প্রবাহ

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ at ৮:০২ পূর্বাহ্ণ

অন্য ধর্মাবলম্বীর প্রতি নবী পাক (.)’র মমত্ববোধ

নবী পাক (.) নবুয়ত জিন্দেগীর প্রথম ১৩ বছর জন্মস্থান পবিত্র মক্কায় চরম প্রতিকূল অবস্থায় কাটিয়েছেন। এমনি প্রতিকূল পরিস্থিতিতে মানবিকতায় মরিয়া হয়ে চেষ্টা করেন সকলের সাথে সহমর্মিতা প্রদর্শন করতে।

পবিত্র মক্কায় জন্ম থেকে বয়স বাড়ার সাথে সাথে অতি উন্নত চরিত্র সকলকে মোহিত করে। অতঃপর পর্যায়ক্রমে সকলের মাঝে আল আমিন হিসেবে ভূষিত হতে থাকেন। ৪০ বছর বয়সে পৌছার পর জবলে নূর তথা গারে হেরায় তাঁর মাধ্যমে পবিত্র কুরআন নাযিল শুরু হয়। অতঃপর পর্যায়ক্রমে আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে নির্দেশিত হয়ে তাঁর একত্ববাদ প্রচার শুরু করার সাথে সাথে বাঘা বাঘা স্বগোত্রীয় কোরাইশ নেতারা চরম বিরোধিতা শুরু করেন। তারপরও বিধর্মীদের সাথে তাঁর সহমর্মিতা মমত্ববোধ প্রকাশ অব্যাহত রাখতে কুন্ঠিত হননি। পবিত্র মক্কী যিন্দেগীর শেষের দিকে এসে নব দীক্ষিত দুর্বল মুসলমানের কল্যাণ চিন্তা করে আবিসিনিয়ায় হিজরত করান। বাকিদের পর্যায়ক্রমে পবিত্র মদিনায় হিজরত করাচ্ছিলেন।

পবিত্র মদিনার শীর্ষ দুই বংশ আউস এবং খাযরাজ হজের সময় পবিত্র মক্কায় এসে ইসলাম গ্রহণ করেন। পরে পবিত্র মক্কায় ইসলাম গ্রহণ করা স্বল্পসংখ্যক মুসলমান পবিত্র মদিনায় গমন করলে নেতা ও সাধারণ মদিনাবাসীর কাছে তারা সম্মানের সাথে সাদর অভ্যর্থনা লাভ করেন।

নবুয়ত জিন্দেগীর ১৩ সনে এসে জন্মস্থান পবিত্র মক্কায় জীবন বিপন্ন অনুধাবন করে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশিত হয়ে পবিত্র মদিনায় হিজরত করেন। যা অতীব ঝুঁকিপূর্ণ লোমহর্ষক হিজরত বলা যায়। পবিত্র মদিনায় নেতাসর্দার তথা সকলেই আল্লাহর রসুল (.) কে সাদরে বরণ করে নেন। সকলে নবী পাক (.)’র কাছে নেতৃত্ব ছেড়ে দিতে কুন্ঠিত হননি। তারপরও নবী পাক (.) তাদের স্বস্ব সম্মান রক্ষা করতে সচেষ্ট ছিলেন।

পবিত্র মদিনায় বিধর্মী তথা ইহুদীদেরও বসবাস ছিল। নবী পাক (.) তাদেরকে সম্মান দিতে তাদের অধিকার রক্ষা করতে তাদের সাথে সহাবস্থানে থাকতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যান। যদিওবা নবী পাক (.) বারে বারে ব্যর্থ হচ্ছিলেন। কিন্তু পবিত্র মদিনায় দিনে দিনে ইসলামের জয় জয়কার অবস্থা ইহুদীদের কাছে অসহনীয় হয়ে উঠে। এতে তারা নানা কূটকৌশল, দূরভিসন্ধিতে মেতে থাকে। তারপরও আল্লাহর রসুল (.) সর্বোচ্চ সংযমের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থানে থাকতে কুন্ঠিত হন নি।

মসজিদে নববী নির্মাণের পর এক বিধর্মী মসজিদে নববীর ভিতর প্রস্রাব করছিলেন। মুসলমানগণ তাকে ধমক দিয়ে বকাবকি করতে লাগল। অনেকে তাকে মারতে উদ্যত হল। কিন্তু নবী পাক (.) বললেন “ওর প্রস্রাব আটকে দিয়োনা, ওকে ছেড়ে দাও”। সুতরাং তাকে ছেড়ে দেওয়া হল। সে প্রস্রাব শেষ করল। অতঃপর নবী পাক (.) তাকে ডেকে নম্রতার সাথে শান্তভাবে বললেন“এই মসজিদগুলো কোন প্রকার পেশাব বা নোংরা জিনিসের জন্য নয়। এ হল কেবল আল্লাহ তায়ালার যিকর, নামাজ ও কুরআন পড়ার জন্য।

পবিত্র মদিনায় নবী পাক (.)’র হিজরতের পর বদর প্রান্তরে কোরাইশদের নেতৃত্বে তাদের বিশাল বাহিনীর সাথে মাত্র তিনশত তের জন মুসলমানকে নিয়ে নবী পাক (.) কে যুদ্ধ করতে হয়েছিল। এতে মহান আল্লাহ পাক সরাসরি ফেরেস্তা পাঠিয়ে সহায়তা করেন। আবু জেহেল সহ শীর্ষ স্থানীয় ৭০ জন এ যুদ্ধে নিহত হয় এবং প্রায় ৭০ জন বন্দী হয়। এতে পবিত্র মক্কায় সকলের মাঝে শোকের ছায়া নেমে আসে।

এক নর্তকী মানুষকে নাচ গান পরিবেশন করে টাকা উপার্জন করত। তার উপার্জন বন্ধ হয়ে যায়। পড়ে যায় সে অভাবে। নর্তকীর মনে সাড়া জাগে সে বিধর্মী নর্তকী হলেও রহমতুল্লিল আলামিন নবী পাক (.) তাকে সাহায্য করতে কুন্ঠিত হবেন না। ফলে সে পবিত্র মদিনায় চলে আসে। মহান সাহাবাগণ পবিত্র মদিনায় এ কুখ্যাত নর্তকীকে দেখে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠেন। নবী পাক (.) সবাইকে থামিয়ে দিয়ে নর্তকীর কথা শুনেন। তাকে যথেষ্ট আর্থিক সহায়তা দিয়ে বিদায় দেন।

হুদায়বিয়ার সন্ধির পর জাযিরাতুল আরবে ইসলামের জয় জয়কার অবস্থা পরিলক্ষিত হচ্ছিল। ইয়েমেন, হুনাইন, তায়েফ, হাইল, আবাহা সহ অনেক গোত্র প্রধান ছোট ছোট রাজা বাদশাহরা মরিয়া হয়ে আবু সুফিয়ানকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছিল নবী পাক (.) যাতে (পবিত্র) মক্কা বিজয় করতে না পারেন।

অষ্টম হিজরীতে প্রায় দশ হাজার সাহাবাকে নিয়ে ছোট খাটো সংঘাত বাদে শান্তিপূর্ণ ভাবে পবিত্র মক্কা বিজয় করেন।

খ্রিষ্টান দাতা হাতেম তাঈ ছিলেন ইয়েমেনের ছোট খাটো বাদশাহ। এক বর্ণনায় হাতেম তাঈ হাইলের বাদশাহ বলে উল্লেখ শুনা যাচ্ছে। তিনি ইয়েমেনের বাদশাহ। অল্লাহর রসুল (.) নবুয়ত প্রাপ্তির আগেই তার ইন্তেকাল হয়। পুত্র আদি ইবনে হাতেম পিতার স্থলাভিষিক্ত হন। তিনি নিশ্চিত মুসলিম বাহিনী ইয়েমেন জয় করে নিবেন। সে মতে আদি ইবনে হাতেম প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন মুসলিম বাহিনীর আগমন দেখলে পরিবারবর্গ নিয়ে পূর্বপুরুষের আবাসস্থল সিরিয়ায় পালিয়ে যাবেন। বাস্তবেও তাই হল। হযরত আলী (.)’র নেতৃত্বে দূর থেকে মুসলিম বাহিনীর আগমন দেখে আদি পরিবারবর্গ নিয়ে দ্রুত পালিয়ে যাওয়ার সময় ভুলক্রমে সৎ বোনকে নেয়া হয়নি। হযরত আলী (.) তাকে বন্দি করে পবিত্র মদিনায় পাঠিয়ে দেন। আল্লাহর রসুল (.) বন্দি অবস্থায় বিধর্মী বাদশাহর কন্যাকে সম্মান দেখান। যথেষ্ট হাদিয়া তোহফা দিয়ে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে সিরিয়ায় পাঠিয়ে দেন।

সৎ ভাই আদি বোন থেকে পবিত্র মদিনার পরিবেশ জানতে চাইলে ভাইকে পরামর্শ দেন, সে যাতে পবিত্র মদিনায় এসে নবী পাক (.)’র সাথে সাক্ষাৎ করে। পবিত্র মক্কা বিজয়ের পর নবী পাক (.)’র ব্যস্ততা আগের চেয়ে বেড়ে যায়। দূর দূরান্ত থেকে অসংখ্য বিধর্মীরা তাকে দেখতে, বুঝতে পবিত্র মদিনায় আসছিলেন। তেমনি আদিও এসে বহু সাহাবা বেষ্টিত নবী পাক (.) কে নিজের পরিচয় দেন আদি ইবনে হাতেম বলে। নবী পাক (.) তাঁর সম্মানে দাড়িয়ে যান। তাকে সাথে নিয়ে পার্শবর্তী হুজরা খানায় গমন করছিলেন, এমনি অবস্থায় এক মহিলা সাহাবা আল্লাহর রসুল (.)’র সাথে দেখা করতে এসে নিজের সমস্যার কথা বলতে লাগলেন। আল্লাহর রসুল (.) আদি ইবনে হাতেম তাঈকে দাড়িয়ে রেখে মহিলা সাহাবীর কথা শুনছিলেন এবং সন্তুষ্ট করতে যথাযথ উত্তর দিচ্ছিলেন। এ দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে আদি অভিভূত হন। অতঃপর কক্ষে নিয়ে গিয়ে বসতে দিলেন নিজের শোবার স্থান খেজুর পাতার তোষকে। আদি বিব্রতবোধ করছিলেন। নবী পাক (.) উত্তরে বলেন তিনি অতিথি। তাকে সম্মান করা দায়িত্ব। কদিনের ব্যবধানে আদি মুসলিম হয়ে যান। বস্তুত আমরা আল্লাহর রসুল (.)’র উম্মত। আমাদের দায়িত্ব হল তাঁর অনুকরণ অনুসরণ করা। অতএব আমাদের কর্তব্য হবে যে কোন অন্য ধর্মাবলম্বীদেরকে সম্মান করা। সাথে সাথে অতিথিকে মূল্যায়ন করা। লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধমুকুট মণি জননেত্রী শেখ হাসিনা
পরবর্তী নিবন্ধহাটহাজারীর নাঙ্গলমোড়া হালদায় ব্রিজ নির্মাণের দাবি ৩২ আইনজীবীর