প্রবাহ

ঢাকা বনানী কবরস্থানে ব্যতিক্রম অভিজ্ঞতা

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ১৯ জুলাই, ২০২৩ at ৬:১৫ পূর্বাহ্ণ

গত ৪ জুলাই মঙ্গলবার সকাল ১০ টায় ঢাকা বনানী কবরস্থানে প্রবেশ করা হয় যেয়ারতের উদ্দেশ্যে। এখানে যেয়ারত করতে এসে ব্যতিক্রমধর্মী অভিজ্ঞতা লাভ করি। ঢাকা মহানগরের বুকে প্রসিদ্ধ কয়েকটি কবরস্থানের মধ্যে বনানী কবরস্থান অন্যতম একটি। যেহেতু এখানে বঙ্গবন্ধুর পরিবারবর্গসহ অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিত্বগণ শায়িত আছেন। তৎমধ্যে সাবেক রাষ্ট্রপতি, বিচারপতি শিল্পপতি সহ অনেকে রয়েছেন। সাথে মহান আল্লাহ পাকের অলী সূফি দরবেশগণ ত থাকবেই।

যেমন রোদ তেমন প্রচণ্ড গরম, এর মধ্যে ঐ দিন যেয়ারতে প্রবেশ করে ২ জন খাদেমের দেখা মেলে। চট্টগ্রামের বাসিন্দা বয়স্ক লোক হয়ত তাঁরা আমার আবদারে না করতে পারেননি। ফলে আমার সহযোগিতায় সাথে থাকেন। তাদেরকে নিয়ে সামনে এগুতে থাকলে নতুন বিষয় আমার দৃষ্টিগোচর হল। আর তা হল: বিভিন্ন কবরে দুইটি তিনটি নেমপ্লেট রয়েছে যা এক কবরের ভিতর আরও দুইটি তিনটি কবর আছে বোঝায়। তথায় যা আমার প্রথম বাস্তব অভিজ্ঞতা। তখন খাদেমগণ বলল: ঢাকা সিটি কর্পোরেশন এলাকায় এই সিস্টেমটা অনেক আগে থেকে চালু হয়ে গেছে। আগেকার কবরের মধ্যে নিকটজনের কার কবর দেয়া যাবে তার একটা নীতিমালা করা আছে। সিটি কর্পোরেশনে নির্ধারিত ফি দিয়ে অনুমতি সাপেক্ষে এভাবে কবরের ভিতর কবর দেয়া যাবে।

তাদেরকে প্রশ্ন করলাম: অনেকের ত লাশ অক্ষত থেকে যায়, তখন কি করা হয়? তখন উভয়ে বলল: এ কবরস্থানের উত্তর পাশে এক কবরে অন্যজনকে কবর দিতে গিয়ে এমন ঘটনা ঘটেছে। অর্থাৎ অক্ষত লাশ পাওয়া গিয়েছে। তখন উভয়কে নিয়ে প্রচণ্ড রোদের ভিতর ঐ দিকে গেলাম, দেখলাম লোহার গ্রীল দিয়ে মজবুত ভাবে ঘেরাও দেয়া আছে। ঐ গ্রীলের সাথে ঢাকায় বসবাসকারী একজন আবেগপ্রবণ ব্যক্তি একটি লেখা টিনের উপর লিখে লাগিয়ে দেন। কথাটি হল:

নাম নেই, নম্বর নেই, কে তুমি শুয়ে আছ এ কবরে?

শুনেছি ১৯৮৬ সনে, এখানে বহু পুরানো কবর সংরক্ষণে বেরিয়ে আসে তোমার অক্ষত মরদেহ।

তুমি যে একজন বুজর্গ তাহাতে থাকেনা সন্দেহ।

তাই এখানেই তোমাকে পুনঃ সমাহিত করা হয় সাদরে।

আজ এ গুনাহগার বান্দা সালাম জানাই সশ্রদ্ধে।

এখানের কবর বাসীদের নিয়ে বিচরণ কর রূহানী জগতে।

জিয়ারত কারীদের জন্য দোয়া কর আল্লাহর দরবারে”।

এখানে যেয়ারতের উদ্দেশ্যে একাধিক দিকে যাওয়া হয়। ঢাকা কয়েকটি কবরস্থানের মধ্যে আজিমপুর কবরস্থানও অন্যতম। এখানেও অনেক প্রখ্যাত বিখ্যাত ব্যক্তিগণ শায়িত রয়েছেন। সাথে শায়িত আছেন মহান সূফী অলী দরবেশ।

হজ, ওমরা ও যেয়ারতের উদ্দেশ্যে সৌদি আরবে গমন করলে পবিত্র মক্কায় জান্নাতুল মোআল্লা এবং পবিত্র মদিনায় জান্নাতুল বাকী এই দুই পবিত্র কবরস্থানে এক বা একাধিকবার যেয়ারত করতে ভুল হবার নয়। পবিত্র মক্কায় জান্নাতুল মোআল্লায় যারা লাশ দাফন করে অধিকাংশ বাংলাদেশী সিলেটি। আলাপে তারা বলেন এখানে এত বেশি লাশ দাফন করা হয় যে কয়েকবছর অন্তর অন্তর পুনঃ লাশ দাফন করতে হয়। কবর খুড়লে অনেকের কঙ্কাল পাওয়া যায়। হাড়গুলো ভঙ্গুর একদম পাউডারের মত। কবরের এক কোনায় গর্ত করে সেখানে রেখে দিয়ে পুনঃ লাশ দাফন করা হয়।

মাত্র ৫৫ হাজার বর্গমাইলের আমাদের দেশ। জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি, তৎমধ্যে মুসলমান প্রায় ১৫ কোটি। অতএব আমাদের দেশে গ্রামাঞ্চলে না হলেও বড় বড় শহরগুলিতে এইভাবে কবরের ভিতর কবর না দিয়ে উপায় নেই। ইসলাম ধর্ম মতে এই নিয়মের উপর নানান বর্ণনা রয়েছে। যারা ৩০/৪০ বছর আগে ইন্তেকাল করে গেছেন, তারা আমাদের দেশের এই সিস্টেমটা না জেনে চলে গেলেন। আমরা বৃদ্ধ বয়সে দেখছি। আমাদের দেশের শহরে জানা বাস্তব অবস্থায়ও এক কবরের ভিতর একাধিক কবর দেয়া হচ্ছে। জানিনা ভবিষ্যতে আগামী প্রজন্মে এক কবরে কত জনকে কবর দেয়া হচ্ছে তা দেখতে পাবো কিনা।

চট্টগ্রাম শহরে স্টেশন রোডে চৈতন্য গলি নামক বিশাল কবরস্থানে প্রতিনিয়ত অসংখ্য মুসলিম নরনারীকে কবর দেয়া হচ্ছে। এক কবরের উপর কত জনের যে কবর দেয়া হচ্ছে তা হিসাব থাকার কথা নয়। মিসকিন শাহ, গরীবুল্লাহ শাহ, আকবর শাহ সহ চট্টগ্রাম শহরে অনেক কবরস্থান রয়েছে। যেসব কবরস্থানে মুসলিম নরনারীকে প্রতিনিয়ত দাফন করা হচ্ছে। এখানেও কবর সংরক্ষণে রেখে দেয়াটা অনেকটা কঠিন বলা যায়। আমাদের দেশে বড় বড় শহরে এরকম বাস্তব চিহ্নিত পাকা কবর এরিয়ার ভিতর এভাবে একাধিক কবর দেয়ার প্রচলন হয়ে গেছে তা বনানী কবরস্থানে এসে বাস্তব অভিজ্ঞতা লাভ করলাম।

বড় বড় শহরগুলিতে এক কবরের ভিতর অন্য কবর দেয়ার যে সিস্টেম চালু হয়ে গেছে। ছোট বড় অন্যান্য জেলা শহরগুলোতেও এ সিস্টেম চালু হয়ে গেছে বা হয়ে যাবে। তা গ্রামাঞ্চলেও সম্প্রসারিত হবে সন্দেহ নেই।

তবে কবরস্থানে মাটি ভরাট করে পুনঃ কবরস্থান হিসেবে ব্যবহার করার কথা ধর্মমতে জানা আছে।

ধর্মের অধিকাংশ ক্ষেত্রে মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। পাকা এরিয়া করা চিহ্নিত কবরে মাত্র ২০/৩০ বছরের আগের কবরেও এ দৃশ্যটি পরিলক্ষিত হবার নয়।

বনানী কবরস্থানের দুই খাদেম থেকে জেনে আরো অবাক হলাম যে, সংরক্ষিত এলাকা যেখানে দেশের উঁচু মানের অনেক গণ্য মান্য ব্যক্তিরা শায়িত রয়েছেন তথায় কবরসমূহে চারদিকে পাকা দেয়াল দেয়া কবরসমূহে মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে পুনঃ নিকটতম অপর ব্যক্তিকে কবর দেয়ার অনুমতি রয়েছে। যে হারে ২০/২৫ বছর থেকে দুই বছরের ব্যবধানে পুনঃ কবর দেয়া চলমান।

বনানীর এ সংরক্ষিত এলাকায় বর্তমানে এক তৃতীয়াংশ বা তারও বেশি কবরের ভিতর পুনঃ কবর দেয়া হচ্ছে। কোন কোন কবরে দুটি, তিনটি এমনকি চারটিও কবর দেয়া হয়েছে, হচ্ছে। তবে তা সিটি কর্পোরেশনের অনুমতি এবং নির্দিষ্ট ফি প্রদান সাপেক্ষে। আলাপে আরও জানতে পারলাম পুনঃ লাশ দাফন করতে গেলে দেখা যায় আগে দাফন করা বয়স্ক হলে তাঁর কঙ্কাল অক্ষত থেকে যায়। তখন তাতে মাটি চাপা দিয়ে পুনঃ লাশ দাফন করতে হয়। প্রচণ্ড গরমের ভিতর বনানী এ কবরস্থানে যেয়ারতের উদ্দেশ্যে বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটাই।

লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধওমানে সড়ক দুর্ঘটনায় রাঙ্গুনিয়ার প্রবাসীর মৃত্যু
পরবর্তী নিবন্ধক্লাসে শিক্ষকদের অনুপস্থিতি, গভর্নিং বডিকে নজরদারির নির্দেশ