চট্টগ্রাম শহরের মহান অলী হযরত
হাফেজ সৈয়দ মুনির উদ্দীন (রহ.)
চট্টগ্রাম শহরের হালিশহরে শায়িত আছেন মহান অলী, সূফী, দরবেশ, সুলতানুল আউলিয়া হযরত আলহাজ্ব শাহ হাফেজ সৈয়দ মুনির উদ্দীন নুরুল্লাহ (রহ.)। তিনি হালিশহর হাফেজ ছাহেব হিসেবে সর্বমহলে প্রসিদ্ধ। ৬ রবিউল আউয়াল তাঁর ৬৯ তম ইন্তেকাল বার্ষিকী।
তিনি আজমগড়ী হযরতের খলিফাগণের মধ্যে অন্যতম। তাঁর পূর্বপুরুষ পবিত্র আরবভূমি থেকে বাগদাদে আসেন। এখান থেকে আসা হয় বাংলার প্রাচীন রাজধানী গৌড়ে। এ গৌড় ও পান্ডুয়া কেন্দ্রিক ইসলামের নানান ইতিহাস সংশ্লিষ্ট রয়েছে। আজও গৌড় পান্ডুয়ায় ইসলামের নানা স্মৃতি ও স্থাপত্য নিদর্শন বর্তমান রয়েছে। এ গৌড়েই আরব থেকে অনেক ধর্মপ্রচারক এসেছেন। হযরত হাফেজ ছাহেব হুজুরের পূর্বপুরুষও আসেন বাগদাদ গৌড় হয়ে চট্টগ্রামে।
তিনি ১৮৮১ সালের দিকে হালিশহরে জন্মগ্রহণ করেন বলে জানা যায়। হযরত হাফেজ ছাহেব হুজুর শিশুকাল থেকে খুবই পরহেজগার ও মেধাবী ছিলেন। কদমমুবারক এসে ধর্মীয়শিক্ষা গ্রহণ করেন। আগেকার আমলে পায়ে হেঁটে দূরদূরান্তে যাওয়া আসা অনেকটা সাধারণ ব্যাপার ছিল। বিশ্বখ্যাত সূফি, দরবেশ, তাসাউফ জগতের খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব হযরত আলহাজ্ব শাহ মাওলানা হাফেজ হামেদ হাসান আলভী (রহ.) (আজমগড়ী হযরত) তরিকতের সফরে চট্টগ্রাম তশরীফ আনলে হালিশহর হাফেজ (রহ.)’র বাড়িতে তশরীফ রাখতেন।
আজমগড়ী হযরত বৎসরে ন্যূনতম ৩ মাস বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে তাবলীগে তরিকতের সফর করে গেছেন; তৎমধ্যে চট্টগ্রাম অঞ্চল অন্যতম। ১৯০১ সাল থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৩৮ বছর চট্টগ্রাম অঞ্চলে বাৎসরিক ন্যূনতম একবার হলেও সফর করতেন অনেক কষ্ট স্বীকার করে। কারণ সেই সময় মানুষের বাড়ীতে কাছারী ঘর, বাড়ী সংলগ্ন টয়লেট এসব কিছুর ব্যবস্থা ছিল না। আরামের ব্যবস্থা ছিল না বললেই চলে। সেই সময় আজমগড়ী হযরত হালিশহর হাফেজ ছাহেব হুজুরের বাড়ীতে তাশরীফ রাখতেন। চট্টগ্রাম মহানগরীর চন্দনপুরা, বাঁশখালীর ছনুয়া, সাতকানিয়া ডলুনদী গারাংগিয়া হয়ে চুনতী ইউসুফ মঞ্জিলে (হযরত শাহ সাহেব কেবলার দাদার বাড়ী) তাশরীফ রাখতেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, চট্টগ্রাম অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ, উপমহাদেশ বিভাগ ইত্যাদি কারণে আজমগড়ী হযরতের চট্টগ্রাম অঞ্চলে সফর হয় নাই। অতঃপর হাফেজ ছাহেব হুজুরের ইন্তেকালের পর ১৯৫৫ সালে সপ্তাহখানেকের জন্য চট্টগ্রাম সফর করেছেন। রেলে চট্টগ্রাম আগমন করেন। গাড়ি যোগে হাফেজ ছাহেব হুজুরের বাড়ীতে তাশরীফ রাখেন। ঐ সময় ঐ বাড়ী লোকে লোকারণ্য থাকত। যা আজমগড়ী হযরতের কাছে অপছন্দনীয় ছিল। তিনি বলতেন তরিকতের কাজ চুপি চুপি।
হালিশহরে ২/৩ দিন অবস্থান করে তথা হতে কর্ণফুলী নদী হয়ে কাপ্তাই গমন করে রাতে অবস্থান করেন। কাপ্তাই বাঁধ টিকতে ছিলনা বিধায় ঠিকাদারের আগ্রহে অবস্থান করেন তথায়। বাঁধে গমন করেন, তথায় হাটেন। পরদিন কর্ণফুলী নদী পথে চট্টগ্রাম এসে চন্দনপুরা জমিদার এয়ার আলী খানের বাসভবনে অবস্থান নেন। এই সময় চট্টগ্রাম অঞ্চলের আরও কয়েকজন বুজুর্গ মুরিদকে লিখিতভাবে খেলাফত দানে ভূষিত করেন। তৎমধ্যে গারাংগিয়া হযরত ছোট হুজুর কেবলা অন্যতম।
এখান থেকে বিমানযোগে ঢাকা হয়ে ভারতে গমন করেন। ৪ বছরের ব্যবধানে ১৯৫৯ সালে মেয়ের শ্বশুর বাড়ী গোন্ডায় আজমগড়ী হযরত ইন্তেকাল করলে তথায় শায়িত করা হয়।
হাফেজ ছাহেব হুজুরের রেয়াজত একালে ভাববার বিষয়। তিনি আল্লাহ পাকের ধ্যানে নিজেকে উৎসর্গ করেন। দৈনন্দিন ঘন্টার পর ঘন্টা মুরাকাবায় কাটান। সপ্তাহে একাধিকবার রাতের নামাজে পবিত্র কুরআন খতম দিতেন। মুরাকাবায় অনেকক্ষণ বসে থাকতেন বলে পা ফুলে যেত। তারপরও তিনি উঠতেন না। মাফলার দিয়ে গলা শক্ত করে বেঁধে তিনি মুরাকাবা চালু রাখতেন। তিনি স্বাস্থ্যকে এভাবে অবিরত আল্লাহ পাকের উদ্দেশ্যে মুরাকাবায় নিজেকে উৎসর্গীত করেন।
হালিশহর গ্রাম অঞ্চল তখন, চট্টগ্রাম শহরের বাইরে। বাংলাদেশ আমলের শুরুর দিকেও বন্দরটিলা হয়ে কাঁচা রাস্তা দিয়ে হযরত হাফেজ ছাহেব হুজুরের বাড়িতে আসতে হত। সেসময় প্রতিকূল যোগাযোগেও তাঁর বাড়িতে মুরিদগণের পাশাপাশি দোয়াপ্রার্থীর সংখ্যাও বাড়তে থাকে।
আমারও যখন প্রথম দিকে হাফেজ ছাহেব হুজুরের যেয়ারতে যাওয়া হয় তখনও সল্টগোলা ইচুনিয়া হাট হয়ে কাঁচা রাস্তা দিয়ে হালিশহর যাওয়া আসা হত।
১৯৮০র দশকের শরুতে বাকলিয়া চট্টগ্রাম পৌরসভার অন্তর্ভুক্ত হয়। হালিশহর, কাট্টলী, মোহরা পৌরসভার অন্তর্ভুক্ত হয় সম্ভবত আরও পরে। যতটুকু মনে পরে ১৯৬০র দশকের শেষের দিকে সল্টগোলা পৌঁছে সেখান থেকে কাঁচা অনেকটা সরু রাস্তায় আমার হালিশহরে হযরত হাফেজ ছাহেব (রহ.)’র যেয়ারতে আসা হত। ঐ সময় তাঁর সুযোগ্য পুত্র ও পীর ছাহেব হযরত আলহাজ্ব শাহ মাওলানা কাজী সিরাজুল মোস্তফা (রহ.)’র সাথে মোলাকাত হত। তাঁর ইন্তেকালে আমার জানাযা পড়ার সুযোগ হয়। পরবর্তীতে হাফেজ ছাহেব হুজুরের ২য় ও কনিষ্ঠ ছাহেবজাদা আলহাজ্ব সাবের আহমদ (রহ.)’র সাথে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠে। তিনি মাজারের সামনে তবলীগ মঞ্জিলের বারান্দায় প্রায়ই চেয়ার নিয়ে বসে থাকতেন। আমাকে তাঁর দালানের ২য় তলার বৈঠকখানায় নিয়ে যেতে ভুল করতেননা। কয়েক প্রকারের নাস্তা দিয়ে রাজসিক আতিথেয়তা করা হত। মোবাইলের তখন এত প্রচলন ছিলনা। দূর থেকে আমাকে দেখলেই সালাম বিনিময়ের পর তাঁর বলতে ভুল হতনা “অনে এতিক্কিন হতা হডে ফন” অর্থাৎ আপনি এত তথ্য কোথায় পান। তিনি নিয়মিত সংবাদপত্রে আমার প্রবন্ধ পড়তেন।
হালিশহর হযরত হাফেজ ছাহেব হুজুর দূরদূরান্ত হতে আগত মুরিদান ও সাধারণ লোকজনের অবস্থানের নিমিত্তে ১৯৪৫ সালে তবলিগ মঞ্জিল বা মুসাফিরখানা নির্মাণ করেন। ১৯৪৭ সালে হজ্বে গমন করেন। এসময় উপমহাদেশ বিভাগ নিয়ে ভারতবর্ষে বিভিন্ন স্থান উত্তপ্ত অবস্থা ছিল। এমন প্রতিকূল পরিবেশেও হজ্বের সফরকে অতীব গুরুত্ব দিয়ে বেরিয়ে পড়েন। চট্টগ্রাম–কলকাতা থেকে ট্রেনে মোম্বাই পৌঁছেন। তথা হতে সাগর পথে হজ্বের উদ্দেশ্যে গমন করেন। বাংলার প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন তাঁর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন।
হযরত হাফেজ ছাহেব হুজুর তরিকতের সফরকে গুরুত্ব দিতেন। চট্টগ্রাম কক্সবাজার সহ এতদঅঞ্চলে সফর করতেন। ঐ সময় বড় বড় আলেম, হাফেজ তাঁর সফরসঙ্গী হতেন। তাঁর তরিকত মাহফিলে বহু লোকের সমাগম হত। পাপী তাপী নিজেদের অপকর্ম ত্যাগ করে খাঁটি দিলে তওবা করে তরিকতে দাখিল হতেন এমন সংখ্যাও কম নয়।
হযরত হাফেজ ছাহেব হুজুরের জীবনযাত্রা ছিল অতীব সাদামাটা। কিন্তু তাঁর কাছে আগতদের কিছু না কিছু খাবার দিতে সচেষ্ট থাকতেন। তিনি মুরিদগণকে উপদেশ দিতেন অল্পতেই তুষ্ট থাকায় সুখ, কোন রকমে খেয়ে আল্লাহকে স্মরণ করতে পারলেই যথেষ্ট। কারো কাছে সাহায্যের জন্য হাত বাড়াবেনা। বরং তোমার তরফ থেকে সাহায্যের হাত প্রসারিত কর। তিনি বলতেন, ক্যানভাস (স্ব–উদ্যেগে প্রচার) করে লোকজনকে তরিকায় এখতিয়ার করালে চার ছয় মাস তরিকার কাজ করবে তারপর ছেড়ে দিবে। যাদের তরিকা করার খাছ খাছ রুহ আছে তারাই এ তরিকা করবে।
হযরত হাফেজ ছাহেব হুজুর কথা বলতেন খুব কম। কিন্তু তিনি যা বলতেন তা ছিল শিক্ষণীয়। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলতেন: দিন যতই যাচ্ছে খারাপ যাচ্ছে, ভালোর মুখ দেখবেনা। ঈমানদারের কথায় কেউ কর্ণপাত করবেনা। যার ফলে তাঁরা ঘরের কোণে বসে থাকবে। তিনি অনেক সময় বলতেন: ইবাদত নামমাত্র থাকবে, তাঁর খালেছ আমল থাকবেনা। তিনি বিলাসিতা তথা বিলাসী জীবনযাপন খুবই অপছন্দ করতেন। মহিলাগণের পর্দার ব্যাপারে ছিলেন খুবই কঠোর। ন্যূনতম বেপর্দা সহ্য করতেননা।
হযরত হাফেজ ছাহেব বলেন: তরিকা গ্রহণ করে যদি অজিফা পড়া ছেড়ে দেয়, সে ঈমান নিয়ে মরিতে পারিবেনা। কেননা উপরস্তু সকল ইমামগণের সাথে বেইমানি করছে।
বস্তুত ১৯৬০ এর দশকে ছাত্রজীবনে গারাংগিয়া হযরত বড় হুজুর কেবলার নিকট মুরিদ হবার সৌভাগ্য হয়। সেই হতে গারাংগিয়া সিলসিলার পাশাপাশি আজমগড়ী সিলসিলার উপর জ্ঞান অর্জন করতে আগ্রহ জাগে। ফলে ১৯৬০ এর দশক থেকে মাঝেমধ্যে যেয়ারতের উদ্দেশ্যে হালিশহর যাওয়া আসা হয়ে আসছে।
এক্ষেত্রে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক যে, গারাংগিয়া হযরত বড় হুজুর কেবলা, পরবর্তীতে হযরত ছোট হুজুর কেবলা তাদের মুরিদগণকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাননি। তরিকত জগতে তাঁর মুরিদগণ বিচরণ করুক এ মনোবৃত্তি ছিল। আজ অনেক তরিকতের পীরকে দেখা যায় মুরিদগণকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে। মুরিদ নিজ পীর থেকে চলে যায় নাকি।
এ মহান অলি, সূফি, দরবেশ, সুলতানুল আউলিয়া হযরত শাহ হাফেজ মুনিরুদ্দিন (রহ.) ৬ রবিউল আউয়াল তথা ৩ নভেম্বর ১৯৫৪ সালে ইন্তেকাল করেন। ৬৯ তম ওফাত বার্ষিকীতে পরকালে মহান আল্লাহ পাক তাকে জান্নাতুল ফেরদাউস নসীব করুন (আমীন)।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট