তুরস্ককে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের দেশ বলা হয়। যার নামে এই ওসমানীয় সাম্রাজ্য সেই ওসমান গাজী ইস্তাম্বুল থেকে প্রায় ১৬০ কি.মি দূরত্বে বুরসা নগরীতে শায়িত। আরও শায়িত তাঁর পরিবারবর্গ। সুলতান ২য় মুহাম্মদ ১৪৫৩ সালে ইস্তাম্বুল জয়ের পর এখানে রাজধানী স্থানান্তর করে বলে উল্লেখ রয়েছে।
আগে দু’বার তুরস্ক সফর করা হলেও বুরসা আসা হয়নি। লেখালেখি জগতে আছি, এতে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের দেশ তুরস্ক তথা ওসমানকে নিয়ে সাম্রাজ্য তা অনুধাবন করতে বুরসাতে ওসমান গাজীর যেয়ারতে যাওয়ার প্ল্যান করি। সাথে তার যোগ্য পুত্র ওরখানসহ পরবর্তী বংশধরের অনেকের যেয়ারত ত আছেই।
আনাতুলিয়ার ছোট একটি জায়গীর ছিল সুগোত। এর অধিপতি ছিলেন আততুগরীল। ১২৫৮ সালে আততুগরীলের এক পুত্র সন্তান জন্ম নিলে পরে তাঁর নাম রাখা হয় ওসমান। ১২৮৮ সালে আততুগরীল ইন্তেকাল পরবর্তী ওসমান পিতার সিংহাসনে বসেন। তাঁর নামানুসারে তুরস্ক সালতানাত অধিপতিদের ওসমানীয়া সালতানাত ও ওসমানীয়া খলিফা হিসেবে আখ্যায়িত হতে থাকে।
তিনি ইয়েনী শহর দখল করে তথায় সর্বপ্রথম ওসমানীয়া খেলাফতের রাজধানী স্থাপন করেন। এ সুলতান তাঁর রাজ্যের সীমানা দ্রুত সম্প্রসারিত করতে থাকেন। ৩৮ বছর ব্যাপী শাসনকার্য পরিচালনা করে ওসমানীয়া খেলাফতের ভিত দৃঢ়তর করেন।
১৩২৬ সালে ৭০ বছর বয়সে ইন্তেকাল করলে তাঁরই পুত্র ওরখান পিতার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। ওরখানও তারই পিতার মত দুনিয়া–বিমুখ ছিলেন। তাঁর আমলে ওসমানীয় সৈন্যগণ সর্বপ্রথম ইউরোপ ভূখন্ডে পা রাখেন। দীর্ঘ ৩৩ বছর শাসনকার্য পরিচালনা করে ১৩৫৯ সালে ৭৫ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন।
ওরখানের ইন্তেকাল পরবর্তী তারই পুত্র মুরাদ সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। তিনিও অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তিনি যেমনি খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা দিতে সজাগ ছিলেন, তেমনি দেশ জয়ে ছিলেন দৃঢ় সিদ্ধহস্ত। তিনি খ্রিস্টান বাহিনীকে পরাজিত করে মেসিডোনিয়া দখল করেন। সাথে দখল করেন রোমানীয়া। আরও দখল করেন আড্রেয়ানোপল।
১৩৭২ সালে তিনি বুলগেরিয়াও দখল করে নেন। ইউরোপীয় দেশসমূহের সাথে ওসমানীয় খলিফাগণের ছোট–বড় যুদ্ধবিগ্রহ সংঘটিত হতে থাকে। ১৩৮৯ সালে ৩০ বছর শাসনকার্য বীরদর্পে পরিচালনা করে মুরাদ (১ম) শত্রু বাহিনীর হাতে শাহাদাত বরণ করেন।
মুরাদের (১ম) শাহাদাতের পরবর্তী তাঁর পুত্র বায়েজিদ (১ম) মসনদে আরোহণ করেন। তিনিও দৃঢ়হস্তে তাদের উত্তরাধিকারীগণের সালতানাত যথারীতি পরিচালনা করেন। তবে তাঁর নৈতিক চরিত্র প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। তিনি প্রথম ইস্তাম্বুল (কনস্ট্যান্টিনোপল) অবরোধ করেন। কিন্তু অন্যত্র রণাঙ্গনের দিকে প্রয়োজন পড়ায় অবরোধ তুলে নিয়ে তথায় ঝুঁকে পড়েন।
১৪০২ সালে আংকারা প্রান্তরে তৈমুর বাহিনীর সাথে যুদ্ধে নির্লিপ্তাবস্থায় তিনি বন্দী হন। বন্দী অবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেন।
বায়েজিদ (১ম) বন্দী পরবর্তী ইন্তেকালের কারণে মসনদের অধিকার নিলে কলহের পর বায়েজিদ (১ম) এর পুত্র মোহাম্মদ (১ম) মসনদে আরোহণ করেন। তিনি অতি ধার্মিক ও শান্তিপ্রিয় ছিলেন। ৮ বছর শাসনকার্য পরিচালনা করে ১৪২১ সালে তিনি ইন্তেকাল করেন।
তাঁর মৃত্যুতে তারই পুত্র মুরাদ (২য়) মাত্র ১৮ বছর বয়সে মসনদে অধিষ্ঠিত হন। তিনি একজন সুশাসক ছিলেন। প্রজাগণের প্রতি শুভদৃষ্টি রাখতেন। তার আমলে সার্বিয়া, বসনিয়া, হারজেগোভিনা ওসমানিয়া খেলাফতের আওতাভুক্ত হয়। ১৪৫১ সালে ৬৮ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। তাঁর ইন্তেকালে দাসী–গর্ভজাত পুত্র মুহাম্মদ (২য়) মসনদে উপবিষ্ট হন।
মুহাম্মদ (২য়) অতি যোগ্য শাসক ছিলেন। তিনি বিশ্বের অন্যতম খ্যাতিমান প্রাচীন শহর ইস্তাম্বুল জয় করেন। তিনি সেখানে বহু মসজিদ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান–হাসপাতাল স্থাপন করেন।
৩৩০ সালে রোমান সম্রাট বসফরাস প্রণালীর উপকূলে গ্রীক বাইজেন্টিয়ামে তাঁর সাম্রাজ্যের নতুন রাজধানী স্থাপন করে এর নাম রাখেন নোভারোমা বা নয়ারোম। কালক্রমে এই শহরের নামকরণ হয় কনস্ট্যান্টিনোপল। মুহাম্মদ (২য়) ওসমানী খেলাফতের রাজধানী কনস্ট্যান্টিনোপল তথা আজকের ইস্তাম্বুলে স্থানান্তরিত করেন। তিনি নিকটস্থ বহু অঞ্চল জয়ে করতে সক্ষম হন।
মুহাম্মদ (২য়) এর নৈতিক চরিত্র ও আর্দশের কারণে পূর্ব ইউরোপের বহু ছোট ছোট অঞ্চল তুর্কি সালতানাতের অধীনে চলে আসে। মৃত্যুর পূর্ববর্তী সনে তিনি ইটালীর অংশবিশেষও জয় করতে সক্ষম হন। দীর্ঘ ৩০ বছর তিনি যোগ্যতার সাথে তুর্কি সালতানাত পরিচালনা করে ১৪৮১ সালে ইন্তেকাল করেন।
তুর্কি সুলতানগণের প্রায় ৭ শত বছরের শাসনকাল নিয়ে অনেক গ্রন্থ রচিত আছে। তুরস্ক থেকে ক্রয় করা ইংরেজি অনুবাদ গ্রন্থ আমার ঘরে ত আছেই। আমাদের দেশেও তুরস্ক সুলতানগণের শাসনকাল নিয়ে অনেকগ্রন্থ রচিত আছে যা পাওয়া সহজলভ্য।
এ বছর ৯ আগস্ট (২০২৩) সালে ৩য় বার তুরস্ক সফর করার সুযোগ হয়। ৯ আগস্ট ইস্তাম্বুল পৌঁছে ৫ দিন ইস্তাম্বুল অবস্থানের প্রোগ্রাম রাখি।
৫ দিনব্যাপী ইস্তাম্বুলে অবস্থানকাল ১২ আগস্ট শনিবার সারা দিনের জন্য ইস্তাম্বুল থেকে বুরসা গমন এবং ৫/৭ ঘণ্টা অবস্থানের প্রোগ্রাম রাখা আছে। আমার কনিষ্ঠ পুত্র ইঞ্জিনিয়ার ইশতিয়াক উদ্দিন চৌধুরী রিফাত, আলহাজ্ব এমদাদ উল্লাহ, এডভোকেট মুহাম্মদ ইলিয়াস, আলহাজ্ব নুরুল ইসলামসহ আমরা ৫ জন সকাল ৯ টার দিকে ইস্তাম্বুলের ইউরোপীয় অংশে অবস্থান করা হোটেল থেকে বুরসার উদ্দেশ্যে রওনা দিই।
আগের দিন ৩২৫ ডলার দিয়ে একটি মাইক্রো টাইপের গাড়ি রিজার্ভ করি সারাদিনের জন্য। আমরা ইস্তাম্বুলের ইউরোপীয় অংশ থেকে বসফরাস প্রণালীতে ১৯৮৮ সালে নির্মিত ফতেহ সুলতান বিশ্বখ্যাত ঝুলন্ত ব্রীজ দিয়ে ইস্তাম্বুলের এশিয়া অংশে আসি। অতঃপর ইস্তাম্বুলের এশীয় অংশ অবলোকন করতে করতে মহানগর পেরিয়ে গ্রামাঞ্চলে এসে যাই।
প্রকৃতই তুরস্ক দেখার মত সুন্দর পরিচ্ছন্ন দেশ। ইউরোপের উন্নত দেশগুলো থেকে কোন অংশে পিছিয়ে বলা যাবে না। রাস্তার বামে ডানে দু’দিকে সুন্দর পরিপাটি পরিচ্ছন্ন। তুরস্ক পাহাড়–পর্বতে অনাবাদীর সংখ্যা ব্যাপক নয়। সমস্ত তুরস্কের মাটিতে মানবকল্যাণে কোন কোন ফসল উৎপন্ন হয়।
ডিভাইডেড হাইওয়ে, কোন জায়গায় ৪ লেইন, কোন জায়গায় ৬ লেইন। পাহাড়–পর্বতের দেশ বিধায় রাস্তা আঁকাবাঁকা। ইস্তাম্বুল থেকে বুরসার দূরত্ব প্রায় ১৬০ কি.মি অনেকটা চট্টগ্রাম–কক্সবাজারের দূরত্বের মত।
আমরা গাড়ি ঠিক করার সময় বলা ছিল ড্রাইভার কাম গাইড যাতে হয়। বস্তুত মধ্য বয়সের ড্রাইভারটি ঝানু। আমরা প্রায় ৩ ঘণ্টার ব্যবধানে বুরসা শহরে প্রবেশ করে ওসমান গাজীর যেয়ারতে চলে যাই। একটি পাহাড়ের উপর কয়েক একর এরিয়া নিয়ে ৩০/৪০ মিটারের ব্যবধানে ওসমান গাজী ও তাঁর মহান পুত্র ওরখান এর সমাধি। বিশাল একেক গম্বুজের সমাধি। এখানেই উভয়েই এর কবরের আশেপাশে ৮/১০ টি কবর যা তাদের পরিবারবর্গের।
এই পাহাড় বুরসা শহর থেকে অনেক উপরে বড় বড় গাছ আচ্ছাদিত। পাহাড়ে শত শত নারী পুরুষ পর্যটকের আনাগোনা; রয়েছে রেস্টুরেন্ট, দোকানপাট। এখানে যেয়ারতে কিছুক্ষণ সময় দিই এবং হেঁটে হেঁটে যতটুকু সম্ভব অবলোকন করি।
অতঃপর এখান থেকে প্রায় ৪/৫ শ’ মিটার দূরত্বে কিছুটা নিচে কেন্দ্রীয় মসজিদে যাই যোহরের জামাত পড়তে। এই মসজিদে যোহরের জামাতেও সমাগম ব্যাপক।
মসজিদের নিকটে রয়েছে বুরসার গ্রান্ড বাজার। যা দেখার মত। একতলা বিশিষ্ট বিশাল মার্কেট। শতের অধিক দোকান। তুরস্কের দ্রব্য সামগ্রী বলতে মান সম্পন্ন, দামী, যা বিশ্বখ্যাত। আমরা এখানে এক রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার খাই। তুরস্কের কাবাব বিশ্বে প্রসিদ্ধ। অধিকাংশ তুর্কি ঝোলবিহীন, মসল্লা কম দিয়ে রান্না করে খায়। যদিওবা তুরস্ক মসল্লা উৎপাদনের জন্য প্রসিদ্ধ। তারা মসল্লা কম দিয়ে আগুনে সেকে খায়। যা হজমী, রুচিশীল, শরীরের জন্য উপকারী। তুরস্কের দুধের লাবান, মাঠা খুব প্রসিদ্ধ। তারা আইরান বলে। ইহা মিশরেও প্রসিদ্ধ। এখান থেকে আমরা বুরসার আরেক গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি এরিয়ায় যাই। বুরসায় প্রসিদ্ধ ক্যাবলকার রয়েছে জানা ছিল। তা যে বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ ক্যাবলকার তা, তথায় গিয়ে বুঝতে পারি। এখানে আমরা আছরের নামাজ পড়ে ক্যাবলকারের দিকে চলে যাই। সারাদিন বুরসায় কাটিয়ে ইস্তাম্বুল ফিরতে রাত হয়ে যায়।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট