প্রবাহ

তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারায় আতাতুর্কের সমাধিসৌধ

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ৮ নভেম্বর, ২০২৩ at ৬:৫২ পূর্বাহ্ণ

বিশ্বের দেশে দেশে জাতির পিতার সমাধিসৌধ নির্মাণ করা এক প্রকার ঐতিহ্যে পরিণত। তেমনিভাবে তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারায়ও তাদের জাতির পিতা মোস্তফা কামাল পাশার পরিকল্পিতভাবে সমাধিসৌধ নির্মাণ করা হয়। অতঃপর তার মরদেহ এই সমাধিসৌধে এনে রাখা হয়।

তুর্কি ভাষায় আতাতুর্ক অর্থাৎ তুর্কি জাতির পিতা। আতাতুর্ক ১৯৩৮ সালে মৃত্যুবরণ করেন। ফলে রাজধানী আঙ্কারার এক স্থানে তার মরদেহ রাখা হয়। অতঃপর এ পাহাড় কেন্দ্রিক দৃষ্টিনন্দন সমাধিসৌধ নির্মিত হওয়ার পর তার মরদেহ এ সমাধিসৌধে নিয়ে আসা হয়।

গত ১৬ আগস্ট বেলা ১১ টার দিকে সহযাত্রী আমার কনিষ্ঠ পুত্র ইঞ্জিনিয়ার ইশতিয়াক উদ্দিন চৌধুরী রিফাত, এডভোকেট মুহাম্মদ ইলিয়াস, এমদাদ উল্লাহ, আলহাজ্ব নুরুল ইসলামসহ আমরা ৫ জন টেক্সী নিয়ে কামাল আতাতুর্কের সমাধিসৌধের দিকে আসি। কিন্তু অনেক দূরত্বে টেক্সী থামিয়ে দেয়। নিকটে রিসিপশন রয়েছে দর্শনার্থীদের কল্যাণে। প্রশস্ত দুই লেইনের রাস্তার দু’দিকে বড় বড় গাছে ভরপুর। গরম আবহাওয়ায় বৃদ্ধ বয়সে আমি সাহস করতে পাচ্ছিলাম না এখান থেকে হেঁটে হেঁটে ৫/৭ শ’ মিটার উপরের দিকে যেতে। রিসিপশন থেকে বলা হল দর্শনার্থীদের নেয়া আনার জন্য গাড়ির ব্যবস্থা আছে। একটু পরে বাস্তবেও দেখতে পারছিলাম ৮/১০ জন বহন করতে পারে মত গাড়ি আসতেছে। আমরা গাড়ি করে পাহাড়ের উপরের দিকে চলে গেলাম। প্রায় ৫/৭ শ মিটার যাওয়ার পর আমাদেরকে নামিয়ে দিল। এখান থেকে সমাধিসৌধের অবকাঠামো শুরু। হেঁটে হেঁটে ৮/১০ ধাপ উপরে উঠতে হল। মধ্যখানে ২০/২৫ ফুটের খোলা চত্বর। দুইদিকে মিউজিয়াম। আমরা মিউজিয়াম দেখে দেখে সামনের দিকে যেতে থাকি। এভাবে প্রায় ১৫০/২০০ মিটার যাওয়ার পর বিশাল চত্বর। চত্বরের তিন দিকে একতলা বিশিষ্ট অবকাঠামো। বামপাশে কামাল আতাতুর্কের সমাধি। চত্বরে এসে ঐ দিকে হেঁটে হেঁটে গেলে সিঁড়ি দিয়ে প্রায় ২/৩ তলা সমান উপরে উঠতে হচ্ছিল। অতঃপর সামনে এগিয়ে যাওয়া। বিভিন্ন জায়গায় নিরাপত্তা বাহিনীর ৭/৮ জন করে প্যারেড করতেছে। ৭/৮ জনের মধ্যে একেক জনের ড্রেস একেক রকম। এতে মনে করি নিরাপত্তা বিভাগের প্রত্যেক দপ্তর থেকে একেক জন করে প্রতিনিধিত্ব করছে। মূল সমাধিসৌধের নিকটে গেলে জানতে পারি বুঝতে পারি কামাল আতাতুর্কের মূল দেহ নিচে অনেক গভীরে। তুরস্কের বড় সমস্যা ভাষাগত। ইংরেজির ব্যবহার কম, যেমনটা এখানেও।

বস্তুত প্রায় ১ বর্গ কি.মি বা কম বেশি এরিয়া নিয়ে একটি পাহাড়ের উপরে কামাল আতাতুর্কের সমাধিসৌধ কমপ্লেক্স মনে হচ্ছিল। এখানে রয়েছে বেশ কয়েকটি ছোট ছোট মিউজিয়াম। ঐসব মিউজিয়ামে কামাল আতাতুর্কের জীবনের বিভিন্ন দিক, অবদান তুলে ধরা হয়েছে।

বিখ্যাত স্থপতি এমিন উনার ও ওরখান আরদা এ সমাধিসৌধ কমপ্লেক্সের নকশা প্রণয়ন করেন। ১৯৪৪১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় ৯ বছরে এ স্মৃতিসৌধ কমপ্লেক্সের কাজ সমাপ্ত হয়। অতঃপর নভেম্বর ১৯৫৩ সালে জনসাধারণের জন্য খুলে দেয়া হয়।

এখানে উল্লেখ্য ১৯৩৮ সালের ১০ নভেম্বর আতাতুর্কের মৃত্যুর পর ঘোষণা করা হয় যে, আঙ্কারায় সমাধিসৌধ নির্মাণ না হওয়া পর্যন্ত তার দেহ আঙ্কারায় সংরক্ষণে থাকবে। সমাধিসৌধটি কোথায় নির্মাণ করা হবে তা নির্ধারণের জন্য সরকার একটি কমিশন গঠন করে। প্রস্তুতকৃত নকশার সাথে সামঞ্জস্য রেখে ১৭ জানুয়ারী ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে সমাধিসৌধ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। অতঃপর জমি অধিগ্রহণ, নকশা নির্ধারণ, একটার পর একটা এগিয়ে যেতে থাকে। এরপর ১৯৪৪ সালে ৯ অক্টোবর ভিত্তি প্রস্তর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ১৯৫৩ সালের ১০ নভেম্বর অনুষ্ঠিত একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আতাতুর্কের দেহ এখানে স্থানান্তর করা হয়।

২০০৮ ও ২০১১ সালে তুরস্কে গমন করা হলেও আঙ্কারা রাত্রিযাপন করার সুযোগ হয়নি। গত ৯ আগস্ট পুনঃ ইস্তাম্বুল গমন করলে ১৫, ১৬ আগস্ট দুই রাত আঙ্কারা অবস্থান করা হয়। সে লক্ষ্যে ১৪ আগস্ট সোমবার সকাল ৮ টার ট্রেনে প্রায় ৭ শ কি.মি দূরত্বে ইস্তাম্বুল থেকে কোনিয়া যাওয়া হয় মাওলানা রুমির যেয়ারতের উদ্দেশ্যে। ১৫ আগস্ট বিকালের ট্রেনে কোনিয়া থেকে প্রায় ২৪০ কি.মি দূরত্বে আঙ্কারায় আসি মাত্র ১ ঘণ্টা ৪০ মিনিটে। তুরস্কের ট্রেন ২৫০/২৬০ কি.মি গতিতে চলতে প্রত্যক্ষ করি। ট্রেনগুলো মানসম্পন্ন আরামদায়ক।

এতে ১৫ আগস্ট মঙ্গলবার আঙ্কারা কেন্দ্রীয় মসজিদে মাগরিবের নামাজ এবং ১৬ আগস্ট বুধবার কয়েকটি স্থানে গমনের প্রোগ্রাম রাখা আছে। তৎমধ্যে কামাল আতাতুর্কের সমাধিসৌধে গমন একটি। ঢাকা থেকে ইস্তাম্বুল গমন করে প্রথম ৫ দিন ইস্তাম্বুলের আবহাওয়া মনোরম পেয়েছিলাম। তেমনি প্রাচীন রাজধানী বুরসাতেও। তাপমাত্রা ২৬/২৭ থেকে ৩০/৩১ উঠানামা করছে। কিন্তু কোনিয়ার পাশাপাশি আংকারাতেও তাপমাত্রা ৩৭ থেকে ৩৯ ডিগ্রী উঠানামা করছে। আবহাওয়া অনেক গরম, অসহনীয়। এখানে সমাধিসৌধ কমপ্লেক্সে বসার ব্যবস্থা চোখে পড়তেছিল না।

বস্তুতঃ আঙ্কারা রাজধানী হলেও দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। যেখানে মতান্তরে ইস্তাম্বুলে ২ কোটি লোকের বাস সেখানে আঙ্কারায় হয়ত ৬০ লাখ বা কম বেশি বসবাস করে। তবে আঙ্কারার ইতিহাস অনেক পুরানো। ১৯২০ সালের ২৩ এপ্রিল আঙ্কারায় তুরস্কের জাতীয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে পর্যায়ক্রমে তুর্কি জাতীয় আন্দোলনের সদর দপ্তরে পরিণত হয়ে আসছিল। ওসমানীয় সাম্রাজ্যের পতনের পর তুরস্কের রাজধানী হিসেবে ইস্তাম্বুলের স্থলে আঙ্কারা হয়। ১৯২৩ সালে ২৯ অক্টোবর তুরস্কে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়। আঙ্কারা হয়ে উঠে নতুন রাজধানী।

এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক যে, প্রথম বিশ্ব যুদ্ধে অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর দেশের বৃহত্তর নিরাপত্তা চিন্তা করে দেশের অনেকটা মধ্যখানে আঙ্কারাকে রাজধানী হিসেবে বেছে নেয়া হয়। অবশ্য সেই সময় তথা ১৯২৭ সালে আঙ্কারার জনসংখ্যা ছিল লাখেরও কম। ২০১৩ সালে জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৫০ লাখ। শহরটি অনেকটা পরিকল্পিতভাবে নির্মিত হয়ে আসছে। আঙ্কারার অবস্থান ইস্তাম্বুল থেকে প্রায় ৪ শ কি.মি পূর্ব দিকে তথা বাংলাদেশের দিকে। কিন্তু ১ শত বছর আগে ইস্তাম্বুল থেকে আঙ্কারার রাজধানী স্থানান্তরিত হলেও ওসমানী সুলতানগণের প্রায় ৬ শত বছরের গৌরবোজ্জল ইস্তাম্বুলের ইতিহাস ও ঐতিহ্য হারিয়ে যায় নই। ফলে ইস্তাম্বুলে দেশী বিদেশী হাজার হাজার পর্যটকের সমাগম থাকে। যা আঙ্কারায় ততটা দেখা যাবে না। তুরস্ক সরকারের কাছে মনে হয় প্রশাসনিক কার্যক্রম বাদে আঙ্কারাকে গুরুত্ব দিতে চাচ্ছে না। যদিওবা ইস্তাম্বুল আঙ্কারার মধ্যে বিমান যোগাযোগের পাশাপাশি উন্নত মানের ট্রেন ও সড়ক যোগাযোগ রয়েছে। ঢাকার সাথে টার্কিস এয়ারের দৈনিক ফ্লাইট ইস্তাম্বুলের সাথে। কামাল আতাতুর্কের সমাধিসৌধ কমপ্লেক্সে কিছুক্ষণ সময় কাটানোর পর পর্যায়ক্রমে নিচে নেমে আসি। সমাধি কমপ্লেক্সের গাড়ি করে রিসিপশনের দিকে আসি। অতঃপর টেক্সী নিয়ে অন্যত্র চলে যাই।

লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্মৃতির শহর চট্টগ্রাম মিলনায়তনগুলো
পরবর্তী নিবন্ধলোহাগাড়ায় দিন দুপুরে বসতঘরের তালা ভেঙে চুরি