প্রবাহ

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ৫ এপ্রিল, ২০২৩ at ৫:০১ পূর্বাহ্ণ

একালে ভাল মানুষ দেখা মেলা ভার

একালে কেন জানি চারদিকে অন্ধকার দেখতেছি। অমাবস্যার চেয়ে গাঢ় অন্ধকার। অন্ধকারের ভিতর যে আলো একদম নেই তা নয়। আলো নিশ্চয় আছে। হয়ত আমার চোখে আসতেছে না। ১৯৬০/৭০ দশকের পর তথা ১৯৮০ এর দশক থেকে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট ভিন্নতারূপ লাভ করছে। হ্যাঁ, প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে পরিবর্তন এসেছে। যা তার আগে তেমন ছিল না বললেই চলে।

ব্রিটিশ পাকিস্তান আমল পেরিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ আমলের প্রথম দশক পর্যন্ত মানুষের জীবনযাত্রা ছিল গ্রাম ভিত্তিক সাধারণ। জনসংখ্যা ছিল কম, মানুষ গ্রামে বাস করত। বাড়ী ঘর ছিল মাটির অথবা বাঁশের। পাহাড়ী ছনের ছাউনী। কিছুটা সচ্ছল হলে টিন। গ্রামের মহিলারা হাঁস মুরগি পালন করত, বাড়ীর আঙ্গিনায় শাক সবজি উৎপাদিত হত। সন্তানেরা গ্রামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ত। ঘরের কর্তারা গ্রামে থাকত, হাল চাষ বা ন্যূনতম আয় রোজগার করে চলত। এতেই জীবনযাত্রার আয় রোজগারে তেমন অসুবিধা হত না। সেই সময় পাকা দালান বলতে কয়েক গ্রামে মিলে ২/১টি। হয়ত সেই ব্রিটিশ আমলের জমিদার। সেই সময় মসজিদ মাদ্‌রাসাও থাকত মাটি বা বাঁশের, পাহাড়ী ছন বা টিনের ছাউনী। সুলতানী/মোঘল আমলের মসজিদ বাদে হয়ত জমিদার পরিবারের বাড়ীর সামনে ১/২টি পাকা দালান মসজিদ থাকত।

মানুষ অপরাধ অন্যায় কি বুঝত না। মানুষ ছিল সহজ সরল। কারও প্রতি অবিচার করা বা অন্যায় করা বা অনিয়মভাবে অর্থ উপার্জন করা, মিথ্যা বলা, একে অপরের ক্ষতি করতে চাওয়া এসব কিছু ছিল না বললেই চলে। থেকে থাকলেও তা একদম ন্যূনতম পর্যায়ে। তার মূলে চাহিদা যেমন থাকত না তেমনি উচ্চাবিলাসও ছিল না।

১৯৮০ এর দশকে দেশে মানুষের জীবনযাত্রার মোড় ঘুরে যেতে থাকে। প্রযুক্তির আবির্ভাব হয়। ব্যাপকতা লাভ করে ইট সিমেন্ট রডের। জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে পাহাড়ী ছন উৎপাদন অনেকটা কমে আসতে শুরু করে। ফলে মাটি বা বাঁশের ঘরের স্থলে ইট দিয়ে ঘর করা অনেকটা অবস্থার চাহিদায় পরিণত হয়। পরিবারের ব্যয় বেড়ে যায়, বেড়ে যায় সন্তানের শিক্ষা লাভের ব্যয়। দেশে সেকেলে পদ্ধতির পায়ে হাঁটা বা নৌকা সাম্পান দিয়ে চলাচলের স্থলে সড়ক যোগাযোগও ব্যাপকতা লাভ করে। ফলে মানুষ নূন্যতম দূরত্বে যেতেও গাড়ি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। গ্রামেগঞ্জে বিদ্যুৎ সম্প্রসারিত হয়। বিদ্যুতের আরাম উপভোগ করতে গিয়ে ব্যয় চেপে বসে। ৯০ এর দশকে মোবাইলের আগমন ঘটে। এতে নতুন ব্যয় যোগ হয়ে যায়। উচ্চ শিক্ষা লাভ ছাড়া সন্তানদের ভবিষ্যত অন্ধকার। এতে তাদের যাতায়াত, মোবাইল, ল্যাপটপ ইত্যাদি ইত্যাদি ব্যয় নির্বাহ করতে পরিবারের কর্তা বাধ্য হচ্ছেন।

অর্থাৎ আগেকার আমলে সে প্রেক্ষাপট ১৯৮০ পরবর্তী ১৯৯০ এর দশকে ভিন্নরূপ লাভ করে। এতে মানুষের অর্থ উপার্জন আবশ্যক হয়ে পড়ে। অর্থ উপার্জনে মানুষ হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। যা ২০০০ সালে এসে টাকা উপার্জনের স্পৃহা প্রবণতা ব্যাপকতা লাভ করে। ফলে মানুষের মাঝে ন্যায়অন্যায়, হালালহারাম, লোপ পেয়ে যায়। শুধু তাই নয়, অনিয়ম উপার্জন যে অপরাধ হারাম তা বিবেকে তাড়িত হচ্ছে না। অপরদিকে, এই অনিয়ম উর্পাজনের অর্থ দিয়ে ধর্মপালনে ব্যাপকতা লাভ করে। মসজিদসমূহ পাকা হয়ে যায়, শহরের অধিকাংশ মসজিদ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বলা চলে। মানুষের মাঝে হজ্ব, ওমরাকারীর সংখ্যাও লাখ পেরিয়ে যায়। দেশে বেড়ে যায় দান খয়রাতের। বয়স বাড়লে টুপি, দাড়ি, এবাদাতে নিজেকে নিজে আল্লাহর ওলি মনে করছে।

নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে লাগামহীন অনৈতিক উপার্জন দেশে রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিরাজমান বললে বাড়িয়ে বলা হবে না এবং তা অপরাধ বলে মনে করা হচ্ছে না।

সরকারী, আধা সরকারী, স্বায়ত্ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান সমূহে নিয়মে পরিণত হয়ে গেছে কর্মক্ষেত্রে আসতেছেন ঐ জন্যই বেতন। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে কারও কাজ করলে তার বিনিময়ে অর্থ নেয়া নিয়মে পরিণত। অপরাধ মনে করা উঠে গেছে বলা যাবে। দেশে রয়েছে সরকারী, আধা সরকারী, স্বায়ত্ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান সমূহের লাখ লাখ কর্মকর্তাকর্মচারী। শতে ত নয় হাজারে কয়জন পাওয়া যাবে যারা সততায় থাকতে নিয়ম নীতি মানতেছেন। জনগণের করের টাকায় বিলাসী জীবন উপভোগ থেকে কয়জন মুক্ত। অফিস আদালতে সরকারী সম্পদের ব্যবহারের নিয়মনীতি কয়জন মানতেছেন। এসব কিছুতে সীমালঙ্গন পাপ মনেই করা হচ্ছে না।

ব্যবসাবাণিজ্য, কলেকারখানায় অনিয়ম দুর্নীতিতে মানুষকে ঠাকানো, উৎপাদনে দুর্নীতি, খাবার উৎপাদনে ভেজাল অনিয়ম অপরাধ মনে করা হচ্ছে না। ইহা স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত। মানুষের মাঝে বেশি বেশি অর্থ উর্পাজন করা, সন্তানসন্ততির ভবিষ্যত কল্যাণে সম্পদ রেখে যাওয়া প্রবণতা হয়ে গেছে। ফলে এই সন্তানের কল্যাণে দেশে বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়া হচ্ছে।

মানুষ মাত্র ভাল খারাপ সকলেই জানে। মৃত্যু অবধারিত। তারপরেও কেন অর্থ সম্পদ অর্জনে হিতাহিত জ্ঞান শূন্যে! তার মূলে একটাই কারণ সন্তান সন্ততির ভবিষ্যৎ চিন্তা।

বর্তমানকালে ধন সম্পদ অর্জনে হিতাহিত জ্ঞান শূন্যের পাশাপাশি ক্ষমতা লাভের প্রবণতা ব্যাপকতা লাভ করে। অর্থের বিনিময়ে ক্ষমতা লাভের সুযোগের দুর্নামকে অস্বীকার করা যাবে না। ফলে যারা অর্থের বিনিময়ে ক্ষমতাবান তারা ক্ষমতায় গিয়ে আরও ব্যাপক অর্থ লিপ্সায় নিজেকে বিলিয়ে দিবে স্বাভাবিক। তাদেরকেও অর্থ উর্পাজনে অপরাধ করতে অঘোষিত সুযোগ দিচ্ছে।

সবচেয়ে বেশি আফসোসের বিষয় ধর্মীয় জগত নিয়ে। দেশে ধর্মীয় জগতে কোটি পতি হওয়ার সুযোগ নেই বললেই চলে। তাদের আয় যে আগের চেয়ে বেড়ে গেছে তাতে সন্দেহ নেই। বর্তমানকালে এ আয়ের চেয়ে তাঁদের ব্যয় অনেক বেশি। পরিবারবর্গের ভরণ পোষণ চিকিৎসা মান সম্মান রক্ষা করতে চলা, সন্তানসন্ততির শিক্ষা খরচ আয়ের তুলনায় দ্বিগুণ চারগুণ বা আরও বেশি। এতে তারা নৈতিকতা কতটুকু রক্ষা করতেছেন ভাবতে হবে। হালালহারাম পার্থক্য কতটুকু রক্ষা করতেছে। সরকারী আধা সরকারী স্বায়ত্ত্বশাসিত চাকুরীতে ব্যাংক থেকে সুদী লোন নেয়া সহজ। এতে ধর্মীয় মতে কতজন মুক্ত। সরকারী, আধা সরকারী, স্বায়ত্ত্বশাসিত চাকুরীতে মূল বয়স পূর্ণ হওয়ার পরেও মিথ্যা বানোয়াটির আশ্রয়ে বয়স কম দেখানোর সার্টিফিকেট দেখিয়ে সরকারী টাকা নেয়ার প্রবণতা চলতেছে। অবশ্য বর্তমানকালে জন্ম নিবন্ধন কড়াকড়ি হওয়ায় বয়স নিয়ে মিথ্যার আশ্রয় নেয়া ভবিষ্যতে উঠে যাবে। ধর্মীয় জগতে নিজের স্বার্থ রক্ষার্থে মিথ্যা বানোয়াটের আশ্রয় নেয়া হচ্ছে।

এলমওয়ালা লোক আছে, কিন্তু তাদের মধ্যে আমলওয়ালা কয়জন আছে ভাবতে হবে। ধর্মীয় জগতে তাকওয়া পরহেজগারী ন্যূনতম পর্যায়ে বলা যাবে। যাদের বয়স ৭০/৭৫ বা তার ঊর্ধ্বে তাদের নিশ্চয় স্মৃতিতে ভাসবে সেই আগেকার আমলে ধর্মীয় জগত কত সুন্দর ছিল। কম বেশি সকলকে মহান আল্লাহ পাকের ওলি মনে করা হত।

একালে ন্যায় কথা বলা বিপদজ্জনক। ন্যায় কথা যদি কারও বিপক্ষে যায় এতে নিজের ইজ্জত সম্মানের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা। ইসলাম ন্যায়ের ধর্ম, ন্যায়ে থাকতে হবে। ন্যায়ের বিপক্ষে যাওয়া যাবে না অন্যায়ের পক্ষেও যাওয়া যাবে না। কিন্তু একালে তা কতটুকু সম্ভব।

একালে ধর্মীয় জগতে বা ধর্র্মপালন করা ব্যক্তিগণের দিলে জেগে বসেছে, ধর্মপালনই ধর্মের পরিধি। হালালহারাম, বাছ বিচার করা, মিথ্যা বানোয়াটের আশ্রয় নেয়া, অন্যায় অপরাধ করা, অবিচার করা, অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়া এসব কিছু ধর্ম মতে ছোট অনিয়ম।

ধর্মীয় জগতের মধ্যে একটি অংশ সুফিজম তথা তরিকতে পীর মাশায়েখ। সেই ১৪ শত বছরের ইতিহাসে মহান সুফিগণ দুনিয়াবিমুখ থেকে মহান আল্লাহ পাকের খাস বান্দা থাকতে এবাদাত বন্দেগীতে, ধ্যানে মোরাকাবায় জীবন অতিবাহিত করেন। হাজার বছরের এই সুন্দর পরিবেশ সুফিজগৎ গত ৩০/৪০ বছরের ব্যবধানে আজ কলুষিত। বর্তমানে ধর্মের ব্যানারে, পীরের সুফির ব্যানারে, সুক্ষ্ম কৌশলে দুনিয়া ভোগ করার প্রতিযোগিতা চলমান। চেয়ার, গদি, নামের আগে পরে লম্বা টাইটেলে ভরপুর থাকে। বেনামাজী, হালালহারাম, বাচ বিচার নাই। শরীয়তের ধার ধারে না। এই জাতীয় লোকের আধিক্য বর্তমানকালে পীরের দরবারে ব্যাপকতা লাভ করছে। এখানে রয়েছে ধনী ক্ষমতাবানদের মূল্যায়ন।

একালে দেশে বড় অংশ দুনিয়া ও আখিরাত সমান্তরালে পেতে চাচ্ছে। ধর্মীয় জগৎ লোকজন দুনিয়া পেতে মসজিদ, মাদ্‌রাসা, পীরের পদকে ব্যবহার করতে চাচ্ছেন। অর্থে ক্ষমতায় উপরে থাকলে ধর্মীয় জগৎ তাদেরকে খুবই মূল্যায়ন করতে থাকে।

১৯৮০ এর দশক থেকে একালে অধিকাংশের আয়ের উৎস কালো। এখন তারা দুনিয়া ভোগের পাশাপাশি নিজেকে নিজে অতি ধার্মিক মনে করতেছে, ধর্মীয় জগতে লক্ষ কোটি টাকা ব্যয় করতেছে। নিজে নিজে ধর্মপালন করছে। এতে নিজেকে অতী ধার্মিক আল্লাহর ওলিও মনে করতেছে।

আমাদের বুঝতে হবে দুনিয়াআখিরাত সমান্তরালে চলতে পারে না। আমাদেরকে কোন একটা বেছে নিতে হবে। একালে কোটি কোটি টাকা সম্পদের মালিক লাখ লাখ বলা যাবে।

শুধু তাই নয়, অর্থ সম্পদের পাহাড় গড়তে চলতেছে অঘোষিত প্রতিযোগিতা। এতে হাজারে কয়জনের আয়ের উৎস সাদা। অর্থ সম্পদ হওয়ার পর দেশ দরদী, সমাজদরদী, ধর্মদরদী হচ্ছেন। নিজেকে জাহির করা অত্যাবশ্যক মনে করতেছেন। অবৈধ অর্থে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, মসজিদ, মাদ্‌রাসা করা হচ্ছে। ধর্মীয় ও সাধারণ উচ্চ শিক্ষিতরা এখানে কর্মরত। তারা নব্য পয়সাওয়ালাকে তাওয়াজ না করে উপায় নাই। এতে নব্য ধনীরা অহংকারের সাগরে ভাসতে থাকে।

সারা দেশে যেহারে অনিয়ম, দুর্নীতি, চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, সন্ত্রাস, লুটপাট ব্যাপকতা লাভ করেছে ইহার শেষ কোথায়! মহান আল্লাহ পাকই জানে। জীবনের শেষপ্রান্তে এসে এসব দেখে ভাবতে থাকি।

বস্তুতঃ একালে যে ভাল মানুষ নাই তা নয়। তারা হয়ত হাতেগোনা অসহায়। ব্যয়ের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হিমশিম খাচ্ছেন। তারা নিজে নিজে সততায় থাকতে সচেষ্ট হলেও অন্যায় অবিচারের সাগর মাহসাগরের কাছে অসহায় বলা যাবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধনৃশংস ঘটনার কঠোর শাস্তি চাই
পরবর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে