প্রবাহ

তুরস্কের রেল ব্যবস্থাপনা আমাদের দেশে অনুকরণীয়

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ১৫ নভেম্বর, ২০২৩ at ৬:১৫ পূর্বাহ্ণ

গত আগস্টে তুরস্কে ৮ দিন অবস্থানকালে ৩ বার ট্রেনে যাতায়াতের সুযোগ হয়। এতে ভাবতে থাকি আমাদের দেশে রেল ব্যবস্থাপনা কত পিছিয়ে। আগে ২০০৮ ও ২০১১ সালে তুরস্ক সফর করা হয়েছিল। তখন সড়কপথে বা আকাশপথে ইস্তাম্বুল থেকে অন্যত্র যাওয়া আসা করা হয়। কিন্তু এই বার ইস্তাম্বুল থেকে প্রায় ৭ শত কি.মি এর অধিক দূরত্বে কোনিয়া, কোনিয়া থেকে ২৪০ কি.মি দূরত্বে রাজধানী আঙ্কারা এবং রুটে থেকে প্রায় ৪২৫ কি.মি দূরত্বে ইস্তাম্বুল আসা হয়।

এতে তিন দেশ থেকে ক্রেডিট কার্ড এর মাধ্যমে টিকেট কাটা হয়। এইবারে আমরা সফরে ৫ জন। আমার কনিষ্ঠ পুত্র ইঞ্জিনিয়ার ইশতিয়াক উদ্দিন চৌধুরী রিফাত ছাড়া, বাকি আমিসহ এডভোকেট মুহাম্মদ ইলিয়াস, এমদাদ উল্লাহ, নুরুল ইসলাম সহ আমরা ৪ জন ৬৫ বছরের উপরে বিধায় আমাদের জন্য ভাড়া ৫০% ডিসকাউন্ট। অবশ্য তা ইকোনিমি ক্লাসে। ভারতে ৬০ বছরের ঊর্ধ্বে দেশী বিদেশী সকলের জন্য ভাড়ার ওপর ৩০% কম নিত। কিন্তু ভারতের বর্তমান সরকার বিদেশীগণের ক্ষেত্রে তা বাতিল করে দেয়।

আমরা ১৪ আগস্ট সোমবার সকাল ৮ টার ট্রেনে ইস্তাম্বুল থেকে কোনিয়া যাই। ইকোনিমি ক্লাসে আমরা ৪ জনের জন প্রতি ভাড়া নিল ৪০৬ লিরা স্থলে ২০৩ লিরা। এর পরদিন বিকালে ৩:২৫ ট্রেনে কোনিয়া থেকে যাওয়া হয়। ২৪০ কি.মি দূরত্বে সময় নিল ১ ঘন্টা ৪০ মিনিট। ভাড়া ১৫০ লিরার স্থলে শুধুমাত্র ৭৫ লিরা নিল। ২ রাত থেকে ১৭ আগস্ট বৃহস্পতিবার সকাল ৭ টার ট্রেনে ইস্তাম্বুল প্রায় ৪২৫ কি.মি দূরত্বে সময় নিল প্রায় ৪ ঘণ্টার কম বেশি। তবে আঙ্কারাইস্তাম্বুল বিজনেস ক্লাস নেওয়ায় আমাদেরকে কোন ডিসকাউন্ট দিল না, ভাড়া নিল ৪৯৫ লিরা। তুরস্কে নিজেদের তৈরি ট্রেন। এটা অনেকটা উন্নত বিশ্বের মত দ্রুত গতির ট্রেন বলা যাবে।

ইস্তাম্বুলের ট্রেন স্টেশনটি এশিয়া অংশে কাজেই আমাদেরকে টেক্সী নিয়ে ইউরোপীয় অংশের হোটেল থেকে বসফরাস প্রণালী বিশ্বখ্যাত ঝুলন্ত ব্রীজ হয়ে আসতে হল। সে লক্ষ্যে সাবধনতার জন্য ভোরের ট্রেনের টিকেট না নিয়ে সকাল ৮ টার টিকেট নেয়া হয়।

ইস্তাম্বুল থেকে দূর পাল্লার ট্রেন চালু থাকলেও মনে হচ্ছিল ট্রেন স্টেশন এখনও নির্মাণাধীন। বিশাল এরিয়া নিয়ে স্টেশন নির্মাণের কাজ চলমান। এখান থেকে নাকি দূর পাল্লার ট্রেন এবং ইস্তাম্বুলের বৃহত্তর এরিয়ার ট্রেন সমান্তরালে চলে। স্টেশনের কাজ সমাপ্ত হলে হয়ত পৃথক পৃথক হয়ে যাবে। এই ট্রেনগুলি অসাধারণ। যেমনি সুন্দর, তেমনি আরামদায়ক। ইকোনমি হলেও দুই চেয়ার করে ৪ চেয়ার যা খুব বড়সড়, আরামদায়ক, মধ্যখানে যাতায়াত। কোচের প্রবেশ মুখে বড় সড় লাগেজ রাখার জন্য তাক দেয়া আছে। যা আমাদের দেশের ট্রেনগুলোতে নেই। এ দেশের ট্রেনে বড় বড় লাগেজ উপরে ছোট পরিসরে রাখা নিরাপদ নয়। ওখানে লাগেজ উঠানামা কষ্টদায়ক, ঝুঁকিপূর্ণ এবং লাগেজ ওখান থেকে যাত্রীর মাথার উপর পড়তে পারে।

তুরস্কের ট্রেনগুলো এক কোচ থেকে আরেক কোচে যেতে ন্যূনতম ভয় অনুভব হয় না। অবশ্য এখানে কোচের সংখ্যা বেশি নয়। সর্বোচ্চ ৫/৭ টি হবে। যেমনটা চায়না, উজবেকিস্তানেও দেখা গেছে। মনে হয় বুলেট ট্রেনে কোচের সংখ্যা কম রাখে নিরাপত্তা চিন্তা করে।

ইস্তাম্বুল থেকে সকাল ৮.১০ মিনিটে কোনিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে প্রায় ঘণ্টার কাছাকাছি ট্রেনটি মাত্র ৪০ কি.মি গতিতে চলতেছিল। অতঃপর গতি তোলা হয়। গতি ২৫০২৬০ কি.মি এর মধ্যে উঠানামা করছিল। অবশ্য চীনে গুয়াংজু থেকে সাংহাই এবং পবিত্র মদিনা থেকে পবিত্র মক্কায় গতি ঘণ্টায় আর ৫০ কি.মি বাড়িয়েছে। তথা ৩০০৩১০ কি.মি।

বুলেট ট্রেনে গতি আরও বাড়ার সম্ভাবনা থাকলেও হয়ত নিরাপত্তার খাতিরে গতি তোলা হয় না। অনুরূপভাবে আঙ্কারা থেকে ইস্তাম্বুল আসতেও। ইস্তাম্বুল থেকে শত কি.মি দূরত্ব থাকতে গতি কমিয়ে দেয়া হয়। ৪০ কি.মি এর মধ্যে নামিয়ে আনা হয়। এতে প্রতীয়মান হয় দূরপাল্লার ট্রেনের লাইনের কাজ এখনও সমাপ্ত হয়নি।

আমরা ৪ ঘণ্টার সময়ের কিছু ব্যবধানে দুপুর ১২ টার পরপর কোনিয়া ট্রেন স্টেশনে পৌঁছে হোটেলে চলে যাই। কোনিয়া আবহাওয়া গরম ৩৪ থেকে ৩৭ ডিগ্রী, তাপমাত্রা ইস্তাম্বুল থেকে ৫/৬ ডিগ্রী বেশি।

কোনিয়া থেকে পরদিন বিকাল ৩ টা ২৫ মিনিটের ট্রেনে প্রায় ২৪০ কি.মি দূরত্বে রওনা করি ইকোনিমি ক্লাসে মাত্র ১ ঘণ্টা ৪০ মিনিট সময়ে। আমরা পৌঁছে টেক্সী নিয়ে নির্ধারিত হোটেলে চলে যাই। আমাদের হোটেলটি ট্রেন স্টেশন থেকে মাত্র ৩/৪ শত মিটারের মধ্যে। ২ রাত থেকে ১৭ আগস্ট বৃহস্পতিবার ভোরে ৭ টার ট্রেনে ইস্তাম্বুল গমনের টিকেট করা হয়।

আঙ্কারা ট্রেন স্টেশনটি মনে হয় নতুন নির্মিত। নানান সুযোগ সুবিধায় ভরপুর। আঙ্কারাতেও কোনিয়ার মত আবহাওয়া গরম। ইস্তাম্বুল সহনীয় তাপমাত্রা মাত্র ২৮/৩০ ডিগ্রী।

আমরা ১৭ আগস্ট বৃহস্পতিবার ভোরে আঙ্কারা হোটেল থেকে টেক্সী নিয়ে ট্রেন স্টেশনে চলে যাই। বেশি ভাড়া দিয়ে বিজনেস ক্লাস নিয়ে ভুল করলাম মনে হয়। বিজনেস ক্লাসের কোচে একদিকে এক সিট, আরেক দিকে দুই সিট। ট্রেন ছেড়ে দিলে একটি নাস্তার প্যাকেট দিল সাথে চাকফি। প্যাকেটটিতে একটি জুসের প্যাকেট, একটি ছোট পানির বোতল, একটি ফল, একটি সেন্ডুইচ, একটি বন দিয়েছে মনে পড়ছিল।

এমনিতে ট্রেনের লোকজন ট্রলি নিয়ে লিরার বিনিময়ে খাবার প্রদান করতেছিল। আমার কাছে ইকনোমি ক্লাসের চেয়ে বিজনেস ক্লাস তেমন আহামরি অনুভব হয়নি।

আমরা ইস্তাম্বুল ট্রেন স্টেশনে নেমে টেক্সী নিয়ে ইউরোপীয় অংশের বিমান বন্দরে চলে যাই মিশরের ১৩ দিনের প্রোগ্রামে কায়রো গমনের উদ্দেশ্যে।

বস্তুতঃ ট্রেন অতি আরামদায়ক নিরাপদ মাধ্যম। আকাশ ফ্লাইটে যখন বাতাসের কম্পনে বিমান কাপতে থাকে তখন মনের মধ্যে কম বেশি আতংক বিরাজ করবে স্বাভাবিক। সাগরে ঢেউয়ের কবলে পড়লে সেই একই অবস্থা ন্যূনতম হলেও আতংক বিরাজ করে। সড়কপথে ন্যূনতম হলেও আতংক টেনশন বিরাজ করবে না তা বলা যাবে না। কিন্তু ট্রেনে এসব কিছু নেই বলা যায়। ট্রেন আপন গতিতে নিয়মে চলতেই আছে। যাত্রীর এ নিয়ে কোন দুশ্চিন্তা নেই।

আমাদের দেশ বিশ্বের মধ্যে অতি ঘনবসতিপূর্ণ। এখানে সড়কে প্রায় সময় যানজট লেগেই থাকে। আইন আছে, বাস্তবায়ন নেই। যেখানে সেখানে পার্কিং, দোকানপাট। মহাসড়কেও যাত্রীবাহী বাস থামিয়ে যাত্রী উঠানামা করছে। দেশের সড়কে আইন না মানার প্রচলন হয়ে গেছে। পৃথক রেল লাইনে ট্রেন চলে। আমাদের দেশে রেলের গুরুত্ব অপরিসীম। সরকারের নিকট রেলের অত্যধিক গুরুত্ব লাভ করতে হবে।

চট্টগ্রামঢাকা ২৬০ কি.মি কম বেশি মাত্র। কিন্তু কুমিল্লাআখাউড়াব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রায় ৬০ কি.মি ঘুরপথে চট্টগ্রামঢাকা যাওয়া আসা চলমান। ব্রিটিশ পাকিস্তান আমল পেরিয়ে বাংলাদেশের ৫০ বছর পূর্তি পার হয়ে গেল। লাকসামনারায়ণগঞ্জ কট লাইন নির্মাণ করে চট্টগ্রামঢাকার ৬০ কি.মি দূরত্ব কমানোর আজ অবধি কোন খবর নেই।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ট্রেনে চড়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে। আমাদের দেশের কোচ ইঞ্জিন বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হয়। ভারত, ইরান, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া অন্যতম। আমাদের দেশে ট্রেন আমদানি করা হয়েছে, হচ্ছে। কিন্তু ট্রেনের কোচের মানগুলি আমার কাছে দুর্বল, মান সম্পন্ন নয় তথা আরামদায়ক মনে হচ্ছে না। অন্যান্য একাধিক যাত্রীও আমার কাছে একমত পোষণ করেন। দেশে একটা দুর্নাম আছে। বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করতে গিয়ে অর্ডার দেওয়ার সময় নাকি হেরফর হয়। জানি না ট্রেনের ক্ষেত্রে কি রকম। তবে একটা প্রবাদ আছে, যা কিছু রটে, কিছু না কিছু বটে। যেমন তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া, ভারত থেকে আমাদের দেশে ট্রেন আমদানি করা হয়। কিন্তু যে সব দেশের ট্রেনে চড়া হয়েছে ট্রেনগুলো কত সুন্দর, মজবুত, মানসম্পন্ন, আরামদায়ক। কেন জানি আমাদের দেশে আমদানি করা কোচগুলো তেমন ভাল মনে হয় না। দক্ষিণ কোরিয়া থেকে কেন রেলের কোচ আমদানি করা হচ্ছে বুঝে আসে না। ইন্দোনেশিয়া, ইরান, তুরস্ক থেকে বগি ও ইঞ্জিন আমদানি করলে আমাদের দেশের বহুবিধ কল্যাণ হবে মনে করি। বিদেশের সাথে দেশের যে কোন চূড়ান্ত চুক্তিতে মনে করি একটি গ্রুপ থাকে। তৎমধ্যে ৩ জন, ৫ জন বা ততোধিক হতে পারে। এই গ্রুপে ন্যূনতম ২/১ জন হলেও দেশ প্রেমিক লোক থাকা আবশ্যক। পরিশেষে আশা করব সরকার দেশের রেল ব্যবস্থাপনায় আরও সুন্দর স্বচ্ছ পরিবেশ ফিরিয়ে আনবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধলোহাগাড়ায় জামায়াতের চার নেতাকর্মী গ্রেপ্তার