আকদ ও জানাযায় অংশগ্রহণ করতে গিয়ে
বিব্রতকর পরিবেশের মুখোমুখি
দেশে ধর্মীয় তিনটি বিষয় নিয়ে মনের ভিতর অস্বস্তিকর অবস্থা জাগরুক থাকে। তৎমধ্যে (১) শুক্রবারে জুমার আগে মসজিদে খতিব সাহেবের নসিহত (২) আক্দ অনুষ্ঠানে সময়ক্ষেপণ (৩) জানাযা পড়তে গিয়ে অস্বস্তিকর পরিবেশের মুখোমুখি হওয়া।
আমাদের দেশে সম্মানিত খতিব সাহেব জুমার আগে নসিহত রাখেন। খতিব সাহেব নসিহত না করে শুধু জুমা পড়ান এ রকম মসজিদ দেশে হাতেগোনা কয়েকটি থাকতে পারে। অর্থাৎ সকল খতিব জুমার আগে নসিহত করেন। তা উপস্থিত নামাজীগণের জন্য যে কল্যাণকর তাতে ইতস্ততা নেই। অনেক খতিব নসিহতকে অতি গুরুত্ব দিতে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে নির্ধারিত সময়ের প্রতি খেয়াল রাখতে পারেন না, বা নসিহত শেষ করতে পারেন না।
মনে হয় বিভিন্ন মহল থেকে এ বিষয়ে আলোচনা সমালোচনা হওয়াতে বর্তমানকালে অধিকাংশ খতিব নসিহত করতে গিয়ে সময়কে মেনে চলছেন। অর্থাৎ নির্ধারিত সময়ে খুৎবাহ আরবী শুরু করছেন। মূলত মানুষ মসজিদে যায় জুমা পড়তে। একমাত্র মূল লক্ষ্য, উদ্দেশ্য জুমা পড়া। খতিব সাহেবের নসিহত অতিরিক্ত প্রাপ্তি। জোহরসহ ৫ ওয়াক্ত নামাজে সময় লাগে ১৫/২০ মিনিট। কিন্তু জুমায় আধা ঘণ্টা বা কম বেশি সময় নেয়। শত শত নামাজীর মধ্যে অনেকের শারীরিক সমস্যা থাকবে স্বাভাবিক। জুমার পরপর কোথাও দাওয়াতে গমন অথবা দূরযাত্রায় গমনাগমনে মুসল্লির সংখ্যাও কম নয়।
কিন্তু দুঃখের বিষয় আকদ ও জানাযায় অস্বস্তিকর অবস্থা চলমান বলে নিজ বিবেচনায় প্রতীয়মান। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শুক্রবার জুমার পর অথবা আছরের পর মসজিদে আকদের আয়োজন হয়ে থাকে। ধর্মীয় নিদের্শনায় আকদ অনুষ্ঠানে খুৎবাহ ও আকদ মিলে ৮/১০ মিনিটের ব্যাপার। মানুষের ব্যস্ত জীবন; বর কনের পক্ষে আবদার রক্ষার্থে, সওয়াবের নিয়তে আকদ অনুষ্ঠানে যাওয়া হয়। মূল আকদ পড়ান কনের পিতা বা কনে পক্ষের উকিল। ইমাম সাহেব খুৎবাহ পড়ে দোয়া করবেন মাত্র। কিন্তু নসিহতসহ নানা নিয়ম নীতি প্রদর্শন করতে গিয়ে শতের কম বেশি উপস্থিতির মধ্যে অনেকে অস্বস্তিবোধ করে থাকেন। যা আয়োজক ও ইমাম সাহেবের বুঝা উচিত। আকদ ধর্মীয় অনুষ্ঠান হলেও বর কনের পক্ষে আবদার অনুরোধ দাওয়াত রক্ষা করতে যাওয়া। এতে আকদের জন্য সময়ক্ষেপণ করতে দাওয়াতীগণ যাতে বিরক্তির কারণ না হয়। অনেক ক্ষেত্রে খতিব/ইমাম সাহেব মেয়ের পক্ষে উকিল থেকে এজিন নিয়ে নেন। যা উচিতও নয়; উত্তমও নয়। মেয়ের পিতাই আকদ দেয়া উত্তম। তা না হলে মেয়ের ভাই, চাচা, মামা তথা মেয়ের মোহররম হওয়া চাই। উকিল যদি মেয়ে থেকে এজিন নিয়ে আসতে পারেন তাহলে মসজিদে আকদ অনুষ্ঠানে বরকে আকদ দিতে না পারার কারণ নেই। প্রয়োজনে খতিব/ইমাম সাহেব সহযোগিতা করতে পারেন। খুৎবাহ সুন্নত কিন্তু মেয়ের পক্ষের উকিল বরকে আকদ দেয়া মূল অনুষ্ঠান বা আয়োজন।
দেশে সবচাইতে বড় অস্বস্তিকর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে জানাযায়। জানাযায় লাশকে সামনে রেখে বা লাশ আনতে আনতে ধারাবাহিকভাবে শোক প্রকাশের নামে বৃক্ততা দেওয়ার প্রচলন শুরু হয়ে গেছে। এতে রাজনীতিবিদ ও স্থানীয় প্রভাবশালীরা কথা বলতে বেশি দেখা যাচ্ছে। যা ২০/২৫ বছর আগে ছিল না। জানাযা একটি ধর্মীয় গুরুত্বপূর্ণ এবাদত। জানাযা ও দাফন উভয় ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করলে পূর্ণাঙ্গ সওয়াব। শুধু জানাযায় অংশগ্রহণ করলে অর্ধেক সওয়াব। মানুষ মাত্রই মরণশীল। অতএব জানাযায় অংশগ্রহণ করতে মুসলমানগণের মধ্যে অতি আগ্রহ। অপরদিকে বর্তমান কালে রাজনৈতিক সভা সমাবেশ থেকে দেশের সচেতন নাগরিক দূরে থাকে বলে মনে করি।
জানাযায় যেহেতু এলাকার সর্বস্তরের মানুষ অংশগ্রহণ করে থাকেন অতএব রাজনৈতিক স্থানীয় প্রভাবশালীদের আগ্রহ জাগে শোক প্রকাশের নামে এই সুযোগে জনগণের কাছে নিজেকে জাহির করে নেয়া। দেশে যেহেতু ইহা রেওয়াজ হয়ে গেছে অতএব জানাযার আয়োজকও অনেকটা বাধ্য স্থানীয় প্রভাবশালীদেরকে মাইক দিতে।
জানাযায় লাশের পক্ষে সন্তান নিকট আত্মীয় ২/১ মিনিট কথা বললে স্বাভাবিক। সময় থাকলে ইমাম সাহেব অথবা ধর্মীয় বিজ্ঞজন নসিহত রাখতে পারেন। কিন্তু স্থানীয় প্রভাবশালীদের শোক প্রকাশের নামে ধারাবাহিকভাবে ৫/৭ জন বা ৮/১০ জন বা আরও বেশি সংখ্যক ব্যক্তিকে মাইকে কথা বলতে দেয়া কোন মতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। জানাযায় অনেক ক্ষেত্রে এও দেখা যায়, স্থানীয় একদলকে মাইক দিলে অন্যান্য দল কি মনে করে সে জন্য সমতা রক্ষা করতে ৩/৪ দলকে কথা বলতে মাইক দেয়া হয়। দুঃখের বিষয় আমাদের দেশে মাত্র ২০/২৫ বছরের ব্যবধানে জানাযা কেন্দ্রিক সমাগমে এ রকম কলুষিত পরিবেশ কেন হয়ে গেল ভাবি।
চট্টগ্রাম শহরে জানাযা পড়তে গেলে পেছনে গিয়ে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকি। কিন্তু নিজ জন্মস্থান বাঁশখালীতে চট্টগ্রাম শহর থেকে কষ্ট স্বীকার করে জানাযা পড়তে গেলে বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। পরিচিতির কারণে পেছনেও দাঁড়ানো যায় না মাইকও পরিহার করা যায় না। যা নিজের ক্ষেত্রে খুবই বিব্রতকর অবস্থা মনে হয়।
বাঁশখালীতেও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা প্রভাবশালীরা জনতার সমাগমে ধারাবাহিকভাবে মাইকে কথা বলা রেওয়াজে পরিণত। এক্ষেত্রে ছোট নেতা আগে, মেজ নেতাকে অতঃপর বড় নেতাকে শেষে দিবে তাও রেওয়াজে পরিণত মনে হচ্ছে। বাঁশখালী নিজ জন্মস্থানে জানাযার পেছনে দাঁড়ালে যেমন উপস্থিতিগণের মধ্যে অস্বস্তি দেখা যায়, তাই সামনে চলে আসতে বাধ্য হচ্ছি, এতে মাইকে শোক প্রকাশের নামে ২/৪ কথা না বললে হয়ত উপস্থিতিগণের কাছে বিরূপ ধারণা আসতে পারে। সকলে উৎফুল্ল মনে শোক প্রকাশের নামে মাইক ব্যবহার করছেন, আমি কেন ব্যতিক্রম হব!
চট্টগ্রাম শহর থেকে কষ্ট করে বাঁশখালীতে যাই বিবেকের তাগিদে, সওয়াবের নিয়তে। শোক প্রকাশের নামে কথা বলা আমার দিল মন চাচ্ছে না। কিন্তু পরিস্থিতির কাছে বাধ্য হতে হচ্ছে মাইকে কথা বলতে।
আমরা যাতে জানাযা সমাগমে এ রকম বিব্রতকর অবস্থা বা পরিস্থিতি থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারি। সাথে সাথে জানাযায় ধর্মীয় বিজ্ঞজনের গুরুত্বপূর্ণ নসিহত বাদে এলাকার রাজনীতিবিদ প্রভাবশালীরা শোক প্রকাশের নামে মাইকে কথা বলার রেওয়াজ যাতে দেশ থেকে উঠে যায় সেই আশা রাখছি।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট