ঐ অঞ্চল বছরে প্রায় ৬ মাস মত পানিতে ডুবে থাকত। মাটি ভরাট করে উঁচু করে পানিতে না ডুবে মত বাড়ি নির্মাণের ব্যবস্থা হত। বছরে প্রায় ৬ মাস পানিতে ডুবে থাকা অঞ্চল বিধায় ধানকে সিদ্ধ করে চাউল করে খেতে হত। প্রতিকূলতায় সবজি উৎপাদনের চেয়ে মাছের আধিক্যতা ছিল।

হযরত মিয়াম্বর শাহ নামে একজন কামেল অলি বজরা সহযোগে নোয়াখালী পানি অধ্যুষিত এই অঞ্চলে আগমন করেন। তাঁর সাথে দিল্লির বাদশাহ মুহাম্মদ শাহ এর সুসম্পর্ক ছিল বলে জানা যায়। হযরত মিয়াম্বর শাহ নোয়াখালীর ঐ এলাকায় পৌঁছলে দিল্লি বাদশাহ এর শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্ব বিধায় জমিদার আমান উল্লাহ খান ও সানা উল্লাহ খান তাঁর প্রতি সম্মান দেখান। মসজিদ নির্মিত হয়ে গেলে প্রবেশ পথে ফার্সি ভাষায় (তখন এই ভারতবর্ষে রাষ্ট্র ভাষা ফার্সি ছিল) স্মৃতিফলকে যে লেখা রয়েছে তার বাংলা অনুবাদ নিম্নরূপ:-

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম, হযরত মুহাম্মদ (.) আল্লাহর বান্দা ও রাসূল, মসজিদের সৌন্দর্য হল মেহেরাব ও মিম্বর। হযরত আবু বকর (.) হযরত ওমর (.) হযরত ওসমান (.) হযরত আলী (.) (হায়দার) তারা ৪ জন খোলাফায়ে রাশেদীন। উক্ত ৪ খলিফা যেভাবে দ্বীনের নক্ষত্র অনুরূপভাবে মসজিদও দ্বীন প্রচারের উদয়ীমান সূর্য। মোঘল সম্রাট মুহাম্মদ শাহ এর আমলে আমান উল্লাহ খান এই মসজিদটি নির্মাণ করে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করেন। ১১৫৪ হিজরি (তথা ১৭৪১ খ্রিস্টাব্দ, ১১৩৯ বাংলা) মসজিদের নির্মাণ কাজ শেষ হলে দিল্লির সম্রাট মুহাম্মদ শাহ এর আবেগ ও আগ্রহে পবিত্র মক্কার বাসিন্দা মতান্তরে দিল্লির বাসিন্দা তৎকালীন বড় বুজুর্গ হযরত মাওলানা মুহাম্মদ আবু ছিদ্দিকী প্রথম ইমামতির দায়িত্ব নেন। তিনি মসজিদ সংলগ্ন বাড়িতে অবস্থান করতেন। ফলে ঐ বাড়ি ইমাম বাড়ি নামে প্রসিদ্ধ। তিনি দীর্ঘ ৫৫ বছর ইমামতির দায়িত্ব পালন করে ইন্তেকাল করলে মসজিদ চত্বর সংলগ্ন তাকে সমাহিত করা হয়। অতঃপর তার একমাত্র পুত্র মাওলানা মুহাম্মদ ইসমাইল ছিদ্দিকী ইমামতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি একাধারে ৫১ বছর ইমামতির দায়িত্ব পালন করে ইন্তেকাল করলে পিতার কবর সংলগ্ন তাকে সমাহিত করা হয়। এরপর তৃতীয় ইমামের দায়িত্ব গ্রহণ করেন মাওলানা মির্জা মুহাম্মদ আবুল খাইর ছিদ্দিকী। তিনি ৪৩ বছর ইমামতির দায়িত্ব পালন করে ইন্তেকাল করেন। তিনি অবশ্য মসজিদ সংলগ্ন স্থান থেকে সরে গিয়ে মির ওয়ারিশপুর গ্রামে গিয়ে বসতি স্থাপন করেন। তাঁর দুই সংসার। ইন্তেকাল পরবর্তী প্রথম ঘরের ছোট সন্তান মাওলানা আলি করিম ছিদ্দিকী চতুর্থ ইমামের দায়িত্ব পায়। তিনি একটানা ২৭ বছর ইমামতি করে ইন্তেকাল করলে তার পুত্র মাওলানা মুহাম্মদ গোলাম মউলা ছিদ্দিকী পঞ্চম ইমাম হন। তিনি এক নাগাড়ে ৪৫ বছর ইমামতি করে ১০ নভেম্বর ১৯৭২ সালের শুক্রবার ইন্তেকাল করেন। তার একমাত্র পুত্র মাওলানা আবদুল্লাহ ছিদ্দিকী ষষ্ঠ ইমাম হিসেবে দায়িত্ব নেন। তিনি একটানা ২৩ বছর ইমামতি করে ৬ ডিসেম্বর ১৯৯৫ সালে ইন্তেকাল করেন। এতে তার তিন পুত্রের মধ্যে দ্বিতীয় পুত্র মাওলানা ইমাম হাসান ছিদ্দিকী সপ্তম ইমাম হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করে অদ্যাবধি পালন করে যাচ্ছেন।

বস্তুতঃ উক্ত সব বর্ণনা বর্তমান ইমাম মাওলানা ইমাম হাসান ছিদ্দিকী রচিত পুস্তিকা থেকে সংগৃহীত। গত ১৬ জানুয়ারি মঙ্গলবার আবু মুহাম্মদ নুরুল ইসলাম ও এডভোকেট মুহাম্মদ ইলিয়াসকে সাথে নিয়ে নোয়াখালীর মাইজদী যাওয়া হয় ২ রাত অবস্থানের পরিকল্পনা নিয়ে। দুপুরে পৌঁছে জেলা প্রশাসনের আতিথেয়তায় সার্কিট হাউসে অবস্থান নেয়া হয়। পরদিন বজরা মসজিদের সামনের রাস্তা দিয়ে লাকসাম গমনের প্রোগ্রাম থাকলেও এই মসজিদে সময় দেয়া; মাগরিবের নামাজ পড়া; সে লক্ষে আছরের নামাজ পড়ে আমরা ৩ জন প্রায় ১০/১২ কি.মি দূরত্বে বজরা মসজিদে চলে যাই। ইমাম সাহেবকে তথায় উপস্থিত পেলাম। সংবাদ পেয়ে ২/৩ কি.মি দূরত্বে জৈনপুরী মসজিদের ইমাম মাওলানা রফিক আহমদও এখানে উপস্থিত হন মাগরিবের পর মাইজদী ফেরার পথে সেখানকার মসজিদ মাদ্রাসা দেখাতে। বিশ্বখ্যাত সুফি সাধক ভারতে উত্তরপ্রদেশের বাসিন্দা হযরত কেরামত আলী জৈনপুরী (রহ) নোয়াখালী সফরকালে এখান থেকে বিয়ে করেন। এখানে মসজিদ বাড়িঘর তাঁর সন্তানসন্ততি রয়েছে। উভয় ইমামের সাথে মাগরিবের আগে হাঁটাহাঁটি অনেক আলাপ হয়। এতে জানতে পারলাম এবং দেখলাম বিগত ১২/১৩ বছরের ব্যবধানে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। মসজিদের মূল কাঠামো ঠিক রেখে উত্তর দিকে বিশালভাবে সম্প্রসারণ করা হয়েছে। যেহেতু জুমার নামাজে ব্যাপক সমাগম হচ্ছে। দূরদুরান্ত থেকে অনেক নারীপুরুষ আসতেছেন এখানে জুমার নামাজ পড়তে।

সোনাইমুড়ী উপজেলার ইউএনও কে সভাপতি করে একটি শক্তিশালী কমিটি রয়েছে। ওয়ারিশক্রমে মাওলানা ইমাম হাসান ছিদ্দিকীকে ইমাম ঠিক রেখে একজন খতিব নিয়োগ দেয়া হয় অবস্থা বিবেচনায় প্রায় ১০ বছর আগে। প্রতি জুমার পর দানবাক্স খোলা হয়। এতে প্রায় ৬০/৭০ হাজার টাকা সংগ্রহ হয়। বাজারসহ অন্যত্র দানবাক্স খোলা হয় মাসিক ভিত্তিতে। আমরা যখন এখানে আছরের পর পৌঁছলাম, এই মসজিদকে দেখতে আসলাম তখনও দূরদূরান্ত থেকে নারীপুরুষ আসতেছে যাচ্ছে। যেখানে মাসে ২ লক্ষ টাকার অধিক পাওয়া যাচ্ছে সেখানে টাকার ঘাটতি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু প্রায় ৩০ একরের বিশাল দিঘীটি বর্তমানে অনেকটা বেদখল বলা যায়। এখানে ধান চাষ হচ্ছে। মসজিদের সামনে মাত্র ২০/২৫ শতকের পুকুর চোখে পড়ছিল। যেখানে তহবিলের স্বল্পতা নেই; ইউএনও সাহেব উপজেলা প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে শক্ত অবস্থান নিয়ে এগিয়ে গেলে এই বিশাল দিঘীটি ঐতিহ্যশীল এই মসজিদের অনুকূলে পুনরুদ্ধার করা কঠিন কিছু নয়। তাকে নোয়াখালী জেলা প্রশাসন এবং স্থানীয় এমপি, মন্ত্রী যে সহযোগিতা করবে তাতে ইতস্ততা থাকতে পারে না। যেহেতু এই মসজিদকে নিয়ে নোয়াখালী বাসী গর্ববোধ করে মনে করি।

দিঘীটি পুনঃ খনন করায়ে এলাকাটিতে মানুষ যাতে এই মসজিদে নামাজ পড়ার পাশাপাশি অবস্থান নিতে পারে সেই লক্ষ্যে ধর্মীয় আবহ ঠিক রেখে সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি করা কঠিন নয়।

লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধশহীদ মিনারে প্রাণের মেলা
পরবর্তী নিবন্ধলোহাগাড়ায় দিন-দুপুরে শিক্ষক দম্পতির বসতঘরে চুরি