১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা লাভের পর প্রথম হজ্ব অনুষ্ঠিত হয় সম্ভবত ২৫ জানুয়ারি। মুক্তিযুদ্ধকালীন রমজানের পর পর প্রথমে সফিনায়ে আরব অতঃপর সফিনায়ে আরাফাত জাহাজ দু’টির প্রথম ট্রিপ চট্টগ্রাম থেকে জেদ্দার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। কিন্তু ১৯৭১ এর ২৬ মার্চ দেশে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়ে বছরের শেষের দিকে অস্বাভাবিক অবস্থার প্রেক্ষিতে দ্বিতীয় ট্রিপ আর যাওয়া হয়নি। এ জাহাজ দু’টি জেদ্দায় হজ্বযাত্রীগণকে নামিয়ে দিয়ে করাচি বন্দরে চলে আসে। হজ্বযাত্রীগণ জেদ্দায় পৌঁছে হজ্ব করলেও তারা কিভাবে দেশে ফিরবে তা অনেকটা অনিশ্চিত বলা যায়। সেই সময় ডেকের তথা ৩য় শ্রেণীর ভাড়াসহ হজ্বের সর্বমোট খরচ ছিল ১৯১৯ টাকা। ২য় শ্রেণী ৪ হাজার টাকা থেকে কিছু বেশি, ১ম শ্রেণী প্রায় ৭ হাজার টাকা।
২৫ জানুয়ারী হজ্বের পর বিশাল হৃদয়ের ব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পররাষ্ট্র মন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ জাতিসংঘের জেনেভার মাধ্যমে সৌদি আরব সরকারকে চিঠি দেয় হজ্বযাত্রীগণকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর জন্য। উত্তর আসতে বিলম্ব হচ্ছিল বিধায় বঙ্গবন্ধু নিজে চিঠি দেন বাদশাহ ফয়সলের কাছে। এতে সৌদি বাদশাহ ফয়সল সাড়া দেয় হজ্বযাত্রীগণকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে। চট্টগ্রাম বন্দর বিধ্বস্ত, দেশে সামুদ্রিক যাত্রীবাহী কোন জাহাজ নেই। সফিনায়ে আরব ও সফিনায়ে আরাফাত প্রথম ট্রিপ নামিয়ে দিয়ে করাচি চলে যায়।
ফলে বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে ভারতের মুহাম্মদী জাহাজ জেদ্দা গমন করে হজ্বযাত্রীগণকে নিয়ে আসতে। জেদ্দা থেকে ১ম ট্রিপ এসে মংলা বন্দরে গমন করতে চাচ্ছিল। সে লক্ষে মংলা বন্দরের কাছাকাছি পৌঁছলে নদীর গভীরতা কম ছিল বিধায় জাহাজটি আসতে অনেক কষ্ট হচ্ছিল। জাহাজ ঘুরিয়ে নিয়ে আসা হয় চাঁদপুর ঘাটে। ১ম ট্রিপের হজ্বযাত্রীগণকে নামিয়ে দিয়ে এ জাহাজ পুনঃ জেদ্দা গমন করে ২য় ট্রিপ নিয়ে আসার জন্য। ২য় ট্রিপের হজ্বযাত্রীকেও নিয়ে এসে চাঁদপুরে নামিয়ে দেয়।
এদিকে নতুন দেশ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ পর্যায়ক্রমে স্বীকৃতি দিচ্ছে। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার পাসপোর্ট ছাপায়। এ পাসপোর্টে প্রথম যে সব দেশ স্বীকৃতি দিয়েছিল সে সব দেশের সীল দেয়া হয়। ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বরে আমিও পাসপোর্ট করি। ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশকে ৩২ টি দেশ স্বীকৃতি দেয়। এ ৩২ টি দেশের নাম উল্লেখ করে সীল দেয়া আছে আমার পাসপোর্টে, তৎমধ্যে সৌদি আরব নেই । তখন পাসপোর্ট অফিস ছিল জামালখান রোডে।
এদিকে ১৯৭২ সালের শেষ দিকে হজ্বের কার্যক্রম সমাগত। ফলে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ ১২ সেপ্টেম্বর সৌদি সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নিকট চিঠি লিখেন বাংলাদেশ থেকে হজ্বযাত্রী গমনে অনুমতির জন্য। সৌদি সরকারের কাছ থেকে উত্তর আসতে বিলম্ব হতে দেখে বঙ্গবন্ধু নিজে ২৬ সেপ্টেম্বর বাদশাহ ফয়সলের নিকট চিঠি দেয় হজ্বযাত্রী যেতে অনুমতি দেয়ার জন্য। বঙ্গবন্ধু ছিলেন মহৎ, উদারপ্রাণ ব্যক্তিত্ব। সৌদি আরব যেহেতু এখনও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি, তিনি ইচ্ছা করলে গায়ে পড়ে চিঠি না দিয়েও পারতেন। বাদশাহ ফয়সল অনুমতি দেয়। বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে ভারত সরকার মুহাম্মদী জাহাজ প্রদান করে বাংলাদেশ থেকে হজ্বযাত্রী নেয়ার জন্য।
এতে পাহাড়তলী হাজী ক্যাম্প তৎপর হয় হজ্ব কার্যক্রম নিয়ে। দেশে অভ্যন্তরীণ যাতায়াতের জন্য মাত্র ৪০ আসনের ছোট দু’টি বিমান। এ দু’টি বিমান আভ্যন্তরীণ যাতায়াত সামাল দিয়ে কলকাতাও যাওয়া–আসা করে। অপরদিকে ১৭৮ আসনের ৭০৭ পুরাতন বোয়িং। এটি ঢাকা–ব্যাংকক এবং ঢাকা থেকে দুবাই হয়ে লন্ডন যাতায়াত করে। এমন প্রতিকূল অবস্থায় ভারতের মুহাম্মদী জাহাজে দুই ট্রিপ এবং ঢাকা তেজগাঁও বিমান বন্দর হয়ে আকাশপথে মাত্র ৩ হাজার হজ্বযাত্রী প্রেরণের সিদ্ধান্ত হয়। সে লক্ষে হজ্বযাত্রী পরিবহনে বিমান ভাড়া করা হয়। ভারতের মুহাম্মদী জাহাজটি সফিনায়ে আরব ও সফিনায়ে আরাফাত থেকে কিছুটা বড়। সফিনায়ে আরব ও সফিনায়ে আরাফাতের ধারণ ক্ষমতা ১৩ শত জন বা কিছুটা বেশি। ঢাকা থেকে বিমানে হজ্বযাত্রী প্রেরণ করতে তেজগাঁও বিমান বন্দরের নিকটে সরকারী নির্মাণাধীন বড় দালানকে সাজিয়ে অস্থায়ী হাজী ক্যাম্প করা হয়। এ পদ্ধতিটা বর্তমান বিমান বন্দরের বিপরীতে আশকোনা হাজী ক্যাম্প না হওয়া পর্যন্ত চালু ছিল। ১৯৭৩ সালের হজ্বে বিমান ভাড়া সহ সর্বমোট খরচ ছিল ৫ হাজার টাকা।
জেদ্দা হজ্ব টার্মিনাল, পবিত্র মক্কা ও পবিত্র মদিনায় বাংলাদেশ হজ্ব মিশন এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষে অস্থায়ী অফিস খোলা হয়। হজ্বের শেষ ফ্লাইটে সবাই হজ্ব টার্মিনাল হয়ে ঢাকায় চলে আসেন। তখন হজ্ব ছিল নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীনে। ভারতে মুহাম্মদী জাহাজটি পুরানো মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ায় ১৯৭৪ সালের হজ্বে এসে শুধুমাত্র বিমানে হজ্বযাত্রী পাঠানোর সাব্যস্ত হয়।
১৯৭৩ সালে এসে মাত্র ৩ হাজার জনকে হজ্ব করানোর সাব্যস্ত হয় এবং তা নির্ধারণ করা হয় জেলা ওয়ারী জনসংখ্যা অনুপাতে লটারীর মাধ্যমে। সে লক্ষ্যে একটি বিমান বিদেশ থেকে ভাড়া করা হয়। বিমানগুলো থাকত অনেকটা ছোট ৭৩৭ বোয়িং আকৃতির। জেদ্দা যাতায়াত করত দুবাই থেমে।
১৯৭৪ সালেও মাত্র ৩ হাজার হজ্বযাত্রী হজ্বে গমন করেন লটারীর মাধ্যমে নির্ধারিত হয়ে। টাকা সর্বমোট ৯ হাজার ৫ শত মত। ১৯৭৫ সালে এ টাকা বৃদ্ধি হয়ে হজ্বের সর্বমোট খরচ দাঁড়ায় ১৬ হাজার টাকা।
১৯৭৬/৭৭ সালে ঢাকায় সৌদি দূতাবাস খুলে। সৌদি এয়ারলাইন ঢাকা–জেদ্দা ফ্লাইট চালু করে। এতে বিগত ৫ বছর তথা ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত হজ্বে গমন করা যে কঠিন ছিল তা একদম সহজ হয়ে যায়। অর্থাৎ হজ্বে গমন দু’ভাগে ভাগ হয়ে যায়। ব্যালটি এবং নন ব্যালটি।
ব্যালটি বলতে সরকারি ব্যবস্থাপনায় এবং নন ব্যালটি বলতে স্বউদ্যোগে। পাসপোর্ট আর টাকা যে কোন ট্রাভেল এজেন্সীকে দিলে তারা ঢাকা সৌদি এম্বেসি থেকে হজ্ব ভিসা নিয়ে নেয়। অতঃপর জেদ্দা যাওয়া–আসার টিকেট করে দেয়। নন–ব্যালটি হজ্বযাত্রীগণ ঢাকা থেকে জেদ্দা হয়ে পবিত্র মক্কা ও পবিত্র মদিনায় পৌঁছে স্বউদ্যোগে ঘর ভাড়া করে অবস্থান নেন। রান্না করে বা রেস্টুরেন্টে খাবেন। হজ্বের সময় স্বউদ্যোগে অথবা মোয়াল্লেমের সহযোগিতায় হজ্ব করবে। এ হল নন–ব্যালটির অবস্থা।
ব্যালটিরা সরকারি ব্যবস্থাপনায় হজ্ব করবে। দেশ থেকে হজ্ব ফ্লাইটে পৌঁছবেন, সরকারী ব্যবস্থাপনায় সৌদি আরবে অবস্থান করবেন।
দীর্ঘ প্রায় ২৫ বছর এ নিয়ম চলতে থাকে। এ সময় ১৯৯০ এর দশকে থেকে প্রায় ২০১০ সাল পর্যন্ত কম করে হলে প্রতি বছর ৩৫ থেকে ৪০ লাখ সরকারী হজ্ব করত। অর্থাৎ আকাশ যোগাযোগ উন্নতি লাভ করায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে লাখ লাখ মানুষ হজ্বে আসত। তেমনিভাবে সৌদি আরবের অভ্যন্তর থেকেও সৌদি প্রবাসীরা হজ্ব করতে চলে আসতেন পবিত্র মক্কায়। গরীব দেশের লাখ লাখ হাজী পবিত্র মক্কায় যেনতেন স্থানে অবস্থান নিতেন খরচ কমানোর জন্য।
এতে সৌদি সরকারের টনক নড়ে। ২০০০ সালের পর থেকে নির্দেশনা জারি করে। আর তা হল কঠোর নিয়ম শৃংখলা মেনে বিদেশী হজ্ব এজেন্সী এবং পবিত্র মক্কায় মোয়াল্লেমের মাধ্যমে হজ্ব করতে হবে। বিদেশীদের কোটা মুসলিম জনসংখ্যা অনুপাতে হাজারে একজন। যা ২০০৪/৫ সাল থেকে এ নির্দেশনায় শক্ত অবস্থানে থাকে সৌদি সরকার। এতে হজ্বযাত্রীর সংখ্যা ২৬ লাখে নেমে আসে। ২০১৯ সাল পর্যন্ত এই নিয়মে চালু থাকে। ১৩৭ বছরের ইতিহাসে হজ্বে করোনা মহামারীর চরম প্রতিকূলতা সৃষ্টি করে। ফলে ২০২০ সালে বিদেশী ত নয়ই সৌদি আরবের অভ্যন্তর থেকে ১ হাজার রাষ্ট্রীয় মেহমান হয়ে হজ্ব করার অনুমতি পায়। তৎমধ্যে হজ্ব করেন মাত্র ৯৩৭ জন। ২০২১ সালে সৌদি আরবের অভ্যন্তর থেকে ৬০ হাজার জনকে হজ্ব করার অনুমতি দেয়া হয় নানা বিধিনিষেধ ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে। তৎমধ্যে ৫৮ হাজার ৫ শত ১৮ জন হজ্ব করেন নিজের অর্থে। ২০২২ সালে ১০ লাখ নর–নারী হজ্ব করেন করোনা টিকা, করোনা পরীক্ষা ইত্যাদি শর্ত সাপেক্ষে।
চলতি ২০২৩ সালে কত জন হজ্ব করবেন সময়ই বলে দিবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট