প্রবাহ

স্মৃতিতে ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল- ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছ্বাস

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ২৬ এপ্রিল, ২০২৩ at ৫:৫২ পূর্বাহ্ণ

১৯৯১ সালে ২৯ এপ্রিল সোমবার দেশের দক্ষিণাঞ্চলে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস আঘাত হানে। তৎমধ্যে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার উপকূলীয় এলাকা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত। বয়স্কজনের কাছে আজও এ ভয়াবহতার স্মৃতি জাগরুক থাকবে স্বাভাবিক। সামুদ্রিক উপকূল অঞ্চলে ২ শ কি.মি এর কম বেশি গতি সম্পন্ন বাতাসে ঘরবাড়ি ধ্বংস করে দেয়, তেমনি ১৫/২০ ফুট বা আরও উচ্চতায় সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস আঘাত হানে।

বিশ্বের ক’টি অঞ্চলে ক’ বছর পরপর ঘূর্ণিঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস আঘাত হানে। তৎমধ্যে বঙ্গোপসাগর অন্যতম। প্রতি বছর একাধিক বার নিম্নচাপ হয়। এতে ৫৭ নাম্বার বিপদ সংকেত বছরে একাধিক বার দেয়া হয়। কয় বছর পরপর ৮১০ নাম্বার মহাবিপদ সংকেতও দেয়া হয়ে আসছে। এতে বাংলাদেশ ভারতের উপকূলীয় অঞ্চলের জনগণের মাঝে ভীতিকর অবস্থা সৃষ্টি হয়।

১৯৬০ সালের অক্টোবরে চট্টগ্রাম অঞ্চলে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের পাশাপাশি সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস আঘাত হানে। এতেও এ অঞ্চলে কম জনসংখ্যা অধ্যুষিত অবস্থায়ও হাজার হাজার লোক মারা যায়, সাথে ঘরবাড়ী বিধ্বস্ত হয়, গাছপালা উপড়ে যায়। এ সময় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চলে আনোয়ারা, বাঁশখালী, পেকুয়া, কুতুবদিয়া, চকরিয়া, মহেশখালী অঞ্চলে।

১৯৭০ সালেও জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ক’দিন আগে প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়ের পাশাপাশি সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস আঘাত হানে। সন্ধীপ ভোলার দিকে ব্যাপক ক্ষতি হয়। এতে কয়েকটি নির্বাচনী এলাকার ভোট পিছিয়ে দিতে হয়েছিল।

১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের এরিয়া ছিল আরও ব্যাপক। দক্ষিণে কক্সবাজার উখিয়া, টেকনাফ, উত্তরে সন্দ্বীপ, হাতিয়া ভোলা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এরিয়ায় এ ঘূর্ণিঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস আঘাত হানে। তৎমধ্যে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয় সন্ধীপ, সীতাকুন্ড, চট্টগ্রাম মহানগর, পশ্চিম পটিয়া, আনোয়ারা, বাঁশখালী, পেকুয়া, কুতুবদিয়া, মহেশখালী ।

সাধারণত ঘূর্ণিঝড় ৫/৭ ঘণ্টা অবধি ব্যাপক ধ্বংস চালিয়ে স্থিমিত হয়ে যায়। কিন্তু ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল প্রায় ৮/১০ ঘণ্টা বা তারও বেশি সময় অবধি বাতাসের ভয়াবহতা থাকে। সাথে সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস ।

বাতাস ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস এত ভয়াবহ ছিল যে নন্দনকাননের বিশাল টিএনটি টাওয়ার ভেঙ্গে যায়। কর্ণফুলীতে বড় শীপ নোঙর ভেঙ্গে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে লোহার নির্মিত শাহ আমানত ব্রীজের উপড় আছড়ে পড়ে ছিড়ে নিয়ে যায়। কর্ণফুলী থেকে শীপ রাস্তার উপর উঠে যায়। চট্টগ্রাম বন্দর, বিমান বন্দর ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী ক’দিন চট্টগ্রামের সাথে টেলি যোগাযোগ, আকাশ যোগাযোগসহ প্রায় যাবতীয় যোগাযোগ বন্ধ থাকে। সন্দ্বীপ, কুতুবদিয়া এ দু’টি দ্বীপ ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই ঘূর্ণিঝড়ে রেকর্ড ১ লাখ ৩৮ হাজার লোক মারা যায়।

সীতাকুন্ড, পশ্চিম পটিয়া, আনোয়ারা, বাঁশখালী, পেকুয়া, মাতারবাড়ী, মহেশখালীতে কত হাজার নরনারী মারা গেছে তা যথাযথ হিসাব নির্ণয় করা হয়।

আমাদের দেশে এর আগেও ৭, , ৯ নাম্বার বিপদ সংকেত দেয়া হয়েছে। বাস্তবে ঘূর্ণিঝড় হয়নি। এতে এ জলোচ্ছ্বাসে হাজার হাজার মানুষ মারা যাওয়ার পেছনে ১০ নাম্বার মহাবিপদ সংকেতকে অবহেলা করা অন্যতম কারণ।

যেমন পেকুয়া উপজেলার উজানঠিয়া গ্রাম। ১৯২৯ সাল থেকে আব্বার জমিদারী এস্টেট রয়েছে। বড় ভাই আলহাজ্ব নুরুল ইসলাম চৌধুরী ১৯৬৫ সালে দ্বিতল বিশিষ্ট মজবুত করে দালান নির্মাণ করেন। এ এস্টেটে রয়েছে আমাদের নিজস্ব সম্পদের উপর কয়েক শ লোকজনের বসবাস। ব্যবস্থাপক মোবারক আলীর (মরহুম) সাহসিকতায় দালানে অনেকে এসে আশ্রয় নেয়। ঘূর্ণিঝড় হবে না অবহেলায় অনেকে আসেনি। ফলে আমাদের পারিবারিক এস্টেটের ছোট একটি পাড়ায় ৮৮ জন মারা যায়। এ ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছ্বাসের মাত্র ২/৩ দিন আগে উজানটিয়া গিয়ে ঘুরে আসি।

বাঁশখালী উপজেলা উত্তরদক্ষিণ প্রায় ৩০/৪০ কি.মি লম্বা। পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরে। ধ্বংসযজ্ঞ এরিয়ার মধ্যে অন্যতম বাঁশখালী একটি। সামুদ্রিক উপকূলে ৩/৪ কি.মি এরিয়ার মধ্যে মজবুত দালান তথা স্কুল কলেজে বা সাইক্লোন সেন্টারে আশ্রয় নেয়নি এদের মধ্যে বেঁচে আছেন এমন সংখ্যা কম। অর্থাৎ শুধু বাঁশখালী উপজেলার হাজার হাজার নরনারী মারা যায়। সাথে কত গবাদি পশু মারা যায় তার ইয়াত্তা নেই।

চট্টগ্রাম শহরে ছিলাম। দুপুর থেকে বৃহত্তর চট্টগ্রামে মহাবিপদ সংকেত নিয়ে আতংক বিরাজ করছে। যত সময় যাচ্ছে তত আতংক বাড়ছে। সন্ধ্যা থেকে বাতাসের চাপ পর্যায়ক্রমে বাড়তেই আছে। রাত ৮ টা ৯ টার পর থেকে বাতাসের ভয়াবহতা শুরু হয়। কাতালগঞ্জ আবাসিক এলাকায় বাসায় শুয়ে আছি। পাশে রেডিও এর যথাযথ সংবাদই একমাত্র ভরশা। রাত ১০ টা ১১ টার পর থেকে প্রবল বাতাসে দরজা জানালা শব্দ করছে। ৫/১০ মিনিট অন্তর ভয়াবহ বাতাস এর চাপ আসলে দালান কেঁপে উঠে। এ যেন এক ভয়াবহতার অনুভূতি। রাত ১২ টার পর রেডিও বলছে সন্দ্বীপ ডুবে গেছে। চট্টগ্রামের মহানগর বিভিন্ন ক্ষতিগ্রস্তের কথাও বলছে রেডিও। তখন প্রযুক্তি এত উন্নত ছিল না বিধায় রেডিও এর মাধ্যমে সংবাদ পাওয়া সহজ ছিল না। পরদিন সাতকানিয়া হয়ে অনেক প্রতিকূলতায় বাঁশখালী পৌঁছি। তখন আনোয়ারা হয়ে বাঁশখালী, পেকুয়া, চকরিয়া যাতায়াত চালু হয়নি।

বাঁশখালী প্রধান সড়কের নিকটে ৪/৫ কি.মি পশ্চিমে সমুদ্র উপকূল থেকে হাজার হাজার মানুষ এসে আশ্রয় নেয়। চারিদিকে হাহাকার, এক হৃদয় বিদারক দৃশ্য। মানুষ নিস্ব হয়ে পূর্বদিকে প্রধান সড়কের নিকটে চলে আসে। অধিকাংশ স্কুল কলেজ মাদ্রাসায় আশ্রয় নেয়। অনেক বিত্তবানেরা তৈরি খাবার নিয়ে এগিয়ে আসে। আমরাও পারিবারিকভাবে যতটুকু সম্ভব সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়াই।

১৯৯৭ সালেও ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহতা ১৯৯১ চেয়ে কম ছিল না। কিন্তু সেই সময় সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস ব্যাপক আঘাত হানেনি। ফলে মানুষের ঘরবাড়ি, গাছপালার দিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও মানুষ তেমন মারা যায়নি।

১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে হাজার হাজার মানুষ মারা যাওয়ার দৃশ্য ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী জানতে পারে। ফলে বিশ্ববাসী ত্রাণ সহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসে।

বিভিন্ন দাতা দেশ সামুদ্রিক উপকূলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধগুলো পাহাড়সম বৃহৎ আকৃতিতে পুনঃনির্মাণ করে দেয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় দীর্ঘ ৩২ বছরের ব্যবধানে সামুদ্রিক উপকূলে অনেক স্থানে এ বেড়িবাঁধগুলোর নাজুক অবস্থা। সাধারণত সামুদ্রিক উপকূলের বেড়িবাঁধ ১ বছর অন্তর অন্তর মেরামত করা আবশ্যক হয়ে পড়ে। সামুদ্রিক উপকূলের এমন স্থান রয়েছে যে সব স্থানে বিগত ৩২ বছর আগে দাতা দেশের নির্মিত বেড়িবাঁধ ন্যূনতম কোন সংস্কার হয়নি। এ দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে বৃষ্টির পানিতে মাটি সরে যেতে থাকায় এ বেড়িবাঁধগুলো বর্ষাকালে জোয়ারের পানি প্রতিবন্ধকের অবস্থাও নাই অনেক জায়গায়। যেমনটাপেকুয়া উপজেলার রাজাখালী, মগনামা, উজানটিয়া এসব এলাকা। নদীর অভ্যন্তরে বেড়িবাঁধ আর সাগর উপকূলে বেড়িবাঁধ এক কথা নয়। সাগর উপকূলে বেড়িবাঁধ প্রচন্ড ঢেউয়ে আঘাত হানে। অতএব বছর বছর মেরামত আবশ্যক হয়। এ ২৯ এপ্রিল সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে মারা যাওয়া লাখের অধিক নরনারীর প্রতি শোক জানাচ্ছি।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, গবেষক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপংকজ ভট্টাচার্য : ত্যাগী ও শুদ্ধ রাজনীতির বিরল প্রতিকৃতি
পরবর্তী নিবন্ধসুদানে বাংলাদেশ দূতাবাস ও রাষ্ট্রদূতের বাসায় গুলি